অকূলের কাল। পর্ব ২২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
সম–বিষম
বিমল পানিগ্রাহী হস্টেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার। থাকেন ছাদের লাগোয়া দক্ষিণ প্রান্তের বড় ঘরটিতে। স্কটিশে তিনি দর্শনের অধ্যাপক। নিজেও যথেষ্ট দর্শনধারী। টুকটুকে ফরসা, মাথায় কোঁকড়া চুল, নিখুঁত নাক চোখ মুখ, পুরাণে আঁকা দেবতার ছবি যেন। স্কটিশের ছেলেরা বলে, তিনি ক্লাসে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে হলেও লজ্জায় লাল হয়ে যান। কণ্ঠস্বর খুবই সুরেলা, ক্লাসে আধখোলা চোখে লেকচার দিতে দিতে আচমকাই চোখে আলোর ঝলক খেয়ে চমকে চমকে ওঠেন। তাঁর রূপমুগ্ধ বহু ছাত্রী সুবিধে করতে না পেরে তাদের ভ্যানিটি ব্যাগের ছোট্ট আয়নায় সূর্যের রশ্মি ধরে ছুড়ে মারে অধ্যাপকের চোখে। পানিগ্রাহীর ক্লাস মানেই অনন্ত বিনোদন।
হস্টেলে তিনি আছেন বলে মনেই হয় না। নিজের ঘরে একবার ঢুকে গেলেই তাঁর অস্তিত্ব যেন মুছে যায়। তাঁর খাবার আর টিফিন তাঁর ঘরেই দিয়ে আসে মাধোদা কিংবা ব্যোমকেশের চ্যালাটি। কেবল তাঁর গ্রামতুতো ভাই অমলকে মাঝে মাঝে দেখা যায় তাঁর ঘরে ঢুকতে।
এক সন্ধেয় কাকুর ব্র্যাকেট ছাদে তাস পিটচ্ছে, এমন সময় অমল প্রায় দৌড়ে অধ্যাপকের ঘর থেকে বের হলো। তার চোখমুখ লাল, একটাও কথা না বলে সে দ্রুত পায়ে নীচে নেমে গেল। এই ঘটনা তলে তলে অনেকদূর গড়িয়ে গেল। কানাঘুষায় শোনা গেল পানিগ্রাহী নাকি হোমো। অমল কাকে কী বলেছে কিছু জানা গেল না। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই অধ্যাপক নিঃশব্দে হস্টেল ছেড়ে চলে গেলেন।
হোমোদের ব্যাপারটা খুবই আজব লাগে ক্ষিতির। স্কুলের বোর্ডিঙয়ে থাকতে একটা বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। বাঁশরীদা ছিল স্কুলের দারোয়ান। বিল্ডিঙয়ের সমস্ত গেট, দরজার চাবি ছিল তারই দায়িত্বে। তার ডিউটিই ছিল সময়মত তালা লাগানো এবং খোলা। এমনিতে বেশ মধুর স্বভাবের শান্তশিষ্ট, গুণী মানুষটি। তবলা বাজানোর নেশা ছিল। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই তাকে সুনজরে দেখত। রাত্রে সে একতলার ল্যাবরটরি ঘরে থাকত। প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে তার তবলাবাদনের আওয়াজ স্কুলের দুই বিল্ডিঙয়ের মাঝে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলত।
গরমের দিনে বাঁশরীদা একতলার বারান্দায় বিছানা পেতে ঘুমায়। সেসময় বোর্ডিঙয়ের অনেক ছেলেও দুই বিল্ডিঙয়ের মাঝখানের এক প্রান্তে বিশাল হলঘরের ছাদে ঘুমোতে চলে আসে। ক্ষিতিও তাদের একজন। এক রাতে হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। মনে হলো কেউ যেন তার পাছায় হাত বুলোচ্ছে। সেই স্পর্শ এমনই যে কার্যকারণ বুঝে ওঠার আগেই তারা সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। সে তড়াক করে উঠে বসেই অবাক হয়ে দেখে তার বিছানায় গা ঘেঁসে বসে আছে বাঁশরীদা। কিছু না ভেবেই অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষিতি সপাটে চড় মারল তার গালে। মাথা নিচু হয়ে গেল বাঁশরীদার। মাথা নিচু করেই ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। মাথা-নিচু বাঁশরীদাকে দেখে কি সামান্যও দুঃখ হয়েছিল ক্ষিতির মনে? মনে তো হয় না। কারণ বাঁশরীদার সেই আচরণ আজ পর্যন্ত সে গোপন রাখলেও সেই থেকে একটা ঘিনঘিনে বিতৃষ্ণা এসে গেছে এই অস্বাভাবিক স্বভাবের মানুষদের প্রতি।
অধ্যাপক পানিগ্রাহীর ঘটনার পর থেকেই দ্রুত পরপর কয়েকটা পরিবর্তন ঘটে গেল হস্টেল-প্রশাসনে। এক তো বেশ কিছুদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের পদ খালি পড়ে রইল। তারপর শোনা গেল সুপার সচ্চিদানন্দ ঘোষ স্কটিশ ছেড়ে অন্য এক কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে চলে যাচ্ছেন। খবর জানতে পেরেই অনাথদা একদিন দলবল নিয়ে অফিস ঘরে গিয়ে অধ্যাপক ঘোষকে বিচ্ছিরিভাবে অপমান করল। সেই দলবলের বলই ছিল কাকুর ব্র্যাকেট। অনাথদা তাদের বুঝিয়েছিল সুপার নানা বেনিয়ম চালিয়ে আসছেন বহুদিন ধরে। তাঁকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। তা যদি হয়, তাহলে তাঁর চলে যাওয়ার সময়টাতেই সেই শিক্ষাটা তাঁকে কেন দিতে হবে – এই প্রশ্নটা বালখিল্য স্বভাবের কাকুর ব্র্যাকেটের কারুর মনে জাগেনি। তারা হাঁ হয়ে অধ্যাপক ঘোষের সঙ্গে তর্কবিতর্কে, শাসানি-প্রতিশাসানিতে চোস্ত ইংরাজিতে অনাথদার সওয়াল-জবাব শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল। এর বেশ কিছুদিন পরে অবশ্য ব্র্যাকেটের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয়, যখন তারা জানতে পারে অনাথদার এই অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তার একটি অন্যায় আবদার অধ্যাপক অতীতে পূরণ না করায় তার প্রতিশোধ নেওয়া। তারপর থেকেই কাকুর ব্র্যাকেট অনাথদার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করে।
অধ্যাপক ঘোষের ঘটনার জেরে তিনি চলে যাওয়ার পর আর কোনো অধ্যাপকই এই হস্টেলের সুপার হয়ে আসতে চাইলেন না। মাসখানেক অভিভাবকহীন হয়ে থাকার পর কলেজের এক করণিককে পাঠানো হলো হস্টেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের দায়িত্ব দিয়ে। বছর চল্লিশের রতন পান হস্টেলে এসেই দোতলায় সুপারের কোয়ার্টারটি দখল করলেন। তখনই বোঝা গেল, এই হস্টেলের সুপারের পদ খালিই পড়ে থাকবে এরপর থেকে। রতনবাবু হিসেবি লোক। ছাত্রদের ব্যাপারে মাথা না গলিয়ে হস্টেলের খাতাপত্রের হিসেব রাখা আর অনাথদাকে সমঝে চলার মধ্যেই নিজের ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখলেন।
পরীক্ষা শিয়রে। রাত্রে ঘুমোবার আগে প্রতিজ্ঞা করে কাকু, কাল সকাল থেকেই রুটিন করে পড়া শুরু করবে। কিছুতেই সেটা ঠিকমতো হয়ে উঠছে না। শান্ত এখন অনেকটাই ক্ষিতির ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে প্রেমতুতো সম্পর্কের কারণে। সামনেই সরস্বতী পুজো। ঠিক হয়েছে হস্টেল আর পিছনের বাড়ির তিন যুগলে মিলে পুজোর সারাদিন ট্যাক্সিতে করে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো হবে। ওইদিন বাড়ির মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়ার রেওয়াজ। কাজেই কোনো পক্ষ থেকেই বাধা নেই।
সকাল বেলায় চান সেরে যথাসম্ভব সাজুগুজু করে হস্টেলের সামনে থেকেই ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল তিন জোড়া পাত্রপাত্রী। পিছনের সিটে শান্ত-নেটকি আর কিষাণ-ভেলি, সামনে ড্রাইভারের পাশে ক্ষিতি-দোলন। আরোহী বেশি, জায়গা কম। বসতে গিয়ে এক জোড়ার চারটে পা তিনটে পায়ে পরিণত হয়ে গেছে। ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দোলনের ডান পা ক্ষিতির বাঁ পায়ের উপর উঠে বসেছে। পিছনেও একই দৃশ্য। ক্ষিতির বাঁ বগলের খাপে দোলনের ডানদিকের শঙ্খ। শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ চলছে। দোলনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সুখের আবেশে তার গাল এলিয়ে পড়েছে ক্ষিতির গালে। চকিতে একবার পিছনে ঘাড় ঘোরায় ক্ষিতি। অবাক বিস্ময়ে দেখে সেখানে সামনের মতো নিষ্ক্রিয় স্পর্শসুখ নয়, চারজনের চারটি হাতই রীতিমতো সক্রিয়। সেদিন যে দোলন বলেছিল – ওরা কী-সব করে তোমায় বলতে পারব না – সেই কী-সব পরিষ্কার হয়ে গেল ক্ষিতির কাছে। সলজ্জ সংকোচে সে ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে, তার সামনের আয়নায় পিছনের দৃশ্য ধরা পড়া সত্ত্বেও সে নির্বিকার। কে জানে হয়তো ট্যাক্সি চালাতে চালাতে এইসব দৃশ্যে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
একটা ধাপ অতিক্রম করল দোলন-ক্ষিতির প্রেম। আর সেই সঙ্গে ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়ে তারা ধরা পড়ল দোলনের ভাইপোর চোখে। তার বড়দার বড় ছেলে এই সমর দোলনেরই সমবয়সি। দোলন খুব একটা ভয় পেল বলে মনে হলো না। কিন্তু এই নিয়ে কথা বলার সময় আর ছিল না। আশংকায় থাকল ক্ষিতি।
(ক্রমশ)
