অকূলের কাল। পর্ব ২৮। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
প্রস্তুতির আশা
–তুমি গল্প লিখেছ? ফোন ধরতেই দোলনের প্রথম কথা। ক্ষিতি তো অবাক –তুমি জানলে কীকরে!
দোলন তার বকেয়া হাসিটা এবার উজাড় করে দিল। ক্ষিতিকে কিছুক্ষণ অন্ধকারে রেখে অবশেষে ফাঁস করল রহস্য। বলল, –বুড়ি বলল।
–বুড়ি আবার কে?
–বুড়ি হলো জলির দিদি। জলির কথা মনে আছে?
একবার বলেছিল বটে নামটা, ক্ষিতির আবছা মনে পড়ল। বলল, তোমার বড়মামার মেয়ে তো?
–বুড়ি হচ্ছে জলির উপরের দিদি, তোমার বিদ্যাসাগর কলেজের মর্নিং-এ পড়ে। কলেজ থেকে একটা পত্রিকা ছেপেছে, সেটা নিয়ে এসে আমাকে বলল, এই দ্যাখ তোর ওই ছেলেটা গল্প লিখেছে।
— ‘তোর ছেলেটা বলল! আমি কি তোমার ছেলে নাকি!
ফোনের ওপ্রান্তে আবার কুলকুল হাসি। হাসি থামতে বলল, যেমন বলেছে তেমনি বলেছি – তোমার খালি কথায় কথায় ভুল ধরা!
ক্ষিতি বলল, পড়েছ গল্পটা?
–নাঃ। আমার ধৈর্য থাকে না অতবড়ো লেখা পড়ার।
মনে মনে আশাহত ক্ষিতি জিজ্ঞেস করল, – বুড়ি পড়েছে?
–পড়েছ তো বটেই। আবার বলেছে, খুব গুণী ছেলে জুটেছে তোর কপালে, টিকলে হয়!
হাসতে হাসতেই কেটে যায় ফোন।
কল্লোল তো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেই ফার্স্ট ইয়ারেই। অজয়ও তার কোনো খোঁজ আনতে পারেনি। এখন ক্লাসমেটদের মধ্যে অজয়ই ক্ষিতির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই সে চলে আসে তার হোস্টেলে। অজয়ের ‘দেশের বাড়ি’ নদিয়া জেলার নবদ্বীপের কাছাকাছি কোনো বর্ধিষ্ণু গ্রামে। কিন্তু তার বাবা টালিগঞ্জে বাড়ি করেছেন। অজয়ের জন্ম, বড়ো হওয়া সব কলকাতাতেই। ক্ষিতি যেমন গাঁইয়া, অজয় তেমনই আদ্যন্ত শহুরে। টালিগঞ্জে বাড়ি করে উঠে যাওয়ার আগে অজয়রা শ্যামবাজারের এক বাড়িতে ভাড়া থাকত।
ভীষণ আড্ডাপ্রিয় সে। ক্ষিতির হোস্টেলে এলে একবার সে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ের এক চায়ের দোকানের পুরনো আড্ডায় ঢুকবেই। একবার ক্ষিতিকেও নিয়ে গিয়েছিল টানতে টানতে। কত যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে আলোচনা সেখানে, ক্ষিতি তো থ! সেসবের বহু কিছুই তার অজানা। সে এখনো কোনো ইংরাজি সিনেমা দেখেনি, হিন্দি দু-একটা দেখেছে কিন্তু ভালো লাগেনি। বাংলা সিনেমাই তার পছন্দ। অজয় কর, অগ্রদূত, তরুণ মজুমদার, তপন সিনহা – এদের সিনেমাই সে বেশি পছন্দ করে। আর সত্যজিৎ রায়! পথের পাঁচালি দেখে সে একেবারে অভিভূত! ছবি যেন কথা বলছে! সে তো কেঁদেকেটে একশা! তরুণ মজুমদারের নিমন্ত্রণ দেখেও একই অবস্থা হয়েছিল তার। তবে এসব সিনেমা দেখার আনন্দও তার ফিকে হয়ে গেল যেদিন রঙ্গনায় অজিতেশের নাটক ‘তিন পয়সার পালা’ দেখল । পেশাদার থিয়েটার দেখার সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। অভিনয়, কাহিনি, থেকে থেকে মজার সুরে শ্লেষভরা গান। তারপর থেকে আরও কয়েকটা নাটক দেখেছে, বিশ্বরূপায় নামকরা অভিনেতারা সব অভিনয় করেন। এগুলোই বোধহয় সঠিক অর্থে পেশাদার থিয়েটার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিন পয়সার পালার কাছে সবই ম্লান। এরকম নাটকের দল আরও আছে – শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত এদের কথাও শুনেছে কিন্তু দেখা হয়নি এখনও। এদের আড্ডায় থিয়েটার মাঝে মাঝে উঠে এলেও বেশিটাই সিনেমা নিয়ে আলোচনা, শুনে মনে হয় এরা শুধু ইংরেজি ছবিই দেখে আর সকলেই মস্ত বড়ো বোদ্ধা আর সমালোচক। এই আড্ডার কথা বাদ দিলে অজয়ের বাকি সব কিছুই পছন্দ ক্ষিতির। সে হাসি মুখে খুব সুন্দর ভঙ্গিতে কথা বলে। ক্ষিতি যখন জানতে পারল, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অজয়ের আপন বড়োমামা – তিনি তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কলকাতার রেডিওতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ পড়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছেন, তখন তার প্রতি অজয়ের প্রতি মুগ্ধতা আরও এক পরত বাড়ল।
একদিন কলেজে অজয় তাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল, – ক্ষিতি, তুমি কিন্তু এখনও পড়াশুনায় মন দিচ্ছ না। পার্ট টু ফাইনাল আর বেশি দূরে নয়।
বলেই অজয় উলটো দিকে কথা ঘুরাল। বলল, – ম্যগাজিনের গল্পটা তোমার দারুণ হয়েছে, দার্শনিকতায় ভরপুর।
অজয়ের কথাবার্তা এরকমই – উপদেশ শুনে বন্ধুটি পাছে অসন্তুষ্ট হয় – তাই সঙ্গে রাখে উপশমের প্রলেপ। তা হোক – ক্ষিতি তার মুখে গল্পের প্রশংসা খুশি হলো খুব। অজয় আসল কথায় এল সবার শেষে। বলল, — আর সি স্যার সুকিয়া স্ট্রিটে থাকেন জানো তো?
ক্ষিতি জানত না। আর সি মানে রমেশ চক্রবর্তী। ফরসা, ছোটখাটো ছিমছাম চেহারা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। সবসময় ইস্ত্রি করা সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি থাকে পরনে। পার্ট টু –তে তিনি সিক্সথ পেপার পড়াচ্ছেন – পোয়েট্রি আর প্রোজ। ক্ষিতির প্রিয় নয় এই বিষয়। তার পছন্দ একটাই, এইটথ পেপার -রেটরিক অ্যান্ড প্রোসোডি আর একটা এসে লিখতে হয়। এসেটা তার তেমন পছন্দ না হলেও অলংকার আর ছন্দবিচার তার আগ্রহের বিষয়।
অজয় বলল আর সি-র বাড়ি যাই চলো। ছাত্ররা কেউ তার বাড়ি গেলে অখুশি হন না বলে শুনেছি। খুব হেল্প করেন, সব পেপারেই। তেমন বুঝলে স্যারকে টিউশন ফী দিয়ে পড়ব, দুজনে মিলে ভাগ করে দিলে খুব বেশি হবে না বোধহয়।
এক রবিবার সুকিয়া স্ট্রিটে আর সি-র বাড়ি গিয়ে হাজির হল দুজনে। আরসি নিজেই দরজা খুলে তার বসার ঘরে বসালেন। অজয় কথা শুরু করল। ক্ষিতির অস্বস্তি হচ্ছিল, সে স্যারের আলমারি-ভর্তি বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। অজয় কিন্তু বিনা সংকোচে তাদের প্রার্থনা নিবেদন করে ফেলল। স্যার বললেন, – বেশ তো। সপ্তায় দুদিন – বুধবার সন্ধায় আর রবিবার সকালে এস দুজনে। যা বোঝার বুঝিয়ে দেব, প্রয়োজন মত নোট্সও দিয়ে দেব।
এর পরেই আসল কথা, অজয় জিজ্ঞেস করল, – কত দিতে হবে স্যার?
স্যার হাসলেন। বললেন, – কিছু দিতে হবে না।
ফেরার পথে অজয় বলছিল, – দেখলে তো ক্ষিতি, তোমাকে বলেছিলাম আর সি খুব ভালো মানুষ।
ক্ষিতির গলায় বাষ্প জমেছিল।
(ক্রমশ)
