অকূলের কাল। পর্ব ১৫। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

অভীকের প্রেম ও ক্রীড়াদর্শন

কী হয়েছে কে জানে, অভীক বেশ কিছুদিন ধরে বালিগঞ্জ যাচ্ছে না। কলেজ থেকে সটান হস্টেলে ফিরছে। পড়াশুনা বাদ দিলে তার সক্রিয়তা কেবল হস্টেল কমিটির স্পোর্টস সেক্রেটারির কর্তব্য পালনে। কর্তব্য তো ঘোড়ার ডিম, ঢাল নাই তরোয়াল নাই নিধিরাম সর্দার! ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা নেই, খেলা বলতে মানিকতলার খালপাড়ের বারোমেসে কাদা মাঠে ফুটবল। প্রদীপের খুব আক্ষেপ, ক্রিকেট খেলার জন্যে তাকে ময়দানে ছুটতে হয় ভোরবেলায়। হস্টেলে যে একটু প্র্যাকটিস করবে তার উপায় নেই। প্রদীপ বেশ ভাল স্পিনার, ময়দানের একটা বি ডিভিশন ক্লাবে খেলে।

অভীক অগত্যা ফুটবল নিয়েই মাতামাতি করছে। স্পোর্টস ফান্ড থেকে বেশ কিছু  জার্সি, বুট আর সিন গার্ড কিনেছে। হলে কী হবে, সেসব ব্যবহার করার প্লেয়ার খুঁজে পাওয়া দায়। বেশির ভাগই তো গাঁয়ের ছেলে। দু-একজনেরই হয়তো বুট পরে খেলার অভ্যাস আছে। বাকি সব খালি পায়েই স্বচ্ছন্দ। সিনগার্ড তো চোখেই দেখেনি। অভীক পণ করে বসে আছে সকলকেই বুট সিনগার্ড পরেই খেলতে হবে।

কাকু পড়েছে ফ্যাসাদে। কোন ছেলেবেলা থেকেই সে খালি পায়ে ফুটবল পিটিয়ে আসছে। তার ধারণা সে ভালোই খেলে। কিন্তু না গ্রামে, না গড়বেতা স্কুলে বড় ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছে। যে অঞ্চলে তার গ্রাম, সেখানে ফুটবলের ভালো ভালো টিম আছে। সমর্থক পৃষ্ঠপোষকেরও অভাব নেই। চাষের সময়টা বাদ দিলে বাকি সময়টায় প্রতিযোগিতা লেগেই থেকে। সেসব প্রতিযোগিতায় খালিপদ প্লেয়ারই বেশি। কিন্তু বড় ম্যাচে চান্স পাওয়ার মতো বড়ো হওয়ার আগেই সে গ্রাম ছেড়েছে। আর স্কুলে এসে দেখল বুট না পরলে মাঠে নামতেই দিচ্ছে না। চেষ্টা করেছিল ক্ষিতি। কিন্তু সড়গড় হতে পারেনি। ফলে সেখানেও তার ম্যাচ খেলা হয়নি। বোর্ডিঙয়ের মাঠে ফুটবল পিটিয়েই আশ মেটাতে হয়েছে।

অভীক এখন প্রতি সকালেই খালপাড়ের মাঠে ম্যাচ খেলানোর ছক কষেছে। এক একদিন এক একরকম ম্যাচ। আজ হবে তিনতলা বনাম একতলা-দোতলা। তিনতলায় মোটে পনের জন ছেলে থাকে। তাদের মধ্যে জনা চারেক সারা জীবনে একবারও বলে পা দেয়নি। ফলে নাইন সাইড ম্যাচ হবে। মানে প্রতি টিমে ন-জন করে খেলবে। তিনতলার টিমে কাকু অপরিহার্য। গুঁইগাঁই করছিল বলে অভীক তাকে হস্টেলেই জোর করে বুট সিনগার্ড পরিয়েছে। বলেছে, বুট পরে মাঠ অবধি হেঁটে গেলেই পায়ের সঙ্গে বুটের বনিবনা হয়ে যাবে। আজ গোল যদি একটা করতে পারিস সন্ধেবেলার ফোনটা তোর আসবেই আসবে। শালা প্রেমভিখারি!

শেষ বাক্যটা দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলা।

মাঠে যাওয়ার সময় এ গলি ও গলি দিয়ে শর্টকাট করে বরাবরই হেঁটে যাওয়া হয়। ফেরার সময় জলকাদা মেখে মানিকতলার মোড় থেকে খান্না অব্দি সরকারি বাসে দু-চারটে টিকিট কেটে চলে আসা। বাকি পথটুকু আবার হাঁটা। সেদিন ম্যাচের ফলাফলেই অভীকের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। তার ক্লাইম্যাক্স হলো দোতলা বাসে।

ম্যাচে যে তিনতলা জিতবেই তা নিয়ে কাকুর ব্র্যাকেটের কোনও সংশয় ছিল না। এতদিন ধরে মাঠের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ডিফেন্সে অভীক অনুপম দুর্ভেদ্য। কাকু তো সারা মাঠের দখল নিয়ে খেলে, সাংঘাতিক দম তার। দিনু আর প্রদীপ প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ধোঁকা দেওয়ায় নিপুণ, বলিহারি তাদের পায়ের কাজ। দোতলা একতলার অসিত আর আগুয়ানকে নিয়ে যা একটু চিন্তা। অসিত মাঠের মাঝখান থেকেই গোলার মতো শটে গোল করতে পারে আর আগুয়ানের ড্রিবলিং আর গতি দুটোই ভয়-ধরানো।

তবে এসব হিসেবের পিণ্ডি চটকে দিতে পারে স্কটিশের কালো কাদার মাঠ। সে যে কখন কাকে লেঙ্গি মেরে হিসেব বানচাল করে দেবে বুঝে ওঠা দায়। প্রথম মিনিট দশেক হিসেবমতোই চলছিল। দিনু প্রদীপ চেপে ধরেছিল এক-দোতলার ডিফেন্সকে। তারপরেই শুরু হলো মাঠের খেল। মাঝমাঠে একটা বল ধরে কাকু উঁচু শটে দিনুর মাথায় বল দিতে গেল। অনভ্যস্ত বুট পায়ের শর্ট খানিক কাদা উড়াল, বল উড়ল না; খানিক থসলে গিয়ে দু-হাত দূরে গিয়ে থেমে গেল। সামনেই ছিল অসিত, বলটা ধরে খানিক এগিয়ে গিয়ে আগুয়ানকে বাড়াল। আগুয়ান কোমরের মোচড়ে অভীককে ধোঁকা দিয়ে গোল লক্ষ্য করে মাটি ঘেঁষা শর্ট নিল। শর্টে জোর ছিল না কিন্তু গোলকিপার দুলাল বল ধরতে গিয়ে কাদায় পিছলে আছাড় খেল। গড়াতে গড়াতে গোলে ঢুকে গেল বল।

তার পরে বাকি সময়টায় আর কোনো ঘটনা ঘটল না; একতলার মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। তাদের একের পর এক আক্রমণ এক-দোতলার পেনাল্টি বক্সের কাদায় আটকে গেল। একেবারে শেষ সময়ে কাকু ওদের গোলের মুখে ফাঁকা বল পেয়েও সেটাকে গোলে ঢোকাতে না পেরে মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। খেলা শেষ। আপাদমস্তক কাদা মেখে আঠারো জন খেলুড়ে আর জনা চারেক সাফসুতরো দর্শক মানিকতলার মোড়ে এসে সরকারি দোতলা বাসে উঠে পড়ল।

রবিবার। বাস প্রায় ফাঁকা। দোতলার সিঁড়িতে সবাই মিলে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে গেল। কন্ডাক্টার বারবার বলছে রাস্তা আগলে না থেকে উপরে উঠে যেতে। কেউ কর্ণপাত করছে না। বিরক্ত কন্ডাক্টার ভাড়া চাইতে অভীক তার হাতে একটা টাকা ধরিয়ে দিল। কন্ডাক্টার বলল, – ক’জন আছো?

অভীক বলল, – গুনে নিন।

চেষ্টা করেও সঠিক গুনতে না পেরে সে বলল, – কুড়ি জনেরও বেশি আছো আর দশ জনের ভাড়া দিচ্ছ?

অভীক বলল, – খেলতে গেছলাম দেখতে পাচ্ছেন না! ভাড়া দেওয়ার কথাই নয়। যা দিয়েছি অনেক।

কন্ডাক্টার বলল, – বাসে চেপে ভাড়া দেবে না! ভদ্রলোকের ছেলে তোমাদের লজ্জা করে না?

এরকম কথা সহ্য করার ছেলে অভীক নয়। খেলায় হেরে এমনিতে সে গরম হয়েই ছিল। এই কথা তার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। সে সটান কন্ডাক্টারের জামা খামচে ধরে তাকে একের পর এক চড়থাপ্পড় মারতে লাগল। অনুপম আর দিনু মিলে অভীককে জাপটে ধরে জোর করে সরিয়ে আনল। হতভম্ব কন্ডাক্টারের চোখে জল। নীচের কন্ডাক্টার টের পেয়ে জোরে জোরে ঘণ্টি বাজিয়ে ড্রাইভারকে বলছে, – পার্টনার, বাস ঘোরাও – মানিকতলা থানায় চলো –

অনেকটা এগিয়ে এসেছিল বাস। ড্রাইভার সত্যি সত্যিই ইউ টার্ন নিতে শুরু করল। আর সেই ধীর গতির সুযোগে তড়িৎ বেগে একের পর এক খেলুড়ে ঝুপ ঝুপ করে নেমে গিয়ে উলটো দিকের গলির মধ্যে জড়ো হয়ে যখন নিশ্চিত হলো সকলে নামতে পেরেছে, তখন ধীরেসুস্থে বেঁচে যাওয়া ভাড়ার সেই এক টাকার জিলিপি কিনে খেতে খেতে হস্টেলের দিকে এগোল। কিন্তু কথা নেই কারোর মুখে। অভীকের মুখের অনুশোচনার গ্লানি পরিবাহিত হয়েছে আর সকলের মনেও।

 

সেদিন সন্ধেবেলায় কাকুর ব্র্যাকেটের সবাই মিলে চেপে ধরল অভীককে। –কী হয়েছে রে, বালিগঞ্জে যাওয়া বন্ধ করেছিস কেন?

চেষ্টা করেও এড়াতে না পেরে অভীক বলল, – মেয়েরা মাইরি দূর থেকেই ভালো। কাছে এলেই গ্যাদগ্যাদে, বড্ডো ডাল।

কাকু বলল, – আজ কন্ডাক্টারের গায়ে হাত তুললি কেন?

অভীক রেগে গেল, – শালা তোরা কি আমাকে ফাঁসি দিবি! বুঝছিস না, রাগের মাথায় হয়ে গেছে। আমার নিজেরও কি ভালো লেগেছে!

কাকু ভাবল, যাক অভীক অন্যদের কথাও তাহলে ভাবে। কিন্তু এই যে সুবুকে তার এড়িয়ে চলা সেটা সুবুর কেমন লাগছে সেটা কি সে ভাবে?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *