অকূলের কাল। পর্ব ৩১। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

1

(গত পর্বের পর)

কাঁটার উপর হাঁটা

কাকুর ব্র্যাকেটের আর সবাই হস্টেলে ফিরে ঘুমন্ত কাকুকে দেখে হতবাক। সব জানার পর মনমরা কাকুকে চাঙা করার কোনো উপায় বের করতে পারল না কেউ। কাকুর প্রথম চিন্তা এখন থেকে সে থাকবে কোথায়? কীকরে চলবে আরও এক বছর কলকাতায় থাকার খরচ? ক্লার্কশিপ পরীক্ষার প্যানেলের কোনো খবর আসেনি। অমিয়কে ফোন করে সব জানাল। অমিয় বলল, এখন তাহলে খিদিরপুরে চলে আয়। যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বন্ধুরা খোঁজখবর নিয়ে জানল, এবছর নিয়মিত ক্লাস না করলেও পরীক্ষা দিতে অসুবিধে হবে না। সেটা ক্ষিতির পক্ষে সুখবরই। খিদিরপুর থেকে নিয়মিত বিদ্যাসাগর কলেজে আসা অসুবিধেজনক। তবে হস্টেলে তাকে সন্ধের দিকে মাঝে মাঝে আসতেই হবে। দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অন্য উপায় তো নেই। খুবই মানসিক অশান্তির মধ্যে যখন কাটাচ্ছে, তখন শান্ত এসে একটা অভিনব প্রস্তাব দিল, – পরীক্ষা শেষ হলে আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চল, কয়েকদিন গিয়ে কাটালে মনটা ভালো থাকবে।

শান্তর বাড়ি পলাশি। ওর বাবা বড় ব্যবসায়ী। নানা ধরনের ব্যাবসা আছে। ক্ষিতি যাওয়াটাই সাব্যস্ত করল। শিয়ালদায় গিয়ে ট্রেন ধরে পলাশী স্টেশনে নামা। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে ঢুকতে হয় শান্তর বাড়ি। বিরাট দোতলা বাড়ি। প্রথম দিন বাড়ি ঢুকতেই সন্ধে হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনের সন্ধেয় শান্তর মা, বাবা, শান্ত আর ক্ষিতি টেবিল চেয়ারে বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছে, টুকটাক গল্প হচ্ছে – শান্তর বাবার গায়ের রঙ কালো, শক্তপোক্ত চেহারা, মা খুবই ফরসা এবং বেশ সুন্দরী। শান্ত ওর মায়ের মতোই দেখতে। এমন সময় কাজের মহিলা এসে খবর দিল, বাইরে কারা এসেছে, দাদাকে ডাকছে। শান্ত উঠে বাইরে গেল, একটু পরেই মুখচোখ লাল করে ভেতরে এসে ক্ষিতিকে ডেকে নিয়ে গেল। দরজার বাইরে এসেই বলল, – সর্বনাশ, নেটকি আর দোলন চলে এসেছে। নেটকি মানে অঞ্জু, শান্তর প্রেমিকা। ক্ষিতি প্রমাদ গুনল, আবার ভেতরে ভেতরে একটা খুশির হাওয়াও বইতে লাগল। বাড়ি থেকে একটু দূরে এসে চারজনে কথাবার্তা শুরু করল। ঘটনা এই যে নেটকি এইচ এস পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি আর দোলন পরীক্ষাতেই বসেনি। অতএব নেটকির মনে হলো এখন বিয়ে করে নেওয়া ছাড়া আর তার গতি নেই। দোলনকেও সেটা বুঝিয়ে ছেড়েছে। এমন সময় সুবর্ণ সুযোগও এসে গেল। ঘটনাচক্রে ক্ষিতি পরীক্ষা ড্রপ করে শান্তর বাড়ি যাচ্ছে – এই খবর নেটকি শান্তর কাছেই পেয়েছিল। দুই বরকে এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। এখন দুই কনে সেখানে গিয়ে হাজির হলে বিয়ে হতে আর কতক্ষণ লাগবে!

শান্ত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে। বলল, – ক্ষিতি একটা উপায় ভাব। সন্ধে হয়ে গেছে, এখন আর ওরা বাড়ি ফিরতেও পারবে না। আজ রাতটা আমাদের বাড়িতেই ওদের রাখতে হবে। তারপর কাল সকালে আমরা কলকাতায় ফিরে যা হোক একটা কিছু করা যাবে। এখন ভেবে দেখ মা-বাবাকে কী বলা যায়।

বেশি ভাবতে হলো না ক্ষিতিকে। কল্পনা-উর্বর মস্তিস্ক তার। বলল, – আমি বাড়িতে কিছু না জানিয়ে পরীক্ষা না দিয়ে শান্তর বাড়ি চলে এসেছি। নেটকি আর দোলন আমার মাসতুতো বোন। হাওড়ায় থাকে। মেসো খুব অসুস্থ। তাই দুই মেয়েকেই পাঠিয়েছে আমার হস্টেলে খোঁজখবর নিয়ে আমাকে খুঁজে নিয়ে যেতে।

সেই গল্পই বলা হলো শান্তর বাবা-মাকে। কেবল গল্পই নয়, ক্ষিতি খুব বকাবকি করতে লাগল তাদের দুজনকে, – তোদের মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এতদূর চলে এলি দুটো মেয়ে মিলে? কী দরকার ছিল? হস্টেলে খবর পেয়েছিলি, চেষ্টা করলে শান্তর বাড়ির ফোন নম্বর পেয়ে যেতিস। ফোনে কথা বললেই তো মিটে যেত।

নেটকি সমানে ঝগড়া করে গেল ক্ষিতির সঙ্গে। কেন বাড়িতে না জানিয়ে তুই চলে এসেছিস? লজ্জা করে না বাড়ির লোককে এভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলতে!

শান্তর বাবা খুবই চতুর ও বিবেচক ব্যক্তি। কতটা কী বিশ্বাস করলেন বোঝা শক্ত। আপাতভাবে মেনে নিয়ে সবাই মিলে রাতের খাওয়াদাওয়া সারা হলো। খাওয়ার পর ওদের দুজনকে একটা ঘরে শুতেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এত কথার মধ্যে দোলনের গলার আওয়াজ প্রায় শোনাই গেল না।

পরদিন সকালে খাবার-টাবার খেয়ে চার জনে পলাশী স্টেশনে। শান্ত ক্ষিতিকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল, তুই ওদের বুঝিয়েসুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবি। এরকম করে বিয়ে হয় নাকি! তাই দেখ এর মধ্যে ওদের বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিয়েছে কি-না। আমি আর যাচ্ছি না। তোদের তিনজনের টিকিট কেটে দিয়েছি। হস্টেলে ফিরে খবর দিবি। নেটকিকে বলল, তোমরা যাও, আমি পরে বিকেলের দিকে গিয়ে পৌঁছব।

ভীষণ দোলাচলে পড়ে গেল ক্ষিতি। শুধু সে আর দোলন থাকলে একরকম। বিপদ টিপদ যা হয় হতো, বিয়ে রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ নিত, কিন্তু অঞ্জুকে নিয়ে কী করা যায়! কিছুক্ষণ পরে তাকে বলল শান্তর কথা – যে সে আসবে না আদৌ কলকাতায়। নেটকি প্রায় পাগলের মতো করতে লাগল। সে বাড়ি ফিরবে না কিছুতেই। বলে কী – আপনারা বিয়ে করে নিন ক্ষিতিদা। যেখানে থাকবেন আমাকে অন্তত কিছুদিন সঙ্গে রাখুন। তারপর আমি যা হোক একটা নিজের ব্যবস্থা করে নেব।

শুনে ক্ষিতিরও পাগল-পাগল দশা। ভেবে দেখল তার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। পকেটে দশ-বারো টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। কোথায় থাকবে, একদিনেই বিয়েটা হবে কোন অফিসে কিছুই তো জানা নেই। নিজের মনের সঙ্গে নানাবিধ যুদ্ধ করতে করতে ঠিক করল, ওদেরকে আপাতত বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো। পরে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর সুযোগ বুঝে যা করার করবে। কিন্তু সেটা বলতে গিয়ে বিপদ আরও বাড়ল। এবার দোলন বেঁকে বসল। অসম্ভব। বাড়ি থেকে পালিয়ে একরাত বাইরে আছি। এখন বাড়ি ফিরে গেলে দাদা আমাকে খুন করে ফেলবে। তাই যদি চাও তাহলে আমাকে রেখে আসবে চল বাড়িতে।

ক্ষিতি হতভম্ব। এখন তার রাগ হচ্ছে শান্তর উপরে। স্বার্থপর, বদমাশ। তোর বাড়িতে গিয়ে উঠল তোরই প্রেমিকা, সঙ্গে টেনে নিয়ে গেল আমারটাকেও। আর তুই আমার ঘাড়ে দুটোকে ফেলে দিয়ে নিজে ঘরে বসে রইলি!

ট্রেন শিয়ালদা ঢুকবে একটু পরেই। এখন রীতিমতো ভয় পাচ্ছে ক্ষিতি। নেমেই যদি দেখে তাকে ধরার জন্যে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে! চব্বিশ ঘণ্টার উপর হয়ে গেল, দোলনের বাড়ি, তার মামার বাড়ির লোক এতক্ষণ কি চুপচাপ বসে আছে?

স্টেশনে নেমে চারদিকে তাকিয়ে পুলিশ খুঁজছিল ক্ষিতি। অনেক দূরে দু-একটা দেখতে পেল, তবে মনে হলো না তারা কাউকে খুঁজছে বলে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে নেটকি আর দোলনকে একটা টেলিফোন বুথের বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকে দুটো ফোন করল। একটা হস্টেলে, একটা অমিয়কে। হস্টেলের ফোন অনুপম ধরেছিল। তাকে সবকিছু খুলে বলল। অনুপম বলল, – শালা সর্বনাশ করেছিস। শিয়ালদায় আছিস, ওখানেই থাক। আমি দেখছি কী করা যায়, শিগগিরই দেখা করছি তোর সঙ্গে।

অমিয় বলল, – কী মুশকিল! শিয়ালদায় আছিস তো! ওখানেই থাক। আমি যাচ্ছি। রঞ্জিতকেও ডেকে নেব।

(ক্রমশ)

 

Author

1 thought on “অকূলের কাল। পর্ব ৩১। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

  1. দারুণ …নেটকি অ্যাডভেঞ্চার কুইন, সাহসী ! এখনকার দিনে হায়ার সেকেন্ডারির ছাত্রী তো নিতান্ত বালিকা – বাচ্চা ! তখন একবারে পরিণত মহিলা

Leave a Reply