অকূলের কাল। পর্ব ৩৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
ঝড়ো তিনটে দিনের পর গভীর এই শূন্যতার মধ্যে সময় আর কাটতে চাচ্ছে না ক্ষিতির। অগিল্ভি হস্টেলে অমরশঙ্করের কোয়ার্টারে এখন বৌদিও নেই। দাদা আছেন তাঁর নিজের মতো। ক্ষিতির সঙ্গে কথাও বিশেষ হয় না। কী-কথাই বা হবে! খাওয়াও তাই, খেতে হয় বলেই খাওয়া। ডাইনিং হলেও যাওয়া হয় না। এখানেই দুই ভাইয়ের খাবার চলে আসে। রোজকার খাওয়া-শোয়ার অভ্যাস বাদ দিলে একটা ঘোরের মধ্যে কাটছে ক্ষিতির। গতকালের ছাড়াছাড়ির পর আবার কবে কথা হবে, দেখা হবে কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখনও রাগ, কখনও অভিমান, কখনও বা হতাশায় আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে মন। তাকে স্থির করতে গল্পের বই নিয়ে মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করে কিন্তু মন বসে না। তখন কাগজ কলম টেনে নেয়। লিখতে ইচ্ছে করে। কী লিখবে না জেনেই কাগজে শব্দ আঁকা হয় – নিরর্থক ক্রোধ –
শেয়ালমালের রামচালাকি, ল্যাম্পপোস্টের ট্যাসট্যাসানি ঢের হয়েছে!
পদ্মপাতায় জল থাকে কি? দাঁড়া না সব উবেই যাবে –
চোখ উল্টে মর্গে গিয়ে পড়বি যখন – হয়তো শান্তি।
পরের দিন শব্দেরা কিছু স্থিতি পায় –
চিন্তার গভীর ফাল কপালে ফেলেছে রেখা
কোন পথে যাবি রে গাড়োল?
ঋজু ও মসৃণ পথ চলে গেছে
গন্তব্যের কোমল আশ্রয়ে –
তবুও তোর দৃষ্টিতে কী-অন্ধতা যে,
যে-পথে রেখেছিস পা, সে তো কানাগলি
পথশেষে উদ্যত তর্জনী!
অবশেষে অসহায় দার্শনিকতা –
সময়, তোমার পায়ে বাজে লক্ষ শেকল
বিফল তানে কীটের আয়ু মাপে তোমার দীর্ঘ শরীর,
ভয়ের বেড়ির চালচুলোতে আটকে গেছি
সংকুচিত এই আবাসন, অপমানে তৃণানুনীচ –
আর পারি না –
রোজনামচা চলতেই থাকে একই দিনে একাধিক বার। অস্থির, লক্ষ্যহীন, চিন্তা দানা বাঁধার সময় পায় না – ঝরে পড়ে অক্ষর সব কলমের ডগা দিয়ে –
তুচ্ছ তীব্র বেদনার সূক্ষ্ম ঝালরে
নরকের বাসা এক –
বিন্দু বিন্দু বিষ দিয়ে বিষের সাগর।
অপ্রেমের শীৎকারের মতো
পাঁজরের পায়ে পায়ে প্রতি পলে
ধূম্র-অগ্নি-ঝড়!
বিষণ্ণ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত
হৃৎপিণ্ড আমার গলে গলে পড়ে
ধাতব শব্দের অপেক্ষার
কষ্ট নেই বুকের ভিতরে
তাই বড়ো একা লাগে
চিরস্থায়ী কান্না এক জেগে রয় রক্তের গভীরে…
ক্ষরণ…গরল… মরু… ক্লান্তি…নির্বাসন।
উত্তর কলকাতার এক কলেজ হস্টেল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে খিদিরপুর পেরিয়ে ডক লেবার বোর্ড হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নরজিতের কোয়ার্টারে স্থিতু হওয়ার পর ক্ষিতি এই সময়ের রোজনামচা পড়ে এত সব অর্থহীন শব্দের মধ্যে আবিষ্কার করেছিল দুটিমাত্র শব্দযোজনা – ধাতব শব্দ – যার সমাধান খুঁজছিল মন। এতখানি দূরত্বের সেতু কীভাবে অতিক্রম করবে টেলিফোনের রিং!
সময়ই সবকিছুর সমাধান করে দেয়। তার আগে কিছুদিনের অস্বস্তি। সকালে উঠে খিদিরপুরে এসে চা-জলখাবার আর হেলু-বুড়িকে পড়ানো। বিকেলে খিদিরপুরেই আর দুটো টিউশন জোগাড় করে দিয়েছেন কোম্পানি। গবেট কিন্তু সরল দুই ভাইবোনকে পড়াতে হয় অঙ্ক আর ইংরাজি। পারিশ্রমিক পঁয়ত্রিশ টাকা। রঞ্জিতের একটাই সমস্যা – সে সর্বদাই ঋণাত্মক। যত ধরনের ঋণ পাওয়া যায় অফিস থেকে সবই তার নেওয়া হয়ে গেছে। কাজেই খাওয়াদাওয়া সর্বদাই অনিশ্চিত। তার উপরে তার কোয়ার্টারে অতিথিদের আনাগোনার বিরাম নেই। দেশ থেকে আত্মীয়পরিজন খুব যে আসে তা নয়, বেশি আসে পার্টির লোক। সিপিএমের মিনি ঘাঁটি তার কোয়ার্টার। যারই যখন কাজ পড়ে কলকাতায় এখানে এসেই ওঠে। তার মধ্যে থাকেন এমএলএ ও তাঁর অনুগত চেলারা। মোহিনী পন্ডার এমএলএ হস্টেলে থাকা পছন্দের নয়। তিনি এলে নরজিতের কোয়ার্টারেই ওঠেন। সঙ্গে থাকে অবধারিতভাবে সত্যকিঙ্কর দাসমোহন্ত। কখনও বা শঙ্কর ডাক্তার। সিমলাপালের পশারওলা এবং পয়সাওলা ডাক্তার, তারও পছন্দের জায়গা নরজিতের কোয়ার্টার। তিনি সিপিএম পার্টির ভেতরের লোক।
নরজিতের কোয়ার্টারে একটা ঘর, এক ফালি ব্যালকনি-বারান্দা, ছোট্ট একটা রান্নাঘর, সেই অনুপাতেই বাথরুম-পায়খানা। এর মধ্যে শেষোক্ত জায়গাটিই সব থেকে বেশি যত্নে থাকে। নরজিতের মন্দির যেন। প্রতিদিন নিজের হাতে অম্ল-ঘর্ষণে তাকে চকচকে করে রাখে সে। একবার হাসপাতালে তো একবার কোয়ার্টারে – চরকির মতো কাজ করে চলে রঞ্জিত, ক্লান্ত হতে দেখা যায় না তাকে। বিশেষত তার ঘরে একসঙ্গে অনেক অতিথি এসে হাজির হলে। ঘরে একটাই চওড়া খাট, সম্মানননীয় অতিথিদের জন্য বরাদ্দ, তিন জন অব্দি কুলিয়ে যায়। একটা বিছানা পাতা হয় ব্যালকনির সরু বারান্দাতে, আর একটা রান্নার পর রান্নাঘর শুকনো করে মোছার পর। রঞ্জিত এই সময়ে রাতের ডিউটি নিয়ে নেয়। তাতে খানিক জায়গার সাশ্রয়। এ তো গেল পরিসরের সমস্যা। এরপরে আসছে অর্থ-সমস্যা।
এইসব মান্য অতিথি এলে রঞ্জিতকে ঋণের হাত লম্বা করে সম্ভব-অসম্ভব জায়গা হাতড়ে ফিরতে হয়। তাদেরকে বিশেষ খাতির না করলে রঞ্জিতের মান থাকে না। – মামার কাছে কিছু আছে নাকি?
সব জায়গার খোঁজ হয়ে গেলে অবধারিতভাবে ক্ষিতির পকেট হাতড়াতে হয়। বাসভাড়া রেখে পকেট খালি হতে সময় লাগে না। তার মধ্যেই প্রায়ই নন্দীগ্রাম থেকে অশোক আচমকা চলে আসে। বাবাকে লুকিয়ে আসা, তাই চুপিচুপি রঞ্জিতের কোয়ার্টারে। সে-আসার অন্যবিধ কারণ আছে।
বিশেষ অতিথি না থাকলে সমস্যা হয় না। চাল পর্যাপ্ত থাকে রঞ্জিতের ভাঁড়ারে। খানিক পোস্তর ব্যবস্থা করতে পারলে আর চিন্তা নেই। তেঁতুল দিয়ে পোস্তর চাটনি যা-বানায় না রঞ্জিত, পেটেন্ট নিতে পারলে ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক হতে সময় লাগবে না। এই পরিকল্পনা তাদের বহুদিন ধরেই চলছে, কবে বাস্তবায়িত হবে কে জানে! তো সেই পোস্তর চাটনি দিয়ে অশোক চাইলে হাঁড়ির পুরো ভাতই খেয়ে নিতে পারে অশোক। কাল কিছু জুটবে কি-না – সে-ব্যাপারে সন্দিহান অশোকের এমনই খাদ্য-নীতি। নেহাত মামা আর রঞ্জিতের কথা মাথায় রাখতে হয় বলে দুটো থালায় আগে কিছুটা করে ভাত বেড়ে সে হাঁড়ি নিয়ে বসে যায়। আশ্চর্যের কথা এত পরিমাণ উদরে ঢোকার পরেও তার পেটের উচ্চতা আধ ইঞ্চিও বাড়ে না।
এত সব সমস্যা সত্ত্বেও রঞ্জিতের মনের শান্তি যে টাল খায় না কখনও, সে যে কোম্পানির পোষ্যদের যোগ্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে – তার পিছনে নির্ভরযোগ্য মহাজন অমিয়র উপস্থিতি। একমাত্র ধনাত্মক চাকরিওলা মানুষ। মাইনের টাকার উপরেও সে বাগরি মার্কেটের ধাত চিনে নিয়ে টুকটাক ব্যাবসা করেও ভালো রোজগার করতে শিখে গেছে। তার কাছে হাত পাতলে আগে গালাগালি খেয়ে পেট ভরাতে হয়, সবশেষে হয়তো গালাগালির ক্ষতিপূরণ হিসাবেই টাকা ধার পাওয়া যায়। ধার শোধ হবে কি-না, অধমর্ণ ও উত্তমর্ণ – দু-পক্ষই কিছুদিন সংশয়ে থেকে একটু একটু করে ভুলে যেতে থাকে।
(ক্রমশ)
