অকূলের কাল। পর্ব ৩৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
রাস্তায় বেচারাম
বারোটা বাজার আগেই গোবিন্দ সাহার বিক্রিওয়ালা পদে ক্ষিতির নিয়োগ নিয়ে পাকা কথা হয়ে গেল। বাকি সারাটা দিন পড়ে রইল, কী করা যায়? কলেজ যাবে একবার? পরীক্ষা ফেলে দিয়ে উঠে আসার পর থেকেই কলেজের কথা ভাবলে মনটা তেতো হয়ে উঠছে। তেতো ভাবটা জোর করে সরানোর চেষ্টা করল ক্ষিতি। ভদ্র গোছের চাকরি পেতে গেলে প্রাথমিক শর্ত গ্র্যাজুয়েট হওয়া। নইলে চাকরির কম্পিটিটিভ পরীক্ষার দরজা খুলবে না। এ-বছর ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে সেটা সেরে ফেলতেই হবে। দোলনের ব্যাপারটায় উদ্দীপনার সঙ্গে চাপও আছে গলাগলি করে। বাগরি মার্কেট থেকে বেরিয়েই ক্ষিতি হাঁটতে শুরু করল বিদ্যাসাগর কলেজের দিকে। নিয়মিত ক্লাস না হয় না-ই করল, কিন্তু মাঝে মাঝে কলেজে গিয়ে যোগাযোগটা রাখা দরকার। নইলে পড়াশুনার কথাটাই হয়তো মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে।
কলেজে পা রাখতেই ক্ষিতি স্তম্ভিতপ্রায়। কলেজের কমন রুমে গুলতানি মারছে বিশু আর গোলোক। বিশু মানে বিশ্বেশ্বর মাইতি, তাদের ক্লাসের সেই ধুতিপরা ফার্স্ট বয়, ব্যাকরণপটু-সাঁতারু। গোলোক সাধুখাঁও মেদনিপুর জেলার ছেলে, স্কটিশেরই ওয়ান হস্টেলে থাকত। বিশু এখন অবশ্য ধুতি পরা ছেড়ে প্যান্ট-শার্টই ধরেছে, তবে গোলোকের মতো ইস্ত্রি-পরিপাটি নয়। তাদের কাছে খবরাখবর শুনে নিমেষেই ক্ষিতির মন পালকের মতো হালকা। ওরাও পরীক্ষা দেয়নি। গোলোক হস্টেলেই থাকছে। সে বড়োলোক বাড়ির ছেলে। খরচ নিয়ে তাকে ভাবতে হয় না। বিশুরও ইদানীং আর অভাব নেই, সে সাঁতারের দৌলতে রেলে কেরানির চাকরি পেয়ে গেছে। একই ডালে তিন পুরনো পাখি, তিন জনেরই ডানায় জোর – কিচিরমিচির করতে করতে কলেজ থেকে বেরিয়ে কচুরি-জিলিপি খেয়ে কলেজ স্কোয়ারের দাঁড়ে গিয়ে বসল। বিশুর সরকারি চাকরি, সবে প্রথম মাসের মাইনে পেয়েছে, দরাজ মনে খরচ করে চলেছে।
ক্ষিতি ভাবছে, কী-ভাগ্যিস অজান্তেই সে আজ মহেন্দ্রক্ষণে এসে পড়েছে কলেজে। নইলে হয়তো সারা বছরেও যোগাযোগ হতো না এদের সঙ্গে। আসল কাজটা হলো শেষে। বিশু একটা চমৎকার পরিকল্পনা পেশ করল। প্রতি সপ্তাহে রবিবার তারা তিনজনে একটা জায়গায় জড়ো হয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করবে, নোট দেওয়ানেওয়া করবে। গোলোকের হস্টেলই যে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা –তিনজনেই এক কথায় একমত। সেদিন দুপুরের খাওয়া গোলোকের হস্টেলেই হবে, অতএব সকাল থেকে সন্ধে – পুরো সময়টাই কাজে লেগে যাবে। ভালো রেজাল্ট করা শুধু সময়ের অপেক্ষা!
আড্ডা ভাঙতে বিকেল। ক্ষিতি ভেবেচিন্তে উত্তরের দিকেই হাঁটা দিল। আজকের দিনটা ভালো। হস্টেলে গিয়ে দেখাই যাক দোলন আজ ফোন করে কি-না। একটা স্থায়ী বন্দোবস্তের কথাও এই মুহূর্তে তার মাথায় এল। এরপর থেকে তাকে যখন রোজই বিকেলে বাগরি মার্কেটে ওষুধের অর্ডার জমা দিতে আসতেই হবে, সন্ধেবেলায় হস্টেল ঘুরে যাওয়াই যায়। দোলনের ফোন যেদিনই আসুক, মিস হবে না।
ভালো দিনে সব কিছুই ভালো হয় না – ঘণ্টা দুয়েক হস্টেলে থেকেও ফোন না পেয়ে এই জ্ঞান মাথায় নিয়ে রঞ্জিতের কোয়ার্টারের দিকে ফিরল ক্ষিতি।
পরের মাস থেকেই প্রায় একাকী জীবন ক্ষিতির। রঞ্জিতের সঙ্গে থাকলেও প্রায়ই এমন হয় যে দিনেরাতে একবারও দেখা হলো না দুজনের। কোয়ার্টারে তালা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রথম দিকে থাকলেও চাবি রাখার ঝামেলায় জেরবার হয়ে সেটা পরিত্যাগ করতে হয়েছে। বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে যে-যার মতো যায়, আবার ছিটকিনি খুলে যে-যার মতো ঢুকে পড়ে। চুরির কথা মাথায় আসার প্রশ্নই নেই, এলাকার সব চোরই জেনে গেছে, নরজিত দাসমোহান্ত পার্টির শ্লোগান থেকে উঠে আসা এক বিশুদ্ধ সর্বহারা। ।
সকাল আটটায় বেরিয়ে পড়ছে ক্ষিতি। কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগের মধ্যে একটা ডাইরি, অর্ডারের বিল বই আর পেন। একটা বাস ধরে খিদিরপুরের মোড়ে নেমেই হাঁটা শুরু করে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে। দৃষ্টি রাস্তার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই – ওষুধের দোকানের সন্ধানে। মুখচোরা ক্ষিতির মনে অস্বস্তি বিজবিজ করছে। ওষুধের অর্ডার চাইতে গেলে কীভাবে, কী কথা বলে শুরু করবে! ঠিক করতে না পেরে মরিয়া ক্ষিতি, অর্ডার না পেলে চাকরিটাই বড়জোর যাবে – ধরে নিয়ে নিজের স্বভাবমতোই প্রতিটি দোকানে ঢুকে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিড় না থাকলে খদ্দের ভেবে দোকানিই এগিয়ে এসে কথা বলে। মনে মনে বারবার আওড়ানো কথাগুলোই কোনোরকমে উগরে দেয় – জি এম মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে আসছি। আমরা অ্যালবার্ট, ইন্ডন আর ই মার্কের ওষুধ রাখি। অর্ডার দিলে হোলসেল দরে দোকানে পৌঁছে দিই।
দোকানি চোখ দিয়ে তাকে মেপে নেয়। দু-একজন ভদ্রতা করে বলে, – নতুন দেখচি আপনাকে, আসবেন মাঝে মাঝে, অর্ডার থাকলে রেখে দেব।
মনে জোর আনার চেষ্টা করে ক্ষিতি। গোবিন্দ সাহাও বলেছিল, প্রথম মাসটায় হয়তো অর্ডারই পাবেন না। নিয়মিত যেতে হবে তবুও। পরিচিত হতে একটু সময় লাগবে। তবুও দু-চারটে দোকান ঘোরার পরে নিজেকে কেমন ফালতু ফালতু মনে হলো। দোকানের খদ্দেররাও তার দিকে কেমন করুণার চোখে তাকাচ্ছে। নিজের ওজন বাড়াতেও কিছু একটা করা দরকার। মনে হতেই দোকানে ঢোকার আগে সে ব্যাগ থেকে ডাইরি আর পেন বের করে হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে ডাইরি খুলে দোকানের নাম ঠিকানা লেখে। তাতে ভবিষ্যতে কাজে লাগার মত একটা তালিকা তৈরি হবে, আবার কিছু একটা কাজ করছে বলে নিজের থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
মোমিনপুর পর্যন্ত আসতেই ক্ষিতি বুঝতে পারল, তার পরিকল্পনায় আশাতীত ফল মিলছে। অর্ডার একটাও না পেলে কী হবে, দশ-বারোটা দোকানের নাম উঠেছে তালিকায় – এর পরের দোকানটার নাম কী হতে পারে তা নিয়ে মানসাঙ্ক করতে থাকলে হাঁটায় উৎসাহ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দোকানের নাম তালিকায় তুলে সে যখন ম্যানেজার বা মালিকের কাছে গিয়ে ‘নমস্কার’ বলে নিজের কথা শুরু করছে তখন নিজেকেও খানিক ওজনদার বলে মনে হচ্ছে।
মোমিনপুরের মোড় পেরিয়েই ডানদিকে একটা ওষুধের দোকান চোখে পড়ল ক্ষিতির। অদ্ভুত নাম – বেদগর্ভ ঔষধালয়। নামটা খুব মনে ধরল। দোকানে অবশ্য খদ্দের নেই একটাও। দোকানের মালিকই হবেন বোধহয় – ধবধবে ফরসা, ধুতি পাঞ্জাবি পরা বেশ অভিজাত চেহারা ভদ্রলোকের, – কাউন্টারের সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বললেন ক্ষিতিকে। এতগুলো দোকান ঘোরার পর এই প্রথম একটু মনোযোগ পেল সে। খানিক আশান্বিতও। শেষ পর্যন্ত জুটল না কিছুই, ক্ষিতির ঠিকুজি-কুষ্ঠি জেনে তাকে গুচ্ছের উপদেশ দিয়ে অবশেষে মিষ্টি করে জানিয়ে দিলেন, – এদিকে এলেই সে যেন একবার ঢুঁ মেরে যায় তাঁর দোকানে। তাদের কোম্পানির ওষুধ নাকি বিশেষ বিক্রি হয় না তাঁর দোকানে। সামান্য যা হয়, তিনি চেষ্টা করবেন তাকে অর্ডার দিতে। বিশেষ হতাশ হলো না ক্ষিতি – বরং ‘বেদগর্ভ’ নামটা তাঁর মাথায় থেকে গেল।
কপাল চওড়া হলে অভাবনীয় ঘটনাও ঘটে। চুলের ঢাল নেমে গিয়ে কপালটা তার ঢেকে রাখে, নইলে যে-কেউ খালি চোখেই ক্ষিতির চওড়া কপাল দেখতে পেত। ক্ষিতির অবশ্য সেটা চোখে দেখার দরকার পড়ে না, মাঝে মাঝেই এমন সব ঘটনা ঘটে যে সেটা টের পেতে অসুবিধে হয় না। তেমনটাই হলো তার চাকরির প্রথম দিনে।
(ক্রমশ)
