অকূলের কাল। পর্ব ১২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
অ্যানাইলেসন স্কোয়াড
কলেজ থেকে ফিরে বিকালের টিফিন – অল্প-ভিজে চিঁড়ের উপর নারকেল কোরা আর চিনি দেওয়া – সবে শেষ করেছে কাকুর ব্র্যাকেট, নীচ থেকে মাধোদা হাঁকল, – খিতিবাবু – গেস্ট আয়ে হ্যায়।
এই হস্টেলে ভিজিটারস রুম নেই। কাকু বারান্দায় বেরিয়ে অবাক চোখে দেখে সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছেন খিদিরপুরের কোম্পানি। কাকু শশব্যস্ত, এগিয়ে যায়, কী বলবে ভেবে পায় না। কোম্পানির মুখে সে উদ্বেগ দেখে স্পষ্ট। দিনু তাড়াতাড়ি করে উনিশ নম্বরের আপত্তিকর জিনিসপত্র ঢাকাঢুকি দিয়ে একটা চেয়ার পেতে দেয় রুমের মাঝখানে। কাকুর পিছু পিছু কোম্পানি ঘরে ঢুকে সেই চেয়ারে বসেন। রাধারমণ ধানাইপানাই করার লোক নন। পড়াশুনার খোঁজ নিতে দু-একটা মাত্র বাক্য খরচ করেই সরাসরি আসল বক্তব্যে পৌঁছে যান। অশোক যদি কিছুদিন এই হস্টেলে এসে থাকে নিয়মকানুন কোনো বাধা হবে না তো?
অশোক থাকবে, তাতে বাধা! থাকলেই কি মানতে হবে নাকি? কাকুর ব্র্যাকেটের সেকেন্ড ইয়ার চলছে। কয়েকদিন আগেই হস্টেল কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। কয়েকজন নেতা গোছের সিনিয়ার কলেজের পড়া সাঙ্গ করে হস্টেল ছেড়ে চলে গেছে। অনাথদাই এখন বড় নেতা। তার শক্তির উৎস কাকুর ব্র্যাকেট। ব্র্যাকেট-ঘনিষ্ঠ সমগ্র তিনতলা, একতলার সোমেশ্বর আর আগুয়ান। দোতলায় তরুণ ঘোষাল, দীনবন্ধু সাহা। কাজেই ভোটের প্রয়োজন হয়নি। কমিটির সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। অনাথদা জেনারেল সেক্রেটারি, কাকু কালচারাল সেক্রেটারি, দিনু মেস সেক্রেটারি, অভীক গেমস সেক্রেটারি। এছাড়া ব্র্যাকেটের বাকি সবাই-ই কমিটির সদস্য। দোতলার রঞ্জিত মণ্ডল কথা কম বলে, কিন্তু অল্প কথায় ফোড়ন কাটায় ওস্তাদ। অনাথদার কান বাঁচিয়ে বলে, ক্যাসিয়াস অনাথ মাইতির ব্রুটাস হচ্ছে কাকুর দলবল।
মজার ব্যাপার, ব্র্যাকেটের প্রতি ব্যোমকেশের আচারগতিক পুরো ডিগবাজি মেরেছে। একদিন উনিশ নম্বরে এসে কাকুকে বলল, – ক্ষিতিবাবু, আপনি নিরামিষ খান। অথচ দেখুন আপনার রোজকার খাবারে একটা ভাল নিরামিষ পদ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। অনেক দিন ধরেই ভাবছিনু, আপনাকে জিজ্ঞাস করে কিছু একটা রান্না করি – সুযোগই পাচ্ছিলুনি। দিনুবাবুকে বলুন না, আপনার মাছের বদলি পনির আনার ব্যবস্থা করতে। বেশ ভালো করে পনিরের ডালনা রেঁধে দেব রোজ।
কাকুর পনির পছন্দ নয়। তার পরামর্শ অনুযায়ী সেদিন থেকেই ইয়াব্বড়ো একখানা পোস্তর বড়া পড়ছে কাকুর পাতে। এমনই তার পরিমাণ যে কাকুর পাশে বসা ছেলেটির পাতেও খানিক তুলে দিতে হচ্ছে কাকুকে।
অশোকের থাকার প্রস্তাব শুনে কাকুকে কিছু করতে হলো না। দিনুই দোতলায় নেমে অনাথদার সঙ্গে কথা বলে এসে জানাল, কোনো অসুবিধে নেই, গেস্ট হিসেবে ছমাস পর্যন্ত দিব্যি থাকতে পারে। শুধু মেস চার্জটা দিতে হবে।
পরের দিন সকালেই অশোক এসে হাজির হলো। উনিশ নম্বরে একটা বাড়তি খাট ঢুকল। কাকুর ব্র্যাকেটের খাপে পুরো মানানসই হয়ে দিব্যি সময় কাটাতে লাগল অশোক। তবে হস্টেল থেকে বাইরে বেরোয় না একবারের জন্যও। কোম্পানির মুখে যে-উদ্বেগ দেখেছিল কাকু, তার ছিটেফোঁটাও অশোকের মুখে দেখা যায় না। হাসি মজা তাসে সে সকলেরই মন জয় করে নিয়েছে, কেবল হস্টেলে এসে থাকার কারণটা তার পেট থেকে চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি কাকু। দিনু বলল, অনুপমের সঙ্গে অশোক নাকি দরজা ভেজিয়ে নিচু গলায় কথাবার্তা বলছিল একদিন; সে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়তেই কথা বলা বন্ধ করে দেয় তারা। দুয়ে দুয়ে চার ভেবে নিয়েছিল কাকু, কিন্তু অশোকের এখানে এসে লুকিয়ে থাকাটা একটা প্রশ্নচিহ্নের মতো ঝুলেই রয়েছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ সুবিধের নয়। বড় শরিক সিপিএমের সঙ্গে মতভেদের জেরে অজয় মুখার্জি পদত্যাগ করতেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে রাজ্যে। রাজ্যপাল ধাওয়ানের শাসনে পুলিশের সক্রিয়তা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। বিদ্যাসাগর হস্টেল খালি করে দিয়েছে পুলিশ। এস এফেরও দেখা মিলছে না। একদিন কলেজে গিয়ে ক্ষিতি দেখে ইউনিয়ন রুমে বসে আছে একটা কালো, নিষ্ঠুর কিন্তু আকর্ষণীয় মুখের ছেলে। নাম বোধহয় রঞ্জিত পাঁজা। সে নাকি ছাত্র পরিষদের নেতা। বর্ধমানের দিকে বাড়ি। ছাত্র পরিষদ বিনা নির্বাচনেই বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন দখল করে নিয়েছে।
এক মাসও গেল না, অশোক এক ভোরবেলায় উঠে কাউকে কিছু না বলেই হস্টেল থেকে চলে গেল। তারপর থেকেই কাকুর খুব মন খারাপ। মাওকে নিয়ে কবিতা লেখার সময় থেকে খুব বেশি দিন হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই খুনখারাপির খবর শুনতে শুনতে সে মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অশোক কোথায় গেল সেই চিন্তায় তার ঘুম চলে গেছে। পরের রবিবারেই সে চলে গেল খিদিরপুর।
অশোক যে সেখানে থাকবে না, সেটা জানাই ছিল। অমিয় বা নরজিতের কাছে যদি কিছু জানা যায়? জানা গেল সবই। অমিয় ঘরের দরজা বন্ধ করে ফিসফিস করে জানাল, ডেন্ট মিশন রোডের একটা চা-জলখাবারের দোকানে বেলা দশটার সময় একজন ট্র্যাফিক কনস্টেবল বেঞ্চিতে বসে চা-টোস্ট খাচ্ছিল। দোকানভর্তি খদ্দের। তার মধ্যেই দিলীপ, অশোক আর বুলি তিনজন তিনটে ছোরা নিয়ে তার উপরে লাফিয়ে পড়ে কোপাতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাজ সেরে তারা উধাও হয়ে যায়। পুলিশের গাড়ি এসে লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ। কয়েক দিন ধরেই পুলিশ আসছিল বাড়িতে। কোম্পানি কীভাবে যেন লুকোনো জায়গায় অশোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। তোর হস্টেলে যে ছিল আমরা জানতাম না।
নরজিত অমিয়র থেকে একটু বেশি জানে মনে হলো। কিন্তু সে মুখ খুলল না। সে হাসপাতালে ডিউটিতে বেরিয়ে যাবার পর অমিয় আরও কিছু খবর দিল। নরজিতও নাকি গত তিন দিন বাড়ি ছিল না। কোথায় গিয়েছিল কাউকে বলেনি। কাল অনেক রাতে ফিরেছে। অমিয়র ধারণা, কোম্পানি নরজিতের সঙ্গেই অশোককে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামের দিকে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখানে লুকিয়ে থাকার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করে নরজিত ফিরেছে। কিছুদিন ধরে কোম্পানি প্রায়ই লালবাজারে ছুটছেন। লোক ধরে লালবাজারের বড় অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন।
তার যা জানা ছিল, সব বলা শেষ করে অমিয় বেশ কিছুক্ষণ দিলীপের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ উগরে দিল – শালা দিলীপটাই যত নষ্টের গোড়া। অশোক আর বুলিকে ও-ই নিয়ে গিয়ে নকশালদের দলে ভিড়িয়েছে। ওই দলের তো কোনো মাথামুণ্ডু নাই। গুন্ডা বদমাশগুলোও এখন নকশালের নাম করে লোককে চমকাচ্ছে। খুনখারাপি করার জন্যে দিলীপের হাত সব সময় নিশপিশ করে। দলের নির্দেশে, নাকি নিজের মর্জিতেই এই কাণ্ড করেছে কে জানে! পুলিশ মেরে পার পাবে নাকি! ধরতে পারলে পুলিশই ওদেরকে গুলি করে মেরে দেবে – এই তোকে বলে রাখছি।
(ক্রমশ)
