অকূলের কাল। পর্ব ২৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

খুশির গায়ে দাগ

টাউন হলে একদিন ক্ষিতি মনোজিৎদাকে সঙ্গে নিয়ে গেল। খোঁজখবর করে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার ট্যাবুলেশন শিট যে-কেরানিবাবুর হেফাজতে আছে, তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইল নিজেদের প্রাপ্ত নম্বর। তিনি বললেন, সেটা বলা যাবে না। তবে প্যানেলে আপনারা কী অবস্থায় আছেন, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা আছে সেটার একটা আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে। আপনাদের রোল নম্বর একটা কাগজে লিখে দিয়ে রেখে যান, আধ ঘণ্টা পরে আসবেন। তখন বলে দেওয়া যাবে।

ক্ষিতি করুণ মুখে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আমার এই বন্ধুটির প্যানেলে নাম নেই। কিন্ত তার নম্বর ভালোই পাওয়ার কথা। কেন নেই দেখে যদি আমাদের একটু বলে দেন তাহলে খুবই ভালো হয়।

কেরানিবাবু একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, দেখুন প্যানেলে নাম থাকলে তার পজিশন খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগে না, কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে কিছু জানতে হলে আমাকে অনেক কাগজপত্র ঘাঁটতে হবে, বহু সময় যাবে।

মনোজিৎদা এই সময়েই পকেট থেকে এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট বের করে, তার সিল খুলে একটা বের করে নিজের ঠোঁটে ঝুলিয়ে বাকি প্যাকেটটা তাঁর টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করে, – চলে?

আমরা আগেই দেখে নিয়েছিলাম, কেরানিবাবুর টেবিলে একটি ছাইদানি বিরাজ করছে। তিনি  প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করতেই মনোজিৎদা পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটি কাঠি জ্বালিয়ে প্রথমে তার সিগারেট ধরিয়ে দেয়, পরে নিজেরটা জ্বালায়। তারপর প্যাকেটটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, আপনার কাছেই থাক, আমরা কালেভদ্রে দু-একটা খাই। এবার দেখা গেল ভদ্রলোকের কপালের বিরক্তির চিহ্ন মুঝে গেছে, বললেন, – এক কাজ করুন, আধ ঘণ্টা নয় এক ঘণ্টা পরে আসুন, আমি দেখে রাখছি।

ঘণ্টাখানেক এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে গিয়ে যখন তারা দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে তখন ভদ্রলোকের দৃষ্টিই যেন বদলে গেছে। তাঁর বিপরীত দিকে একটা চেয়ার ছিল, সেটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মনোজিৎদাকে বললেন, বসুন বসুন। ক্ষিতিকে একটা দূরের টুল দেখিয়ে বললেন, ওইটা টেনে এনে বসুন। তারপর মনোজিৎদাকে বললেন, আপনি তো মশাই সাংঘাতিক ট্যালেন্টেড, কেরানির চাকরি আপনার জন্যে নয়। বিসিএস দিন, জেনারেল পেপারে একটা কোয়ালিফাইং মার্কস থাকে, ম্যাথটায় আপনার দুর্বলতা আছে দেখছি, সেজন্যে এই প্যানেলে নাম ওঠেনি। বিসিএসে ভালো করে ম্যাথ প্র্যাকটিস করে নেবেন, অফিসারের চাকরি আপনার বাঁধা। এই পরীক্ষায় তো দুটো পেপারে আপনি হাইয়েস্ট পেয়েছেন। এগ্রিগেটেও অনেক উপরে আপনার জায়গা। ওই একটা পেপারে আটকে না গেলে এটা তো হতোই।

মনোজিৎদা বলল, – আরে আপনি তো আমার কথাতেই সাতকাহন হচ্ছেন। আমার এই বন্ধুটির কী অবস্থা, চাকরিটা হচ্ছে তো?

একটু গম্ভীর হলেন তিনি, বললেন, – দেখুন সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ভ্যাকান্ট পোস্ট কতগুলো ফিল-আপ করা হবে, সে ব্যাপারে আমরা কিচ্ছু জানি না। ওটা অন্য বিভাগের কাজ। তবে প্যানেলে ওর যেখানে নাম, আন্দাজে বলতে পারি চাকরি পাওয়ায় চান্স ধরুন থার্টি পারসেন্ট।

ক্ষিতি একটু দমে গেল। দুদিন আগেই সে দোলনকে জানিয়ে দিয়েছে, চাকরি এই হলো বলে। সে যেন বিয়ে রেজিস্ট্রি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। পার্ট টু ফাইনাল পরীক্ষাটার জন্যে যেটুকু অপেক্ষা! আর দশ মাস বড়োজোর। দোলন উৎসাহে উথলে উঠেছে যেন, বলেছে, – গণেশকে পাঠাব দু-একদিন পরে। তুমি ওকে চাকরির জন্যে তোমার নাম ছাপা হয়েছে যে খবরের কাগজে, সেটা দেখিয়ে দিয়ো তো।

নাম নয়, রোল নম্বর – সেটা আর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেনি ক্ষিতি। ভেবে নিয়েছে, গণেশকে বুঝিয়ে বললেই হবে। কিন্তু এখন দেখছে সেটা সত্য না হতে পারে। যাকগে আপাতত এই মিথ্যা, না ঠিক মিথ্যা নয় –  শতকরা সত্তর ভাগ মিথ্যাটাই চালিয়ে যেতে হবে তাকে।

আলিপুর পুলিশ কোর্টে অশোকের মামলায় সেদিন আর যেতে পারেনি ক্ষিতি। কিন্তু খবর পেয়েছে, তাদের উকিলের ধারণাটা একেবারে ঠিক ছিল। সেদিনই জজসাহেব মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। রায়ের কপি জেলার পেলেই তারা বেকসুর খালাস হয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসবে। বেচারা দিলীপ নিশ্চয় এখন জেল ভেঙে বেরোবার কথা ভাবছে না।

কোম্পানি বলেছেন, অশোককে আর কলকাতায় রাখবেন না। সোজা পাঠিয়ে দেবেন নন্দীগ্রামে তার গৌরীশঙ্কর মামুর কাছে। গৌরীশঙ্কর আসলে অশোকের নিজের মামা নন, তিনি ক্ষিতিরই খুড়তুতো বড়দা, তার কাকার বড় ছেলে। তিনি নন্দীগ্রাম কলেজের অধ্যাপক, অঙ্কের হেড। সম্প্রতি বোধহয় ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কোম্পানি। তিনি বলেছেন, অশোককে নতুন করে ফার্স্ট ইয়ারেই ভর্তি করে নেবেন। হস্টেলেই থাকবে। ওই একই হস্টেলে গৌরীশঙ্কর নিজেও থাকেন, পরিবার থাকে গ্রামের বাড়িতে। কাজেই অশোকের দিকে নজর রাখতে তাঁর অসুবিধে হবে না।

সেই যে দুই-এক দিন পরে গণেশ তাঁর সঙ্গে দেখা করবে বলে কথা হয়েছিল দোলনের সঙ্গে, সেটা হলো এক রবিবারের বিকেলে হেদো পার্কে। ক্ষিতি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল ক্লার্কশিপ পরীক্ষার প্যানেলের পেপার কাটিং আর তার অ্যাডমিট কার্ড। দেখেশুনে গণেশ সন্তুষ্টই হয়েছে মনে হলো। একবার শুধু জিজ্ঞেস করল, ক্ষিতির মনে হলো দায়সারাভাবেই, যে রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে পিসিকে নিয়ে সে থাকবে কোথায়। ক্ষিতি তখনও অতদূর ভাবেইনি। পরিকল্পনা করে এগোনো তার ধাতেই নেই। একটু ভেবে নিয়ে বলল, – যা শুনছি, চাকরিটা বোধ হয় কলকাতাতেই, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে হওয়ার চান্স বেশি। তাহলে কাছাকাছি একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে। তবে সেসব তো এখন দেরি আছে। আমার ফাইনাল পরীক্ষাটা আগে শেষ হোক – তা ধরো এখনও প্রায় এক বছর।

চাকরির ব্যাপারে ক্ষিতি নিজেই এখন খুব সংশয়ে। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে হস্টেলে ফিরে এল।

পরের দিন খবরের কাগজে হেডলাইন – অজয় মুখার্জি পদত্যাগ করেছেন, রাজ্যপালের কাছে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সবে রাজ্যপাল হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন এ এল ডায়াস। জল্পনা চলছে, এবার থেকে নাকি নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন আরও কঠোর হবে। ক্ষিতি ভাবল, এখন যেটা চলছে সেটা কি নরম নাকি!

যা দাঁড়িয়েছে, ভালো খবর আর তত ভালো নেই। একটাই নির্ভেজাল খুশির খবর পেল পরদিন কলেজে গিয়ে। কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে ক্ষিতির গল্প এবং কবিতা – দুটিই প্রকাশিত হয়েছে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply