অকূলের কাল। পর্ব ২৯। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

যুদ্ধের আঁধার

হস্টেলের ছেলেরা এখন সকালেই খবরের কাগজ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করেছে। কাগজের প্রতি টানের জোয়ারভাটা চলে সারা বছর। বছরের প্রথমের দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উত্তাল হয়েছিল সংবাদপত্র, সেই সঙ্গে সারা দেশের মানুষ। সীমান্তে এবং বাংলাদেশের ভেতরে তোলপাড় চলছেই কিন্তু সেই খবর মানুষের কাছে গতানুগতিক বোধ হচ্ছিল। বছরের শেষ মাস শুরু হতে না হতেই আবার হেডলাইনের অক্ষরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে গেল। তিন তারিখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। উদারনৈতিক, নিরপেক্ষবাদী নেহেরুর কন্যা অন্য ধাতুতে গড়া। বুকে যেমন দুর্জয় সাহস, তেমনই আন্তর্জাতিক জোট-রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার ভরসা ছিল ভারতকে রক্তচক্ষু দেখাতে ভারত মহাসাগরের দিকে এগিয়ে আসা আমেরিকার সপ্তম সামরিক নৌবহর। সংযত ইন্দিরা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি-চুক্তি সম্পন্ন করতেই সোভিয়েতের সমরাস্ত্র ঠাসা ডুবোজাহাজ আরব সাগরের দিকে রওনা হলো। থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো বহুল প্রচারিত আমেরিকার সপ্তম নৌবহর। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া সহজ নয়। সময় নষ্ট না করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ইন্দিরা। ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম সীমান্তে সংযত এবং পূর্ব সীমান্তে তীব্র আক্রমণ হানল। বিশ্বকে দেখানো হলো ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের চাপমুক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়েছে।

দেশ যুদ্ধে জড়ালে কী হয়, তার বিন্দুবিসর্গ না জানত ক্ষিতি, না জানত দোলন। তাদের দু-তিন মাস ছাড়া ছাড়া চিড়িয়াখানায় দ্বিপ্রাহরিক ভ্রমণ অব্যাহত ছিল। পরবর্তী সেই দিনটা ছিল ছয় কি সাত তারিখ। বেরোবার সময় সব স্বাভাবিক। মামাবাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে তিন-চার ঘণ্টা ক্ষিতির সঙ্গে চিড়িয়াখানায় কাটিয়ে সন্ধে নাগাদ মামাবাড়ি পৌঁছবে, কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। ক্ষিতি হেদোর বাস স্টপে অপেক্ষা করছিল, দোলনকে দেখতে পেয়েই একটা অপেক্ষমাণ ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েছিল দুজনে। বিপদ হলো ফিরে আসার সময়। ডিসেম্বরের বেলা ছোট হয়ে গেছে তাদের অজান্তেই। চিড়িয়াখানা থেকে বেরোতেই অবাক হয়ে দেখে রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। অন্যদিন চিড়িয়াখানা থেকে বেরোলেই তাদের গা ঘেঁষে ট্যাক্সি হর্ন দেয়, আজ কোথাও কোনো ট্যাক্সি নেই। দোলন বাসে চাপতে পারে না, তাও ক্ষিতি মরিয়া হয়ে বাসের জন্য এদিক ওদিক ছুটল খানিক। এখান থেকে সরাসরি উত্তর কলকাতা যাওয়ার বাস খুবই কম। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও এমন একটা বাসের দেখা মিলল না যেটাতে ক্ষিতি দোলনকে নিয়ে উঠে পড়তে পারে।

অন্ধকারে ক্ষিতির তেমন অসুবিধে নেই। বিদ্যুৎহীন গ্রামের ছেলে সে, তারার আলোয় পথ চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু দোলন বোধ হয় জন্মাবধি একটি দিনের জন্যও কলকাতার বাইরে কাটায়নি; না না, ক্ষিতির মনে পড়ল, দোলন তাকে বলেছিল দুবার সে কলকাতার বাইরে গিয়েছিল। একবার যখন সে বালিকা মাত্র, বাড়ির সকলের সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিল তিনদিনের জন্য, আর একবার বছর কয়েক আগে পুজোর সময় তার বড় বউদির বাপের বাড়ি, সিউড়িতে গিয়ে থেকেছিল কয়েক দিন। সেই বাড়িতে দুর্গাপূজা হয় খুব ধুমধাম করে। সেই গল্প ক্ষিতিকে অনেক বার শুনতে হয়েছে। পুরীই হোক বা সিউড়ি – দুটোই শহর, গ্রামের অন্ধকার কী জিনিস, জানে না দোলন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কালো ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় যত গাড়ি চলছে সবেরই আলো লন্ঠনের আলোর চেয়েও ম্লান – সেসব আলোর মুরোদ নেই রাস্তায় প্রতিফলিত হয়। জীবনে প্রথম রাস্তাঘাট এমন দেখছে দোলন। তার মুখ শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে ধরা পড়ার ভয় বাড়ছে, আদৌ আজ বাড়ি ফিরতে পারবে কি-না, সেই চিন্তায় সে দিশেহারা হয়ে উঠল। ক্ষিতি তাকে ভরসা দিল, -চলো তো, যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ভালো করে দোলনের হাতটা জড়িয়ে নিয়ে বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করল ক্ষিতি। সে মনে মনে ভাবছে কোনোরকমে চিড়িয়াখানার এলাকাটা পেরিয়ে খালের উপর কাঠের পোলটা পেরিয়ে খানিক এগোলেই একটা বড় ট্র্যাফিক সিগন্যাল আছে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত ট্র্যাফিক পুলিশ বা সার্জেন্ট থাকে। তার সঙ্গে অল্পবয়সি মেয়ে আছে দেখলে তারা নিশ্চয় সাহায্য করবে ট্যাক্সি ধরে দিতে।

মুশকিল হয়েছে দোলনকে নিয়ে। সে অন্ধকারে পা বাড়াতেই ভয় পাচ্ছে। ক্ষিতিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। এগোতে গেলে তাকে টেনে নিয়ে এগোতে হচ্ছে। এতক্ষণ সামান্য যেটুকু আবছা আলো ছিল, পোলে উঠে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, মনে হচ্ছে আলকাতরা লেপে দেওয়া হয়েছে আকাশের গায়ে। পোলের বাঁদিকে সরু একখানা পায়ে চলার রাস্তা। রাস্তা তো নয়, কাঠের নড়বড়ে তক্তা। পা বাড়ালেই নড়ে উঠছে তক্তা। ডানপাশে পোলের রেলিঙ, বাঁপাশ উন্মুক্ত, নীচে বইছে খাল। অসাবধানে বাঁদিকে পা পড়ে গেলে খালের জলে পড়ে যেতে হবে। ক্ষিতি দোলনকে ডানদিকে সরিয়ে নিজে বাঁদিকে চলে গেল। ক্ষণে ক্ষণে ভয়ে আঁতকে উঠে ক্ষিতিকে জড়িয়ে ধরছে দোলন। তাতে সুবিধে হচ্ছে ক্ষিতির দোলনকে শক্ত করে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু পোল যেন আর শেষ হতেই চায় না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে তারা দড়ির উপর হেঁটে চলেছে।

পোলটা পেরিয়ে যেতে স্বস্তি পেল ক্ষিতি। চলার গতি বাড়ল। এখন ট্র্যাফিক পুলিশকে কীভাবে সাহায্যের কথা বলবে সেটাই ভাবছে। সে অপরিচিত কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে সংকোচে ভোগে, কিন্তু সেদিন বিপদের মাত্রা এমনই যে জিভের জড়তা কেটে গেল তার। রাস্তার মাঝখানে গোলাকৃতি ট্র্যাফিক ঘরে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটার পাশে দোলনকে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, — দাদা, আমাদের একটু সাহায্য করুন দয়া করে। সঙ্গে অল্পবয়সি মেয়ে আছে দেখছেন তো। এই ব্ল্যাক আউটে খুব ভয় পাচ্ছে। একটা ট্যাক্সি ধরে দেন যদি –

–কোথায় যাবেন আপনারা?

ক্ষিতি বলল, -হেদো।

–আচ্ছা, একপাশে দাঁড়ান, দেখছি।

খানিক পরেই পুলিশটি একটা খালি ট্যাক্সিকে দাঁড় করাল। নিজেই হাতল টেনে দরজা খুলল, তারপর ক্ষিতিকে বলল, –উঠে পড়ুন। ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, – এদের হেদোতে নামিয়ে দেবেন। বেশি ভাড়া নেবেন না।

অভিভূত ক্ষিতি দোলনকে আগে উঠিয়ে নিজে তার পাশে বসল। এমন পুলিশও তাহলে তাদের দেশে আছে যারা সাধারণ মানুষকে বিনা স্বার্থে সাহায্য করে। অথচ পুলিশের সাধারণ ছবিটা কতই জঘন্য! নকশালরা যে পুলিশ খতম অভিযান করছে, অশোকরা যাকে খতম করল সেও এরকম একজন ভালোমানুষ পুলিশ ছিল কি-না কে জানে! আবার এটাও ঠিক সরকারি নির্দেশে নকশালদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার, এমনকি নির্বিচারে হত্যাও চালাচ্ছে পুলিশ। দুই পক্ষ যেন পরস্পরের ব্যক্তিগত শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর কিছু ভাবতে পারছে না ক্ষিতি। এসব নিয়ে সে বরাবরই হতবুদ্ধি, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল – সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হবে কি কোনোদিন?

চিন্তা ছেড়ে স্বস্তি পেতে দোলনের হাতে হাত রাখল ক্ষিতি। আজকের মতো রাস্তা ফুরোল তাদের। একটু এগোলেই হেদো।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply