অকূলের কাল। পর্ব ১৯। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

অভীকের গৃধ্রকৌশল
শুক্রবার আর অসময়ে নয়, যথাসময়েই ক্ষিতির জন্য ডেকে উঠল ফোন। তৈরিই ছিল সে। কিন্তু আজ আর সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে নামল না। শান্তর নাম করে যে-ধোঁয়াশা দোলন ভাসিয়ে দিয়েছিল সেদিন, তা পরিষ্কার করার জন্য মনে মনে সে যতই উদগ্রীব থাক, আজ নিজে থেকে কিছুতেই জানতে চাইবে না সে। ফোন ধরে বাহাদুর যখন তার নাম হাঁকল, তখন সে দোতলার সিঁড়ি ভাঙছে। তার কোনো সাড়া না পাওয়ায় বাহাদুর আর একবার যখন হাঁক দিচ্ছে, ক্ষিতি ততক্ষণে নেমে এসেছে।
রিসিভার কানে নিয়ে উদাস গাম্ভীর্যে সে বলে, – বলো।
উত্তরে খিলখিল হাসি। তারপরেই কলকল করে বন্যার তোড়ে বলে চলে শান্ত-কাহিনি।
–নেটকিটা কী শয়তান জানো তো – সেই কবে থেকে, আমাদের কথা শুরু হওয়ার আগে থেকেই তোমাদের শান্তর সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও ঘুণাক্ষরে টের পেতে দেয়নি। সপ্তাহে তিন দিন নেটকি ভর দুপুরে স্কুল থেকে পালিয়ে আসত। শান্তও একই সময়ে কলেজ থেকে হস্টেলে চলে আসত। প্রথমে আমাদের মতোই ছাদ থেকে ইশারা ইঙ্গিতে কথা হয়। মাসখানেক পর থেকেই দুজনে মিলে বাইরে দেখা করতে শুরু করে। আমরা তো বেশি বেরোতেই পারি না, বলো। ওরা দু-এক দিন পর পরই ঘুরতে বেরোয়। আমাদের বেলায় দেখলে তো, ভেলিকে সুদ্দু সঙ্গে নিয়ে সব কিছু করাল, আর নিজের বেলায় কাকপক্ষী টের পেল না।
শুনতে শুনতে ক্ষিতির মাথা পালকের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে। কী বোকা – শুধু বোকা নয়, হিংসুটেও কম নয় তো সে। বোকা যে, সেটা সে আগে থেকেই জানে। কিন্তু নিজেকে হিংসুটে বলে বোঝেনি তো কখনও। সত্যি, মানুষ নিজেকেও যে কত কম জানে! বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে মানুষের এক একটা রূপ প্রকাশিত হয়। শান্তর নাম দোলনের মুখে শুনেই কিনা সে মন খারাপ করে সিদ্ধি গিলে একেবারে স্বর্গ-নরক দর্শন করে ফেলল।
দোলন বলে চলেছে – সেদিন বুড়ির চোখে ধরা পড়ে গেছে নেটকি। কলেজ থেকে ফেরার সময় হেদোতে ট্রাম থেকে সবে নেমেছে বুড়ি। দেখে, উল্টো দিকে একটা ট্যাক্সিতে উঠছে শান্ত আর নেটকি। অতি চালাকির ফল!
ক্ষিতি বলল, – বুড়ি কে?
দোলন বলে, – ও হো – বুড়ির কথা বলা হয়নি তোমাকে। বুড়ি বড়মামার মেয়ে। তোমার কলেজেই পড়ে। বিদ্যাসাগর মর্নিং। বাড়িতে সব বলে দিয়েছে বুড়ি। ভালমতো পিটাই খেয়েছে নেটকি। তারপরে আমাদের কাছে মুখ খুলেছে। জানো তো ওরা খুব বদমাশ, আমাদের মতো না। কী সব করে দুজনে –
–কী করে?
এবার শুধুই হাসি। একটু পরে হাসি থামিয়ে বলে, –সে আমি তোমাকে বলতে পারব না।
ক্ষিতি বলে, – হস্টেল থেকে এক্সকারসনে রাজগির যাওয়া হচ্ছে। কাল থেকে তিন দিন থাকব না। কী আনব তোমার জন্যে?
–রাজগির তো – চুড়ি আনবে, কাচের চুড়ি।
অনুপম আর অভীকের উৎসাহে রাজগির ভ্রমণের ব্যবস্থা হয়েছে। দু-একজনকে বাদ দিলে সবাই যাচ্ছে। খুব হইচই চলছে। এক রাতে যাওয়া, ওখানে দুটো দিন আর একটা রাত থাকা, পরের রাতে ট্রেন ধরে ফেরা। শচি মহা উৎসাহে গাঁজার পুরিয়ার হিসাব করছে। খাওয়া কী জুটবে না জুটবে কে জানে, এই কটা দিন গাঁজার উপরেই ভরসা।
ট্রেনে ওঠার পর থেকেই শুরু হলো সিগারেটের খোলে গাঁজা ভরে টানা। এমনই সংক্রামক হয়ে উঠল সকলের উৎসাহ যে অভীকও তার টান থেকে ছাড় পেল না। সারা রাত ধরে শচির কীর্তন, দোতলার প্রণবদার রবীন্দ্রগান পালা করে চলল। তারই মাঝে গাঁজায় বুঁদ হয়ে মনোজিৎদা, মলয় আর কাকুর জগজ্জীবন নিয়ে গভীর দার্শনিক আলোচনা। সকাল নটায় রাজগিরে গিয়ে যখন নামল সবাই, তখন সকলেরই পেট চুঁইচুঁই করছে। অনুপম আর অভীক শলাপরামর্শ করে ঠিক করল, নটা যখন বেজেই গেছে জলখাবারে পয়সা খরচ করার দরকার নেই। একেবারে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেওয়াই ভালো। স্টেশনের বাইরেই সার সার খাবার হোটেল। ওরা দুজনে ঘুরে ঘুরে একটা পছন্দ করল। নিরামিষ থালি, ডাল-ভাত-ভাজি-সবজি যত খুশি খাও, মিল পিছু বারো আনা। কিন্তু দশটার আগে খাবার পাওয়া যাবে না। তা-ই সই। চল্লিশ জন খদ্দের পেয়ে মহা উৎসাহে হোটেলওয়ালা রাঁধুনির সঙ্গে নিজেও রান্নায় হাত লাগাল।
রান্না তো হলো, খাওয়ার জায়গায় কোনোমতে পনের জন বসতে পারবে। সবাই আগে বসতে চায়, ঠেলাঠেলি করে বসেও গিয়েছিল। কিন্তু অনুপম তাদের মধ্য থেকে প্রদীপ আর দিনুকে তুলে এনে তাদের বদলে অসিত আর আগুয়ানকে বসিয়ে দিল। যারা জায়গা পেল না হতাশ হয়ে ফের গাঁজায় বুঁদ হয়ে গেল। তারপরেই বিপত্তির শুরু। একে তো সারা রাত উপোষ, তার উপর গাঁজার মহিমা, পনের জনের খাওয়া শেষই হতে চায় না। হোটেলওয়ালার মাথায় হাত, চল্লিশ জনের চাউল পনের জনেই সাবাড় করে দিল। সে হাত জোড় করে অনুপমকে বলল, মাফ করো ভাইলোগ, হামি আপনকো আউর খিলানে নেহি সকতে।
কাকু এতক্ষণে বুঝল অনুপমের বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টি – ভাগ্যিস অসিত আর আগুয়ানকে প্রথমেই বসিয়ে দিয়েছিল! তাদের খাদ্যবহরের খবর কীভাবে যেন সব হোটেলেই চারিয়ে গেল, এবার আর কোনো হোটেলই তাদের মিল সিস্টেমে খেতে দিতে চায় না। শেষ পর্যন্ত তিন-চারটা হোটেলে বাকি পঁচিশ জন ভাগাভাগি করে পাইস সিস্টেমে খাওয়া সারল। একটা ধরমশালায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। গাঁজার স্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় বাকি সময়টায় আর কোনো বিপত্তি ঘটেনি। শচিকে দিয়ে পছন্দ করিয়ে কাকু চুড়ি কিনল দোলনের জন্য। একেবারে শেষ দিনের সন্ধেবেলায় গৃধ্রকূট পাহাড়ে রীতিমতো নাটক। দুপুরবেলায় সেখানে পৌঁছে আগে পাহাড়ের নীচে উষ্ণ প্রস্রবণে সবাই মিলে খানিক হুটোপুটি করে নিল। তারপর বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে বুদ্ধের আসন ছুঁয়ে লাফাতে লাফাতে নামা হল। তখন সন্ধে হয় হয়। ফেরার ট্রেন রাত বারোটায়। ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে আসা হয়েছে ধরমশালা থেকে। এখান থেকে এক্কা ভাড়া করে সোজা স্টেশনে যাওয়া হবে। এত তাড়াতাড়ি স্টেশনে গিয়ে কী লাভ! অতএব কাকুর মাথায় ভূত চাপল। সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে তেমন মজা হয়নি। ঝোপঝাড়ে ঘেরা বেপথ দিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে পাহাড়ের মাথায় চড়লে হয় না?
প্রদীপ আর দিনু এমন অভিযানে পা বাড়িয়েই থাকে। অনুপম মৃদু আপত্তি জানাল। অন্ধকার হয়ে আসছে। জন্তু-জানোয়ার, সাপখোপ থাকতে পারে। অভীক তো রেগে টঙ হয়ে গেল। পাগলামি হচ্ছে! পা বাড়িয়ে দ্যাখ। ঠ্যাঙ যদি না ভাঙ্গি!
কাকু গ্রাহ্য করল না। কথাটি না বলে এগিয়ে গেল। তার দুপাশে দিনু আর প্রদীপ। অনুপম দোনোমনা করে তাদের পিছু নিল।
আবছা আলোয় ঝোপঝাড়ের ফাঁকে পাথরের খাঁজে পা রেখে উপরের দিকে উঠতে বেশ মজা লাগছে তিন জনের। অনুপম একটু সাবধানী। খুঁজেপেতে গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে নিয়ে সেটাকে লাঠির মত ব্যবহার করছে। ঝোপঝাড় ঠুকতে ঠুকতে এগোচ্ছে। সে পিছিয়ে পড়লে কাকুরা দাঁড়িয়ে গিয়ে খানিক অপেক্ষা করছে। বেশ কিছুটা ওঠার পর সামনের একটা ঝোপে একটা সরসরে আওয়াজ। মনে হলো কিছু একটা দ্রুতবেগে সামনের ঝোপ থেকে অন্য ঝোপের দিকে চলে গেল। কাকু ছিল সামনে। সে থমকে দাঁড়াল। এবার একটু ভয় পেল। এই পাহাড়ে কী কী সব জন্তুজানোয়ার আছে, কিছুই তার জানা নেই। সে সাপের কথাই ভেবেছিল কিন্তু সাপের ভয় তার নেই। সে জানে, এখন তারা শীতঘুমে আছে। কিন্তু বড় জানোয়ারের কথা মাথায় আসেনি। ভালুক থাকে যদি! দিনুকে বলল, – আর না এগোনই ভালো। চল ফিরি এবার।
অনুপম যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, – আগেই বলেছিলাম না!
নেমে আসতেই সকলের আক্কেল গুড়ুম! একটা পুলিশ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে অরূপ, শচি, আরও কয়েকজন। পুলিশটা কাকুর সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, – কিঁউ চঢ়া পাহাড় পর আন্ধেরি মে? মানা হ্যায় জানতা নেহি? চলো মেরা সাথ থানে মে।
নিমেষে কাকুর সব সাহস উধাও। তার বুক কাঁপছে, পা-ও। দিনু আর প্রদীপের মুখও শুকিয়ে গেছে। অনুপমই একমাত্র উদাসীন। – লক আপে যদি ভরে দেয়! ভাবার শক্তিও যেন লোপ পেয়ে গেছে কাকুর।
ততক্ষণে অভীক এগিয়ে এসে রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। পুলিশটাকে বলল, — ছোড় দিজিয়ে জি, ইয়ে সব বুরবক লেড়কা হ্যায়। কুছ সমঝতেই নেহি। চলিয়ে থোড়া উধার। ম্যায় বাতচিত করতা হুঁ আপকো সাথ। পুলিশটাকে নিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল অভীক। দু-একটা কী কথা বলল। তারপরেই দেখা গেল, পুলিশটা চলে গেল। অভীক ফিরে এল ঠিক দেবানন্দের ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে। এসে বলল, – বাঁচিয়ে দিলাম। শালা কাকুর গোঁয়ার্তুমিতে এক্সকারসনটাই পণ্ড হতে বসেছিল।
কাকুর মাথা নিচু। ভেতরে অবশ্য শান্তি ফিরে এসেছে। ফেরার পথে শচি ফাঁস করল অভীকের হিরোগিরি। তার কথা না শুনে তারা উঠে গেল দেখে সে উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে ডিউটিতে থাকা পুলিশটাকে অনেক করে রাজি করায় সে যাতে তার গোঁয়ার বন্ধুগুলোকে একটু ভয় দেখায়। কী-জানি পুলিশটা মজা পেয়েই হয়তো এমন চমৎকার অভিনয় করে গেল।
(ক্রমশ)