অকূলের কাল। পর্ব ১৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

জলতরঙ্গ হাসি
চকমিলানো হোস্টেল-বাড়ির একতলায় বাথরুম, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, ভাঁড়ার ঘর আর দারোয়ান এবং রান্নার ঠাকুরদের থাকার ঘর। ফোনটিও থাকে একতলার বারান্দায়, তালাবন্ধ অবস্থায়। চাবি থাকে সুপারের কাছে। জরুরি দরকারে ফোন করতে হলে সুপারের কাছে কারণ দেখিয়ে চাবি নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু ফোন আসায় কোনো বাধা নেই। আজ পর্যন্ত ক্ষিতির কোনো ফোন আসেনি। আজ তার ফোন আসবে। আসবে তো?
তিনতলার তিনদিকে ঘর, একদিকে খোলা ছাদ। ছটা বাজতেই ক্ষিতি খোলা ছাদের রেলিঙয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। একটু পরেই আওয়াজ –ক্রিং ক্রিং…
রান্নার ঠাকুর ব্যোমকেশ ফোন ধরল। ক্ষিতি উৎকর্ণ। ব্যোমকেশ রিসিভার নামিয়ে রেখে হাঁকল, –সমীরণদা
সামান্য হতাশ ক্ষিতি দু-পা এগিয়ে সমীরণের ঘরে উঁকি দিল। ঘর খালি, বেরিয়েছে কোথাও। সে নীচের দিকে মুখ করে বলল, –ফোন রেখে দাও ব্যোমকেশদা, সমীরণ নেই।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ব্যোমকেশ ফোন রাখতে না রাখতেই আবার বেজে উঠল সে। ব্যোমকেশ ফোন ধরেই –ক্ষিতিদা আপনাকে চাইছে – বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল।
ক্ষিতির বুকে ঝড়। সে ছয় লাফে তিনতলা থেকে একতলায় নেমে ফোনের রিসিভার কানে নিল – হ্যালো –
ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় –-তোমার নাম খেতি? বলেই জলতরঙ্গের মতো কুলকুল হাসি ভেসে আসে।
ক্ষিতি বলে, –ভ্যাত! ক্ষিতি – ‘ক’য়ে মূর্ধন্য ষ –
ওপাশ থেকে আবার জলতরঙ্গ বাজে। ক্ষিতি বলে, –ক্ষিতি – মানে পৃথিবী –
–হয়েছে হয়েছে, আর মানে বলতে হবে না। আমি কোন জন বল তো –
আবার সেই ঝরনার মতো হাসি। ভীষণ ফাঁপরে পড়ে যায় ক্ষিতি। এ যে কথায় কথায় হাসে। যে সে হাসি নয়, একেবারে হৃদয়ে জলতরঙ্গ বাজানো হাসি। এই মেয়েটা যেটাই হোক এর গলার স্বর আর হাসির প্রেমে পড়ে যাচ্ছে ক্ষিতি। এ সেই বাচাল ‘হয়তো অঞ্জলি’ নয় তো। ক্ষিতির মন চাইছিল, এ যেন সেই ঈষৎ গম্ভীর, ছিপছিপে চেহারার শান্ত মেয়েটি হয়। কিন্তু এর কথায় কথায় হাসি শুনে ধন্দে পড়ে যায়। ক্ষিতি চুপ করে আছে দেখে ও-প্রান্ত বলে, –বলতে পারছ না তো। আচ্ছা সেটা না হয় পরে বলবে। তার আগে বল তো আমাদের তিনজনের কার কী নাম? ইশারায় কতটা বুঝেছ দেখি।
ক্ষিতি বলল, –যে বেশি ছটফট করে তার নাম অঞ্জলি –
ওপ্রান্তে আবার হাসি, বলে –ভুল, যে ছটফট করে সে অঞ্জু।
ক্ষিতি বলে, — সবচেয়ে লম্বা মেয়েটি জবা।
–জবা?
হাসির ঢেউ বন্ধ আর হয় না। ক্ষিতি মন ভরে হাসিই শুনতে থাকে। অবশেষে সে বলে, –ওর নাম রক্তিমা।
ক্ষিতি দ্রুত ভাবে। ‘যে ছটফট করে সে অঞ্জু’, ‘ওর নাম রক্তিমা’ – এইভাবেই বলল না জলতরঙ্গী! তবে কি যা সে চেয়েছে তাই – এই মেয়েটিই সেই গাম্ভীর্যময়ী ‘হয়তো দোলা’? কপাল ঠুকে ক্ষিতি বলে, –আর তোমার নাম দোলা।
ওপ্রান্ত এক মুহূর্তের জন্যে চুপ। তারপরেই খিলখিল হাসি। হাসি শেষে ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলে, –কী করে বুঝলে গো! তবে দোলা নই, দোলন। আমি কী ঠিক করেছিলাম জানো?
ক্ষিতি বলে, –কী?
দোলন বলে, –কে ফোন করছে যদি বুঝতে না পারো তবে আর কোনোদিনই ফোন করব না।
–কি-আশ্চর্য জানো, আমিও মনে মনে চাইছিলাম যেন এই মিষ্টি গলা আর হাসি যেন ‘গাম্ভীর্যময়ী’-র হয়।
–গাম্ভীর্যময়ী? আমি? ইস কী বিচ্ছিরি! আর যেন এই কথাটা কোনোদিন না শুনি।
–কেন, কথাটা খারাপ লাগছে? তাহলে ব্যক্তিত্বময়ী বলব?
–কোনো ময়ী-ই বলবে না, যারা খুব গম্ভীর তাদেরকে আমরা কী বলি জানো – গালফোলা গোবিন্দর মা। আবার জলতরঙ্গ বাজে। তারপর দোলন আবার বলে,–একটা সত্যি কথা বলো তো – তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে তোমার সঙ্গে নেটকি আর ভেলি ইশারা-ইঙ্গিত চালিয়ে গেলেও আসলে আমিই চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে পরিচয় করতে।
–নেটকি ভেলি?
আবার হাসি ভেসে আসে। দোলন বলে, –ও দুটো ওদের বাড়ির নাম। অঞ্জু হলো নেটকি আর রক্তিমা ভেলি। আমার মামাতো বোন। ওই বাড়িটা আমার মামার বাড়ি। আমি মামার বাড়িতেই বেশি থাকি। তোমাকে ফোন করবো বলে আজ আমার বাড়িতে চলে এসেছি। মামাবাড়িতে অনেক লোক। ফোন করা যাবে না। আমার বাড়িতে চার তলায় ফোন। সন্ধের সময় বউদিরা সবাই ছাদের ঠাকুরঘরে থাকে। তাই ফোন করতে পারছি। এখন বেশ কিছুদিন বাড়িতেই থাকব। রোজ ফোন করব। এবার যা জিজ্ঞেস করেছি তার সত্যি উত্তরটা দাও তো।
ক্ষিতি বলল, –মিথ্যে বলব না। তুমিই যে এসবের পিছনে একেবারেই বুঝতে পারিনি কিন্তু সত্যি বলছি ফোনের কথা যখন বলল আমি মনে মনে ভীষণ চেয়েছি তুমিই যেন ফোনটা কর। দোলন বলল, –কেন?
ক্ষিতি আমতা আমতা করে, –ইয়ে মানে – তিনজনের মধ্যে তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত।
দোলন বলে, –আমাকে বেশি আর নেটকি-ভেলিকে কি একটু কম ভালো লাগত?
আবার হাসি, এবার যেন তা থামতেই চায় না। থামল যখন তখন দোলনের স্বরে মাদকতা। বলল, –ওই দুটো খুব বিচ্ছু। হোস্টেলের ছেলেরা কেউ তাকালেই ওরা ঝাঁটা দেখায়, আর মজা করে। আমিও করতাম। তুমি একা একা যখন বারান্দায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে, একবারও আমাদের ছাদের দিকে তাকাতে না, তখন ওরা খুব রেগে যেত। ঝাঁটা দেখিয়ে মজা করার সুযোগ পেত না বলে। বলত, ‘এই ছেলেটা আতাক্যালানে, গাঁ থেকে এসছে মনে হয়। কেমন গাঁট্টাগোট্টা চেহারা দ্যাখ, দেখলেই মনে হয় খেতে লাঙল টানে বুঝি।’ ওদের কথাগুলো আমার ভালো লাগত না কিন্তু কিছু বললেই আমার পেছনে লাগবে বলে চুপ করে থাকতাম। আসলে তোমাকে একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলেই আমার মনে হতো, ছেলেটার বুঝি মন খারাপ। কোথায় কত দূরে বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এখানে আছে, বেশ হয় যদি ওর সঙ্গে দুটো কথা বলি, মন ভালো করে দিতে পারি যদি।
দোলনের কথা শুনতে শুনতে ক্ষিতির বুকটা টনটন করে ওঠে, কোনো কথা বলতে পারে না। দোলন আবার বলে, –যেদিন ওরা তোমাকে ঝাঁটা দেখালো সেদিন আর থাকতে না পেরে ছাদ থেকে নেমে নীচে গিয়েই ঘরে খিল দিয়ে আমি নেটকিকে বললাম, ‘শোন – আমার ওই ছেলেটাকে ভালো লাগে। তোরা ওর সঙ্গে মজা করবি না একদম।’ নেটকি তো শুনেই নেচে উঠল। কী বলল জানো?
–কী?
–নাঃ! বলব না। আমার লজ্জা করছে।
–বলো বলো প্লিজ, ওটা না শুনলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে, পাগলা হয়ে যাবো সত্যি বলছি।
–আচ্ছা আচ্ছা বলছি। বলল কি – যে – পুতুলরানি প্রেমে পড়েছে, পুতুলরানি হামি খাবে –
কট করে কেটে গেল ফোনটা। ক্ষিতি তাও কানে কিছুক্ষণ ধরে রইল রিসিভারটা। ডায়াল টোনের একঘেয়ে আওয়াজ। ফোন রেখে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে সে। পুতুল কি তবে দোলনের বাড়ির নাম? যেমন নেটকি, ভেলি – । ফোনটা এমন আচমকা রেখে দিল কেন! না কি লাইন কেটে গেল?
(ক্রমশ)