অকূলের কাল। পর্ব ৩৮। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

কাজের মধ্যে থাকলে দোলন এবং পরীক্ষার কথা দিব্যি ভুলে থাকা যায়। চাকরির দ্বিতীয় দিনে টালিগঞ্জ থেকে ভবানীপুরের রাস্তার দুপাশের ওষুধের দোকানের দিকে নজর রেখে হাঁটতে হাঁটতে এরকমই একটা উপলব্ধি হলো ক্ষিতির। পরিশ্রম, ক্লান্তি, খিদে আর ঘুম সরিয়ে রাখতে পারে হৃদয়ের ব্যথা, ভবিষ্যতের কথাও। দোলনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ, রবিবার রবিবার বিশু গোলোকের সঙ্গে পরীক্ষা-প্রস্তুতির বৈঠকগুলোও এড়িয়ে চলতে পারলে এই দুই-কাঁটার খচখচানি থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। তবে ভাবনাই সার, মনের অন্তঃস্থল থেকে নিশ্চিত জানে ক্ষিতি, ওই দুটো ব্যাপার সম্পন্ন করার জন্যে সর্বস্ব বাজি রাখাই তার নিয়তি।

অলৌকিক কাণ্ড রোজ ঘটে না। টালিগঞ্জ থেকে ভবানীপুরের মধ্যে কোনো মৌসুমির দেখা মিলল না। কাজ বলতে সতেরটা দোকানের নাম যুক্ত হলো ক্ষিতির ডাইরিতে। আর, একটা মাত্র দোকান থেকে তিনটে মাত্র আইটেমের অর্ডার। অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে আজ যেটুকু জমল সেটা ক্ষিতির পক্ষে বেশ স্বস্তিজনক। এই কাজে ভালো ভালো কথা বলতে পারার সঙ্গে সাফল্যের তেমন যোগ নেই। সে যেহেতু ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি নয়, ওষুধের গুণাগুণ নিয়ে কীর্তন করতে হয় না। চালু দোকানের মালিক বা ম্যানেজারের সময়ও নেই সেসব শোনার। স্টকিস্টের সেলসম্যান এলেই সবাই রিকুইজিসনের খাতা এগিয়ে দেয় তার দিকে, কোনো বাছবিচার করে বলে মনে হয় না। যার কোম্পানির ওষুধ বেশি বিক্রি হয়, অর্ডারও সেই বেশি পায়। আরও কিছু ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই, সেসব জানতে অভিজ্ঞতা বাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয় দিন সাহার মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হচ্ছিল ক্ষিতির। সঙ্গে কৌতূহলও। মৌসুমির মাল পাঠিয়েছিল কি? পাঠিয়ে থাকলে নগদ টাকায় তার ডেলিভারি হয়েছে তো?

সাহার মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না। কী-না-কী উত্তর শুনতে হবে এই ভয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। সেদিনের সামান্য অর্ডার দেখেও সাহার ভুরু এদিক ওদিক হলো না। বলল, – প্রথম মাসটায় এরকমই হবে। ভিজিটে কামাই দেবেন না। দোকানে ভিড় না থাকলে একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে নানারকম কথাবার্তাও বলবেন।

ক্ষিতি জানে, সাহার এই শেষ নির্দেশটা জলে গেল। গপ্পোবাজ ভিন্ন প্রজাতি, ক্ষিতির আলাদা গোত্র। বেকার আমড়াগাছি করাও তার ধাতে সইবে না। ঘাড় নেড়ে সে বেরিয়ে আসার উপক্রম করছিল, তখনই সাহা বলল, – হ্যাঁ, মৌসুমির দিকে বিশেষ নজর দেবেন।

ক্ষিতির চোখে প্রশ্ন দেখে সাহা আবার বলল, – ‘নজর’ মানে বলছি কী – খাতির করা, সম্মান দেখানো, স্যার-ট্যার বলা আর কি।

এটাও বেকার যাবে, তবে ক্ষিতির কৌতূহল মিটে গেল। মৌসুমির ওষুধ ডেলিভারি নির্বিঘ্নেই ঘটেছে এবং নগদে। চাকরিটা হুট করে খারিজ হওয়ার সম্ভাবনাটা আপাতত কমল।

আজ ক্ষিতির উত্তরে যাওয়ার দিন নয়, সপ্তাহে তিনদিন সন্ধেবেলায় খিদিরপুরে টিউশন। বাকি তিনদিন হস্টেলে অপেক্ষা – ফোন কিংবা চিঠির।

নরজিতের কোয়ার্টার বিরহী ক্ষিতির চোখের সামনে দেখতে দেখতে মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠছে। ক্ষিতি এখন রোজগেরে, মাস গেলে মাইনে একশো, টিএ পঁচিশ, টিউশন পঁয়ত্রিশ – একশো ষাট। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী নরজিত হরেক লোনের কিস্তি বাবদ কেটেকুটে একশো টাকাও হাতে পায় না। ক্ষিতি মাইনে পেয়েই সত্তর টাকা নরজিতের হাতে তুলে দেয়। ফলে রান্নায় এখন ডাল চাটনি ছাড়াও মাঝে মাঝে মাছ আর ক্ষিতির জন্য নিরামিষ তরকারিও হচ্ছে। রাতে কোনো কোনো দিন রুটির বদলে পরোটা। বিরহ ছাড়া ক্ষিতির অভাব বলতে কিছু নেই। জেলফেরত ত্রিমূর্তি আপাতত বিপ্লবের কথা মুলতুবি রেখে ভিন্ন পথ ধরেছে। অশোক নন্দীগ্রাম থেকে মাঝে মাঝেই নরজিতের কোয়ার্টারে এসে দু-চার দিন কাটিয়ে যাচ্ছে কোম্পানির অগোচরে। রেলপথে এক মোহিনীকে দেখে বিপ্লবী থেকে হস্তরেখাবিদ হয়েছিল সে। তারপর ক্রমশ হাত থেকে হৃদয়ে। মাসে অন্তত একবার আসতেই হচ্ছে দেহমনের যত্নআত্তি করতে। তবে মেয়েটিকে নিয়ে সে কখনও কোয়ার্টারে আসেনি। কোথায় কোথায় তাকে নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় ক্ষিতি জানে না।

বিপ্লবের পথ থেকে সরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে বলে একমাত্র দিলীপের আক্ষেপই উচ্চকিত। একই সঙ্গে হতাশা আর আশাবাদ নিয়ে সর্বদাই সে সরব থাকে। নরজিতের কোয়ার্টারে এসে তার বারান্দায় সে ইদানীং প্রায়ই রাত কাটায়। কোন এক ইস্কুলের দিদিমণি তার সঙ্গে থাকে। তাকে ‘দিদি’ বলেই ডাকে দিলীপ। মেয়েরা বরাবরই দিলীপকে একটু বেশিই পছন্দ করে। সুকুমার বালকের মুখ দিলীপের। শরীরটিও পেলব। নরজিতের একফালি বারান্দায় হৃষ্টপুষ্ট মসৃণ ত্বকের কৃষ্ণা দিদিমণির শরীরটিও আঁটে না ঠিকমতো। অতএব দিলীপকে দিদিমণির বুকের উপরেই শুয়ে থাকতে হয় সারা রাত। নরজিত তো মহাদেব-প্রায়। কোনো দৃশ্যেই চিত্তবিক্ষেপ হয় না তার। আর ক্ষিতি তো বহুদিন হলো দোলন ছাড়া অন্য মেয়েদের ‘মেয়ে’ বলে দেখতেই ভুলে গেছে। দিদিমণিকে সে দিলীপের দিদিমণি হিসেবেই দেখে। অতএব স্থিরচিত্ত সে-ও।

একটু সমস্যা হচ্ছিল অমিয়কে নিয়ে। অশোক এলে সে তো আসেই। মাঝে মাঝে মামাকে দেখতেও চলে আসে কোয়ার্টারে। দিদি-দিলীপকে বারান্দায় দেখতে দেখতে তার মনে ঢেউ উঠেছিল বোধহয়। কয়েকদিন পরে রঞ্জিতের মুখে চওড়া হাসি। বলল, – মামা, তোমার ভাগ্নেরও একটা হিল্লে করে দিলাম।

বুঝতে সময় লাগল ক্ষিতির। অমিয়রও প্রেম করার বাসনা জেগেছিল। মেয়ে পাওয়া যাবে কোথায়? রঞ্জিতের ঝুলিতে খুঁজলে সবই মেলে। মিলে গেল মেয়েও। হাসপাতালেই আয়ার কাজ করে, অল্পবয়সি কালোকেলো একটি মেয়ে। প্রায়ই অমিয়র সঙ্গে তাকে দেখা যেতে লাগল নরজিতের কোয়ার্টারে। তবে বেশিদিন নয়। অমিয়র পছন্দ হয়নি মেয়েটাকে। শারীর-কৌতূহল স্তিমিত হতেই, বিশেষ করে মেয়েটি বিয়ে করার বায়না করতেই অমিয় অদৃশ্য হয়ে গেল। নরজিতের কাছেও তার কোনো হদিশ বের করতে পারল না মেয়েটি।

বুলিই কেবল রাজনীতির মাঠ ছাড়েনি। নকশালদের সঙ্গ ছেড়ে তার পুরনো দল সিপিএমের সঙ্গে ক্রমশই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে সে। বিপ্লবের আশা ছেড়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলেই শ্রমিক-কৃষকের নেতৃত্বে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে উঠবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply