অকূলের কাল। পর্ব ৪৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
আদালতের আলো–আঁধারি
সত্যকিঙ্করের ছক এবং ক্ষিতির সংশয় – এই নিয়ে একটা রিহার্সাল চলল পরের দিন।
মাস ছয়েক আগে পলাশী এবং যাদবপুর মিলিয়ে দুটো দিনরাত দোলন বাড়ির বাইরে ছিল। সেই তারিখ দুটোকে কাজে লাগিয়ে তাদের বিয়েটা দিব্যি ঘটিয়ে দেওয়া যায়।
কীভাবে? নোটিশটাই দেওয়া হয়েছিল কেবল। রেজিস্ট্রি হয়নি তো!
কটা বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়? আমার হয়নি। নরজিতের হয়নি, তোমাদের কোম্পানিরও হয়নি। তাবলে কি আমাদের বিয়েগুলো বিয়ে নয়! হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট বলছে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে আগে বিয়ে হবে। তারপরে ইচ্ছে করলে সেটা রেজিস্ট্রি করা যায় অফিসে গিয়ে। না করলেও সেই বিয়ে আইনসিদ্ধ। অতএব সেদিন যাদবপুরে নরজিতের মাসির বাড়িতে এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত এসে মন্ত্র পড়ে ক্ষিতির সঙ্গে দোলনের বিয়ে দিয়েছেন এবং সে রাতে তাদের ফুলশয্যাও সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং তাদের বিবাহচক্রের পুরোটাই ধর্ম, সমাজ এবং আইনের চোখে বৈধ।
কিন্তু এমন ঘটনা তো আদৌ ঘটেনি। পুরোটাই মিথ্যা।
এই মিথ্যাটাই মনসুর সাহেবের কাছে এমনভাবে বলতে হবে যেন এটি বর্ণে বর্ণে সত্যি। নাহলে তাঁকে দিয়ে মামলা করানো যাবে না। আমাদের হাতে তিনিই আছেন একমাত্র যিনি অল্প খরচে তোমার কাছে তোমার দোলনকে এনে দিতে পারবেন।
যদি জিজ্ঞেস করেন, পুরোহিতের নাম কী, ঠিকানা কোথায়?
পুরোহিতের নাম রাম চক্রবর্তী, ঠিকানা আমি লিখে দেব কাগজে। পরের গল্পটা হবে এরকম – বোন এইভাবে বিয়ে করেছে বলে তার বড়োলোক দাদা তাকে জোর করে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে এবং তার উপর অত্যাচার করছে। এখন আদালতের কাছে হতভাগ্য স্বামীর আবেদন এই যে দাদার কাছ থেকে উদ্ধার করে তাকে তার স্বামীর কাছে এনে দেওয়া হোক।
সত্যকিঙ্কর এই সবে আইন পড়া শুরু করলে কী হবে, সে যে তুখোড় আইনবাজ এ-ব্যাপারে ক্ষিতি নিমেষেই নিঃসংশয় হয়ে গেল। দোলন যখন চাইছে তার কাছে আসতে – তার ইচ্ছাপূরণের জন্য যা করতে হবে, যতদূর যেতে হবে পিছপা হবে না সে। দোলনকে উদ্ধার করার বাহন আর অস্ত্র – একালে যখন আদালত আর আইন, তখন তাদের দ্বারস্থ হওয়াই ভবিতব্য। তা নইলে ঠিক এই সময়েই তাকে পথ দেখাতে সত্যকিঙ্করের আবির্ভাব ঘটবে কীহেতু!
মোহিনী পন্ডা আসবেন পরের সপ্তাহে। সে-পর্যন্ত অপেক্ষা। সত্যকিঙ্করের দৌড় মোহিনী পর্যন্ত, মনসুর সাহেবের হাতে ব্যাটন তুলে দিতে স্বয়ং তিনিই পারবেন। কীভাবে তিনি ক্ষিতির আবেদন পেশ করলেন সেটা জানা গেল না। সত্যকিঙ্করের উলটো মেরুতে তাঁর অবস্থান। কথায় কৃপণ, শোনায় দরাজ। তিনি ফিরে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন ক্ষিতি যেন পরের দিন সকাল নটায় মনসুর সাহেবের চেম্বারে গিয়ে দেখা করে।
মনে দ্বিধা, ভয় তবুও সংকল্পে অবিচল ক্ষিতি পরের দিন যথাসময়ে রওনা দিল পার্ক সার্কাসে মনসুর সাহেবের চেম্বারের খোঁজে। বাসস্টপে নেমে এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই সে পথ বাতলে দিল। বড় রাস্তা থেকে এক গলিতে ঢুকে কিছুটা হেঁটে পৌঁছতে হলো চেম্বারে। হাইকোর্ট খুব বিশাল ব্যাপার, কিন্তু মনসুর সাহেবের চেম্বার নেহাতই ছোটখাটো। কাচে ঢাকা দেওয়ালের নীচ থেকে উপর পর্যন্ত তাক-ভর্তি মোটাসোটা আইনের বই বাদ দিলে বাকি সবই ন্যাড়া ন্যাড়া লাগল ক্ষিতির চোখে। টেবিলের পিছনে একটা কাঠের চেয়ারে বসে গোলগাল, গোঁফদাড়ি-কামানো মুখের স্বাস্থ্যবান যে-মানুষটি তাঁর উলটো দিকের টুলে বসা এক ফরসা, দীঘল তরুণীকে ইংরাজিতে শ্রুতিলিখন দিচ্ছিলেন, তিনিই যে মনসুর সাহেব – তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পিছন দিকে একটা বেঞ্চি পাতা আছে। চেয়ার-টেবিল আর বেঞ্চের মাঝখানের সামান্য ফাঁকা জায়গাটায় জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ক্ষিতি। সেদিকে চোখ পড়তেই মনসুর সাহেব হাঁক পাড়লেন, – এই ছেলেটা – কে রে তুই? সামনে আয়।
ওই এক কথাতেই মানুষটাকে কেমন ভালো লেগে গেল ক্ষিতির। ভরসাও পেল খুব। বলল, – মোহিনী –
তাঁর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সাহেব বললেন, – বাঁকুড়ার কমরেড মোহিনী পন্ডা পাঠিয়েছে তোকে? সামনে আয়। কেসটা কী খুলে বল।
এলোমেলোভাবে মিথ্যে বিয়ের গল্পটা কোনোরকমে শেষ করল ক্ষিতি। মনসুর সাহেব তার বাড়ি ঘরদোরের বৃত্তান্ত, এখানে কোথায় থাকে, কী করে সব জেনে নিলেন। তার স্ত্রী, মানে দোলনের ঠিকুজিকুষ্ঠিও বলতে হলো। এখনও ছাত্র, এদিকে বিয়ে করে নিয়েছে শুনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। দোলনের দাদার নাম শুনেই বলে উঠলেন, – বসাক? তো ঢাকার তাঁতির জামাই পছন্দ হচ্ছে না! রাজপুত্তুর চাই! কিন্তু বাবা, কমরেড মোহিনী তোকে আমার কাছে পাঠাল কেন? তোর বউকে তার দাদা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রেখেছে – এ তো ক্রিমিন্যাল কেস। এ কেস হাইকোর্টে হবে না। তুই এক কাজ কর। একজন ভালো ক্রিমিন্যাল লইয়ারের ঠিকানা দিচ্ছি। শোভাবাজারে থাকেন। আমি তোর কথা তাঁকে ফোনে বলে দিচ্ছি। গিয়ে দেখা কর। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এমন তো কথা ছিল না। যুদ্ধে নেমে প্রথমেই হোঁচট। ফিরে এসে হতাশ ক্ষিতি সত্যকিঙ্করের কাছে ক্ষোভ উগরে দিল। সত্যকিঙ্কর বলল, — নেভার মাইন্ড নেভার মাইন্ড মাই ফ্রেন্ড। যুদ্ধে আগুপিছু আছে। জয় আমাদের হবেই। বলেছেন যখন, চলোই না একবার যাই ফৌজদারি উকিলের কাছে। আজ সন্ধেতেই ঘুরে আসি। দিনের বেলায় আমার ক্লাস। যেতে পারব না তোমার সঙ্গে।
সকালবেলায় একটা চেম্বার, সন্ধেবেলায় আর একটা। যেন আকাশ আর পাতাল। শোভাবাজারের উকিলবাবুর লম্বাটে চেম্বারে লম্বালম্বি বেঞ্চি পাতা আছে। মক্কেলের ভিড়ে গমগম করছে। কী-সব চেহারা তাদের। দেখলেই গা শিউরে ওঠে। সিড়িঙ্গে চেহারার উকিলবাবুটিকে দেখেও ভক্তিশ্রদ্ধা হলো না ক্ষিতির। সে সত্যকিঙ্করের হাত ধরে টান দিল। সোজা চেম্বারের বাইরে। তার মন বলছে এ-লোকের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায় না। সে সত্যকিঙ্করকে বলল, – মরতেই যদি হয় রামের হাতেই মরব, রাবণের হাতে নয়।
পরের দিন সকালে ক্ষিতি একলাই গিয়ে হাজির হলো মনসুর সাহেবের কাছে। তার ভেতরে আবেগ টগবগ করছে। দ্বিধাহীন গলায় বলল, — কিছু করতে হলে আপনিই করুন। অন্য কারও কাছে আমি যাব না।
মনসুর সাহেবের ঠোঁটদুটি জোড়া হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এল। ঘাড় নিচু করে চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে ক্ষিতির চোখে চোখ রাখলেন মিনিট খানেক। তারপর বললেন, – হাইকোর্টে মামলা মুখের কথায় হয় না। ডকুমেন্ট লাগে। কী ডকুমেন্ট আছে তোর কাছে যে মেয়েটা তোর বউ আর তাকে বাপের বাড়িতে আটকে রেখে অত্যচার করা হচ্ছে?
অনেক ভেবে ক্ষিতি বলল, – চিঠি আছে। আমাকে লেখা চিঠি।
মনসুর সাহেব বললেন, – সঙ্গে এনেছিস চিঠিগুলো?
–না তো!
–পরের দিন সব চিঠিগুলো আর অবশ্যই মেয়েটার বয়সের সার্টিফিকেট নিয়ে আসবি। তারপর ভাবব কী করা যায়।
কোথায় পাওয়া যেতে পারে বয়সের সার্টিফিকেট? সত্যকিঙ্কর বলল, – কেন, স্কুলে গেলেই পাওয়া যাবে। পরীক্ষা না-ই বা দিল। স্কুলের রেজিস্টারে বয়স লেখা আছে। হেড মিস্ট্রেসের কাছে দরখাস্ত দিলেই হবে। কে দেবে দরখাস্ত? ক্ষিতি দরখাস্ত দিলে হবে?
এবার সামান্য চিন্তিত সত্যকিঙ্কর। একটু ভেবে নিয়ে বলল, – জলির সঙ্গে যোগাযোগ করো। ওই পারবে ব্যবস্থা করতে।
তিনটে জায়গায় টিউশন ছাড়া আপাতত অন্য কিছু কাজ নেই ক্ষিতির। পড়াশুনা লাটে উঠেছে। দোলন-উদ্ধারই একমাত্র লক্ষ্য। পরের দিনই হস্টেলে গিয়ে জলির সঙ্গে দেখা করল। খুবই আত্মবিশ্বাসী সে। বলল, – বীণাপাণি পর্দা হাই ইস্কুলের বড়দিমণিকে সে ভালোমতোই চেনে। খুব ভালোমানুষ তিনি। বললেই দিয়ে দেবেন।
যেই কথা সেই কাজ। দিন তিনেক পরেই জলি দোলনের স্কুল-লিভিং সার্টিফিকেট নিয়ে এসে হাজির হলো নরজিতের কোয়ার্টারে। তাতে তার জন্মতারিখ যা লেখা আছে, হিসেব করলে তার বয়স দাঁড়াচ্ছে আঠারো বছর নয় মাস।
সেই সার্টিফিকেট খতিয়ে দেখে সত্যকিঙ্করের মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে উঠে গেল স্লোগানের ভঙ্গিতে – জয় আমাদের হবেই।
কিন্তু পরের দিন মনসুর সাহেবের চেম্বারে আবার হোঁচট। দোলনের চারখানা চিঠি আর বয়সের নথি সাহেবের হাতে তুলে দেওয়ার সময় ক্ষিতির চোখে বিশ্বজয়ের অদৃশ্য হাসিটি চিঠিগুলি পড়া শেষ করেই এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিলেন মনসুর সাহেব, – নিজের বাড়িতে সে ভালো নেই, তোর কাছে আসতে চায় এটুকুই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তোদের যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক – চিঠির মধ্যে তার কোনো উল্লেখ নেই। চিঠির সম্বোধনেও সেই সম্পর্কের হদিশ নেই।
মনসুর সাহেব আগের দিনের মতোই তার চশমার ওপরের ফাঁক দিয়ে ক্ষিতির আলো নিভে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে একটি আশ্বাসবাক্যও জুড়ে দিলেন, – ভালো করে খুঁজে দ্যাখ – তেমন কোনো চিঠি যদি পাওয়া যায়।
কোনো ইঙ্গিত ছিল কি সাহেবের কথায়? থাকলেও সেদিন তা বুঝতে পারেনি ক্ষিতি। একরাশ নিরাশা নিয়ে ফিরেছিল নরজিতের ডেরায়।
(ক্রমশ)
