অকূলের কাল। পর্ব ১৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ছাদপরি
এক বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে ক্ষিতি দেখে হস্টেল একেবারে শুনশান। এতখানি না হলেও এই সময়টা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। কলেজ ফেরত আড্ডা-সিনেমা-থিয়েটার ঘুরে হোস্টেল ফিরতে দেরি করে বেশির ভাগ ছেলেই। ফাঁকা হস্টেলে বিকেলের মরা আলোয় বিষণ্ণতার ছোঁয়া। মন খারাপের হাওয়া বয় বুকের ভেতরে। কেন মন খারাপ কিছুই বোঝা যায় না, মন শুধু হুহু করতে থাকে, নিজেকে বঞ্চিত, পরিত্যক্ত মনে হয়। গলায় বাস্প জমতে থাকে। কবিতার লাইন ধরে একটা ছবি ভেসে আসে –“মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে…”
শচি অভীক তো বটেই, নকশাল অনুপমও প্রেম করে। মেয়েটা নাকি স্কুলে তার সহপাঠিনী ছিল। অনুপম তাকে গুড্ডি বলে ডাকে। গুড্ডি সিনেমার জয়া ভাদুড়ীর চরিত্রের সঙ্গে নাকি তার বেজায় মিল। সময় পেলেই অনুপম গুড্ডির কথায় আটখান হয়। তবে সে গুড্ডিকে প্রেমিকা বলে স্বীকার করে না। বলে, সে তার খুব ভালো বন্ধু। সেই সঙ্গে গুড্ডির বোন বীণার কথাও বলে। কে জানে, গুড্ডি না বীণা – কে তার প্রেমিকা!
তিনতলার বারান্দায় রেলিঙয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ক্ষিতি। বাঁ দিকের ছাদের দিকে তাকাতেই মন খারাপের হাওয়াটা ডিগবাজি খেয়ে ভ্যানিস! সেখানে তিনটি কিশোরী, যেন প্রস্ফুটিত তিনটি পদ্ম, দুটি কৃষ্ণা, একটি গৌরী। তিনজনেরই পিঠ-ছাপানো খোলা চুল। তারা যেন ক্ষিতিকেই দেখছে। দুই কৃষ্ণা হাসছে, কুন্দ ফুলের মতো তাদের দাঁত ঝকঝক করছে। গৌরী যেন ঈষৎ গম্ভীর, ঠোঁট চেপে আছে, হাসবে না কিছুতেই। দুই কৃষ্ণার একজন, মাথায় একটু খাটো, ক্ষিতির দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে আকাশের গায়ে কিছু একটা লিখল। কিছুই বুঝল না ক্ষিতি। সে নিজের বুকে আঙুল ঠেকাল। বলতে চাইল, আমাকে কিছু বলছো?
দুই কৃষ্ণা দুদিক থেকে গৌরীকে চেপে ধরে হেসে গড়িয়ে পড়ল। বোকার মতো তাকিয়ে রইল ক্ষিতি। একটু পরে বেঁটে কৃষ্ণা ক্ষিতির দিকে হাত তুলল, তার হাতে ঝাঁটা! নিভে গেল ক্ষিতি – তার মুখে ঝাঁটা মারবে বলল কি? বারান্দা থেকে ঘরে, নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। আলো যেটুকু বুকের মধ্যে জ্বলব জ্বলব করছিল, ঝাঁটার ঘায়ে ফুস করে নিভে গেল। শুয়ে শুয়ে তেতো স্বরে আওড়াল, — নহে নহে লীলাপদ্ম, রাইকিশোরী এসেছিল সম্মার্জনী হাতে।
তিন দিন পরে আবার ক্ষিতি এসে দাঁড়াল বারান্দায়। আড়চোখে তাকাল সেই ছাদের দিকে। সেখানে ছিল এক কন্যে। একটু পরে আর এক কন্যে গৌরীর হাত ধরে টানতে টানতে এসে দাঁড়াল ছাদের কার্নিশের ধারে। বারান্দায় আর থাকা উচিত কি না ভাবছিল ক্ষিতি। এবার ঝাঁটা আসে যদি? শেষবারের মতো সেদিকে তাকাতেই দেখে বেঁটে কৃষ্ণা জোড়হাত করে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়ছে। কী বলছে – সম্মার্জনীর জন্যে মার্জনা? তাই হবে বোধ হয়, কারণ তাদের মুখ হাসি হাসি কিন্তু হেসে গড়িয়ে পড়ছে না কেউ। ক্ষিতি ভরসা পেয়ে সোজাসুজি তাকায়। বেঁটে কৃষ্ণা আকাশের গায়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা লেখে। ক্ষিতি বুঝতে পারে না। সে হাত ঘোরালেই নাড়ু পাবে ভঙ্গিতে দুই হাত নাড়ে। বেঁটে এবার খুব ধীরে ধীরে লেখে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে এবং বুঝতে চেষ্টা করে ক্ষিতি। একটা সোজা দাঁড়ি, একটা তেরছা দাঁড়ি, তারপরে আবার একটা সোজা দাঁড়ি। ইংরাজি এন? ঘাড় হেলায় ক্ষিতি। বেঁটে আবার আঙুল চালায়। এবার দুটো তেরছা দাঁড়ি দিয়ে তাদের মাঝ বরাবর ছোট্ট একটা সোজা দাঁড়ি। পরিষ্কার ইংরাজি এ। বাকি দুটো যে এম আর ই, সেটা সহজেই বুঝে যায় ক্ষিতি। নেম – মানে তার নাম জানতে চাইছে? ক্ষিতি নিজের বুকে আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করতে চায় – আমার নাম?
সঙ্গে সঙ্গে আকাশলিপি-বিশারদ কন্যা তার মাথা উপর নীচ করে সায় দেয়। তারপর নিজের মাথায় হাত দিয়ে থাম্বস আপ ছোড়ে আকাশের দিকে। মানে – ঠিক বুঝেছো, মাথায় বুদ্ধি আছে দেখছি।
ক্ষিতির বুকে তখন হাজার বাতির আলো। সে ধীরে ধীরে আকাশের গায়ে ইংরাজি ‘কে’ লেখে। ওদিকের ছাদ থেকে খাটো কৃষ্ণা ঘাড় হেলায়, অর্থাৎ বুঝেছে। এবার ক্ষিতি একটু দ্বিধায় পড়ে – ‘এস’ লিখবে কি লিখবে না। না লেখাই ভালো। ‘এস’ অক্ষরটা গোলানো। লিখতেও, আবার ‘কে’-র সঙ্গে জুড়ে উচ্চারণ করতেও গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তার থেকে দাঁড়িওলা অক্ষরই ভালো। সে ‘এইচ’, ‘আই’, ‘টি’, ‘আই’ পর পর লিখে যায়। খাটো কৃষ্ণা আবার থাম্বস আপ করে, তারপর গৌরীকে জড়িয়ে ধরে তার কানে মুখ লাগায়, দুজনেই হাসতে হাসতে ছাদের কার্নিশে এলিয়ে পড়ে। তারপরে হঠাৎই ছুটতে ছুটতে ছাদ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। একটু পরেই ছাদে আলো জ্বলে ওঠে, ক্ষিতি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়।
পরের দিন থেকে প্রায় রোজই ঘণ্টাখানেক ধরে ক্ষিতির সঙ্গে তিন ছাদকিশোরীর হাতের মুদ্রায় আলাপচারিতা চলতে থাকে। হোস্টেলের বন্ধুদের টের পেতে দেরি হয় না। ছাদকিশোরীরা বিকেলে হাজির হলেই শচি সবাইকে সতর্ক করে দেয়, –কাকুর আকাশবাণীর আসর শুরু হচ্ছে, খবরদার কেউ ডিস্টার্ব করবি না। বারান্দায় যেন কাউকে দেখা না যায়।
বারান্দায় না বেরোলে কী হবে, ঘরের জানালার খড়খড়ি তুলে চার জনেই দিব্যি দেখতে থাকে। থিয়েটার দেখার চাইতে কম আকর্ষণীয় নয়। ক্ষিতির নাম জানার পর একে একে নিজেদের নামও জানিয়েছে ছাদপরিরা। ইশারাবাগীশ খাটো কৃষ্ণা নিজের বুকে হাত ঠেকিয়ে দুই হাতে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার ভঙ্গি করেছে। ওর নাম পুষ্পাঞ্জলি না হলেও অঞ্জলি হতে বাধ্য। গৌরীর গায়ে হাত ঠেকিয়ে দু-হাতে দোল দেওয়ার মতো করে একবার বাঁ দিকে আর একবার ডান দিকে দুলিয়েছে। কাজেই গৌরীর নাম বোধ হয় দোলা। লম্বা কৃষ্ণা সবচেয়ে সহজে নিজের নাম জানিয়েছে, একটা রক্তজবা হাতে নিয়ে নিজের বুকে ঠেকিয়েছে যখন, তখন তার নাম অবশ্যই জবা, কারণ রক্তজবা কারোর নাম হতে পারে না। তাদের নাম বিষয়ে সিদ্ধান্ত ক্ষিতি একা নেয়নি। চার বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে সর্বসম্মত নাম যথাক্রমে অঞ্জলি, দোলা এবং জবা। তবে আপাতত তাদের তিনজনের নামের আগেই একটা ‘হয়তো’ যোগ করা হবে বলে স্থির হলো। তিনজনেই ক্লাস টেনে পড়ে। সেটা বলতে এবং বুঝতে কোনো পক্ষেরই অসুবিধে হয়নি। প্রায় একই বয়সের একই বাড়ির তিন মেয়ে মানেই যে তারা খুড়তুতো-জেঠতুতো বোন সেটা ক্ষিতি অনুমান করে নিয়েছে।
মাসখানেক পরে ‘হয়তো অঞ্জলি’ বাঁ হাত মুঠো করে নিজের বাঁ কানে ধরল আর একটু থেমে থেমে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে শূন্যে কয়েকটা অর্ধবৃত্ত আঁকল। ক্ষিতি এখন ইশারা বোঝায় ওস্তাদ হয়ে উঠেছে, নিমেষেই বুঝে নিল ফোন করার কথা বলছে। ক্ষিতি হাত ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতেই ‘হয়তো অঞ্জলি’ তার দিকে তর্জনীর খোঁচা দিয়ে আকাশের গায়ে এন আর ও লিখল, মানে ক্ষিতির ফোন নম্বর চাইছে। ক্ষিতির বুকে ঝড়, কোন জন তার সঙ্গে কথা বলবে? ‘হয়তো অঞ্জলি’, ‘হয়তো জবা’, নাকি ‘হয়তো দোলা’? নিজের মন হাতড়াল ক্ষিতি। কেউ খারাপ নয়, তবে ঈষৎ গম্ভীর, ধীরস্থির ‘হয়তো দোলা’র দিকেই যেন মনটা ঈষৎ ঝুঁকে আছে। অথচ নিজের অটল মৌন ভঙ্গ করে তার ফোন করার সম্ভাবনাই সবচেয়ে কম বলে মনে হচ্ছে। যে করে করবে, ক্ষিতি ধীরে ধীরে আকাশের গায়ে তার হোস্টেলের ফোন নম্বর লিখে দিল। ‘হয়তো জবা’ সেটা একটা কাগজে লিখে নিল। তারপর ইশারায় ক্ষিতিকে জানিয়ে দিল আগামী কাল সন্ধে ছটায় তাকে ফোন করা হবে।
(ক্রমশ)