অকূলের কাল। পর্ব ৪১। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
চাকরি গেছে, প্রেম গেল পিছে
সেই-যে দরাজ ডাক্তারের সাত পৃষ্ঠা-ব্যাপী ওষুধের বরাত আর একই সঙ্গে তার বিল-তৈরির যাদু-দক্ষতায় সাহা সামান্য মজেছিল তার নবীন বিক্রিওলার গুণে, তা স্থায়ী হলো না বেশিদিন। দিন দুয়েক পরেই ভবানীপুরের এক মিষ্টভাষী দোকানদারের কথায় গলে গিয়ে চেকে ওষুধের দাম নিতে সাহাকে রাজি করাল ক্ষিতি। তখনও পাঁচ অঙ্কের ওষুধের বরাত আর তার মুখে মুখে অঙ্ক করার যাদুতে সাহার সম্মোহন চলছে। সেই ঘোরে সে চেক নিতে রাজি হয়ে যায়। গোল বাঁধল যখন সেই চেক বাউন্স করল। মোহঘোর কেটে গেল সাহার। ব্যাঙ্কের ছুঁড়ে ফেলা চেকটা সাহা এবার ছুঁড়ে মারল ক্ষিতির মুখে, –এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা আদায় করে আনবেন, নইলে আপনার মাইনে থেকে কেটে ওষুধের দাম উশুল করব বলে দিলাম।
টাকার পরিমাণ বেশি নয় – মাত্রই দুশো পঁচাশি টাকা কিন্তু ক্ষিতির মাইনের হিসেবে নেহাত কমও নয়। এতো সুন্দর করে কথা-বলা লোকটা কি জেনেবুঝে তাকে ঠকাতে পারে! ক্ষিতির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল না। চেকটা যত্ন করে সে নিজের ব্যাগের মধ্যে রাখল। কোনো কারণে হয়তো হয়ে গেছে। তারা চেক জমা দেওয়ার আগেই জরুরি দরকারে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হয়েছে বলে কম পড়ে গেছে – সেতো হতেই পারে!
পরের দিন ফেরত হওয়া চেকটা সেই মিষ্টভাষীর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া মাত্র তিনি লজ্জায় প্রায় এক হাত জিভ বের করলেন, – ছিছি! কিছু মনে করো না ভাই, অজান্তে হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা অসুবিধেয় পড়েছি। আগামী সোমবার এসো, আমি নগদ দিয়ে দেব।
সোমবারে হাজির হতেই কুড়িটা টাকা তিনি গুঁজে দিলেন ক্ষিতির হাতে। ক্ষিতি যতটা না আশাহত, তার চাইতে বেশি অবাক। অন্তত একশো টাকা দিক। বাকিটা না হয় আরও দু-দিনে দেবে। আরও কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষিতি বুঝে গেল ভদ্রলোকটির মধুর কথার শেষ নাহি যে… টাকার বেলায় বিশ থেকে দশে নেমে এল দিন পিছু।
আরও মাস দুয়েক কেটে গেল। বিকাশবাবু কাজে যোগ দিয়েছে। সাহা বিল তৈরি করার কাজটা সেই তখন থেকেই ক্ষিতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। বিকাশবাবুর অর্ডারের বিলও ক্ষিতিকেই করতে হচ্ছে। উপর থেকে দেখলে সাহাকে অর্ধ-ঘুমন্ত মনে হলেও ব্যাবসা-বুদ্ধি তার সদা জাগ্রত। বিল করতে বিকাশবাবু যা সময় নিত, ক্ষিতি তার অর্ধেকও নেয় না। তাছাড়া, দোকানের এক মাত্র ক্যালকুলেটারে সাহার অধিকার নিরঙ্কুশ হয়েছে, যেহেতু ক্ষিতির সেই যন্ত্রটির প্রয়োজন পড়ে না। মধুবাগীশ দোকানদার দশ-বিশ করে এই দু-মাসে আড়াইশো টাকা শোধ করেছে। এখনও বাকি পঁয়ত্রিশ টাকা। এই অবস্থায় আচমকা দুঃসংবাদ! হরিবাবু কাজ চালাতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। পরের মাস থেকেই তাকে অবসর দিতে বাধ্য হচ্ছে সাহা। অতএব নতুন কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত আগামী মাস থেকে বিকাশ এবং ক্ষিতিকেই ওষুধ বয়ে নিয়ে দোকানে দোকানে দিয়ে আসতে হবে। আর তিন দিন পরেই শুরু হবে পরের সেই মাস। উত্তপ্ত হতে শুরু করল ক্ষিতি। সাহা ভেবেছে কী! ক্ষিতিকে দিয়ে ওষুধের শিশি-বোতল ভর্তি থলে বওয়াবে! সেই ছোট থেকে আজ পর্যন্ত যতটুকু বুঝেছে সে, অতখানি সস্তা চোখে কেউ কখনও মাপেনি তাকে। বরং গভীর গোপনে নিজেকে নিয়ে তার একটু অহংকারই আছে। এইতো সেদিনই যেমন সে বিল তৈরি করে সাহার চোখে নিজের যে-মূল্য দেখতে পেয়েছিল তাতেই মিলেছিল সেই অহং-তৃপ্তি।
মাসের শেষ দিনটিতে এসে তার কাছে জি এম মেডিকেল স্টোর্স–এর যা যা কাগজপত্র ছিল সব নামিয়ে রাখল ক্ষিতি সাহার টেবিলে। বলল, – কাল থেকে আর আসব না। ওষুধ বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। আমার এ-মাসের মাইনে থেকে মধুক্ষরার বকেয়া পঁয়ত্রিশ টাকা কেটে নিন।
সাহা আবার চমকাল। মৌসুমি, ময়ালসাপ-স্বাক্ষরে ডাক্তারবাবুর ওষুধের বরাত, মুখে মুখে হিসেব করে বিশাল মাপের বিল তৈরির পর ক্ষিতিকে নিয়ে সেটা তার চতুর্থ ও শেষ চমক। অপমানিতও হলো কি? ঠিক বুঝল না ক্ষিতি। কিন্তু সাহার কথায় উষ্ণতা ধরা পড়ল – যে ক’মাস কাজ করলেন, আমার কিছু লাভ হলো না। যা এনেছেন নিজেই খেয়েছেন। আসলে মন দিলে আপনি পারতেন। মন ছিল নিজের পড়াশুনায়, আমার দিকটা যেটুকু না করলেই নয় সেটুকুই করেছেন।
ক্ষিতি নিরুত্তর। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সাহা তার ব্যাবসার খাতায় হিসাব-নিকাশে মগ্ন হয়ে রইল। ক্ষিতি অধৈর্য এবং ক্রুদ্ধ হতে শুরু করল। যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে শেষ মাসের মাইনের তার দরকার নেই, সাহাকে দান করছে ঘোষণা করে দিয়ে চলে যাবে তার দোকান থেকে, তখনই সাহা খাতা সরিয়ে রেখে ড্রয়ার খুলে ন’টা দশ টাকার নোট তিনবার গুনে তার দিকে বাড়িয়ে ধরল। পরিষ্কার হিসাব! একশো পঁচিশ মাইনাস বকেয়া পঁয়ত্রিশ সমান নব্বই। তবে তার শেষ কথাগুলো বেশ কোমলই মনে হলো – আমার কাছে কাজ আপনি খারাপ করেননি, লাভ না হলেও ক্ষতি কিছু করেননি। পড়াশুনা করে আরও বড়ো হোন। দরকার মনে করলে আবার আসবেন, আমার দরজা খোলাই থাকবে।
ক্ষিতি তো গরমে গরম, নরমে নরম। হাসি হাসি মুখ আর হাত-জোড়ে নমস্কার জানিয়ে শেষবারের মতো বেরিয়ে এল বাগরি মার্কেটের জি এম মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে।
পরের দিন কোম্পানির কাছে রিপোর্ট করতেই তিনি ক্ষিতির সিদ্ধান্তে এক কথায় সিলমোহর লাগিয়ে দিলেন – বেশ করেছ! হারামজাদা ভেবেছে কী! মাল বওয়াবে তোমাকে দিয়ে! দুজনের কাজ একজনের মাইনে দিয়ে সারার ধান্দা। এর থেকে আরও দু-একটা টিউশন ধরাই ভাল।
ক্ষিতি নির্ভার, অন্য দিকে আবার যে-কে-সেই, যেমন ছিল তেমনই গরিব। ভালো বলতে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সময় মিলবে বেশি। গত সপ্তাহে ওয়ান হস্টেলে গোলকের ওখানে যাওয়া হয়নি। এবার থেকে নিয়মিত যেতে হবে। কষ্টের সঙ্গে মিশে দোলনের জন্য দুশ্চিন্তাটাই একমাত্র জ্বালাচ্ছে। এই যে মাস ছয়েক চাকরি করল ক্ষিতি, একটা দিনও দোলন ফোন করতে পারেনি। বিয়ের নোটিশের পর তিন মাসের সীমা শেষ হয়ে গেছে। দু-দুবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। দুবারই ধরা পড়েছে আর কড়াকড়ি বেড়েছে। একবার তো ওর বড়দা গায়েও হাত তুলেছিল। এখন বউদিরা যথাসম্ভব ওকে দাদার দৃষ্টির আড়ালে রাখার চেষ্টা করে। ওকে দেখলেই নাকি তার মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। এই ছ’মাসে যোগাযোগ বলতে চারখানি চিঠি। জলি আর ভেলির হাত দিয়ে পাঠাতে পেরেছে। সব চিঠির বক্তব্য মোটামুটি একই – বাড়িতে ওর উপর মানসিক অত্যাচার হচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি চলছে। তিনতলায় কেউ না থাকলেই ফোনের ঘরে তালা পড়ে যায়। কথা বলার লোক বলতে একমাত্র মেজবউদি। কিন্তু সেও ভয়ে ভয়ে। অন্যদের আড়ালে। জলি আর ভেলি এসব ব্যাপারে নেই বলে বড় বউদির বিশ্বাস। তাই ওরা এলে দেখা করতে দেয় বড়বউদি। কিন্তু তাদের হাতে চিঠি পাঠায় জানতে পারলে সেদিনই সব বন্ধ হয়ে যাবে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। যেভাবেই হোক ক্ষিতি যেন তাকে এই বাড়ি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
চাকরি-মুক্ত হয়েই পরের রবিবার ওয়ান হস্টেলে বিশু আর গোলকের সঙ্গে পরীক্ষা-প্রস্তুতির আসরে হাজির হয়েছিল ক্ষিতি। সেখান থেকে নরজিতের কোয়ার্টারের দিকে রওনা হতে গিয়েও কী মনে হল – নিজের হস্টেলের দিকে পা বাড়াল। অনেকদিন যাওয়া হয় না, মনোজিৎদা তো আছে এখনও, একবার দেখা হলে ভালোই লাগবে। রবিবারের সন্ধে, মনোজিৎদাকে স্বভাবতই পাওয়া গেল না। কিন্তু অন্য একটি জুনিয়র ছেলে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল তাকে। শুধু তাই নয়, চমকে যাওয়ার মতো একটা খবরও দিল সে। গতকাল ক্ষিতির একটা ফোন এসেছিল। তাকে না পেয়ে জানিয়েছিল পরের দিন আবার করবে। ক্ষিতিকে সেই খবরটা দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ক্ষিতিকে খবরটা দেবে কী করে বুঝতে পারছিল না। ছেলেটি বলল, – পুরনোরাও কেউ আপনার ঠিকানা জানে না। আগে তো প্রায়ই আসতেন, সেই আশাতেই ছিলাম। খুব ভালো হলো আজই এসে হাজির হলেন দাদা। আপনার এই উপস্থিতি মনে হচ্ছে অলৌকিক-প্রায়।
একটু পরেই ফোনটা এল। ওপ্রান্তে কতদিন পরে দোলনের সেই মোহময় স্বর, একটু যেন ধরাধরা, – শোনো, তুমি আমাকে ভুলে যাও। বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তুমি আর আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও চেষ্টা করবে না।
একটা অপ্রত্যাশিত ধাক্কা, নিমেষেই অন্ধকারে ভরে গেল চরাচর, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে ক্ষিতির জগত এবং জীবন। তার অবশ হাত থেকে খসে পড়ল রিসিভার।
(ক্রমশ)
