অকূলের কাল। পর্ব ১০। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

নেশাখোরের দল 

গোবর্ধনপুরের ধনাদার হাতে মদে কেবলমাত্র জিভেখড়িটুকুই হয়েছিল কাকুর ব্র্যাকেটের। প্রতি চুমুকেই গলা বুক জ্বলে যাচ্ছিল। নুন জিভে ফেলতে কিছুটা শান্তি। তাও পাঁচ জনে মিলে বেঁটে বোতলের আদ্ধেকটাও শেষ করতে পারেনি। মণীন্দ্র কলেজের কেমিস্ট্রির দিনু বলেছিল, শালা খাঁটি ইথাইল অ্যালকোহল মাইরি। চুমুক দেওয়াটা যত কষ্টেরই হোক, ফেরার পথে হাওয়ায় ভাসছিল তারা। প্রাণে অকারণ পুলক। শচি জমিয়ে কীর্তন গেয়ে চলেছিল। একটা পুকুর পাড়ে বসে অনেকটা সময় কাটিয়ে, লবঙ্গ চিবোতে চিবোতে শচিদের বাড়িতে ঢুকেছিল। রাত্রে এক ঘরে শুয়ে কতো যে মনের কথা বলাবলি হলো। অনুপম যে এক মাড়োয়ারি কিশোরীর সঙ্গে প্রেম করে সেটা সেদিনই জানা গেল প্রথম। তবে বিপ্লবের কথায় আগল দিয়েই  রাখল সে।

 

এক সন্ধেয় উনিশ নম্বরে প্রদীপের খাটে অনুপম আর প্রদীপ দাবার বোর্ড পেতে বসেছে, দিনু গুনগুন করে কেমিস্ট্রি পড়ছে আর কাকু গল্পের বই। শচি কী করছিল কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ দেখা গেল সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। এমনটা হয় না সচরাচর। অন্যরা ধরালে সে দু-এক টান দেয়, নিজে কখনও সিগারেট কেনে না। নেশা তার বিড়িতে। দিনু প্রথম গুনগুনানি বন্ধ করে উশখুশ করে উঠল, কীরকম একটা গন্ধ আসছে না! তারপর শচির দিকে তাকিয়ে বলল, – কী সিগারেট রে শচি?

শচি জবাব না দিয়ে নিজের মুখের সিগারেট দিনুর মুখে গুঁজে দিল। দিনু দুটো টান দিয়ে বলল, এ তো শালা অন্য জিনিস মনে হচ্ছে।

শচি বলল, এবার কাকুকে দে। কাকু এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে যাচ্ছিল, শচি তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরল। বলল, –এ ধোঁয়া ছাড়ার নয়, গিলে নে। যত গিলবি ততোই জমে যাবে।

প্রদীপ, অনুপম – কেউই বাদ গেল না। সকলের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল সিগারেট। সব শেষে শচি নিয়ে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে তাকে দুহাতের মুঠির মধ্যে ভরে মুঠির মুখে ঠোঁট লাগিয়ে লম্বা টান দিল। পুড়তে পুড়তে শেষ প্রান্তে এসে আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতে তবে ফেলল। খানিকক্ষণ ব্যোম হয়ে বসে থাকল। তারপর বলল, – এইভাবে হয় না। কল্কে চাই, বুঝলি। নাহলে মহাদেব অসন্তুষ্ট হবেন।

গাঁজা খাওয়ার অভিজ্ঞতা শচি বাদে কেবল দিনুরই ছিল। তবে সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে তাতে গাঁজা ভরে টান দেওয়া তার কাছেও নতুন। গাঁজার নেশা যে অতুলনীয়, সেটা কিছুদিন বাদেই সবাই টের পেয়ে গেল। মাথাটা ঝিম মেরে থাকে। কয়েক পা হাঁটলেই মনে হয় অনন্তকাল হেঁটে চলেছি। গান শুনলে সুরের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া যায়। যখন যা-গানই শোনা হয়, মনে হয় সেটাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত। শচির কীর্তনাঙ্গের গান শুনে মনে হয় শচিন কর্তাই বুঝি গাইছেন। আর খাওয়া! খাবার যা-ই হোক, তার স্বাদ অতুলনীয়। শচি বলেছিল, শাস্ত্রে লেখা আছে গাঁজার অনুপান দুধ আর মিষ্টি। দুধ আর কোথায়, শচি এখন গাঁজার পুরিয়া কিনতে গিয়ে সঙ্গে জিলিপিও কিনে আনে। অভীক কিছুদিন চেঁচামেচি করে গাঁজা খাওয়া আটকানোর চেষ্টা করেছিল। শেষে আর না পেরে নিজেও শামিল হয়ে গেছে গাঁজার আসরে। সিগারেটে ভরে নয়, এখন পোড়ামাটির কল্কেতে ঠেসে গাঁজা ভরে তাতে আগুন ধরিয়ে টানা হয়। কল্কে হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। এই আসরে এখন নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে ব্র্যাকেটের বাইরের মলয় এবং মাঝে মাঝেই মনোজিৎদা। শচিই মূল ব্যবস্থাপক। কল্কে আর গাঁজার পুরিয়া কিনে আনা থেকে শুরু করে গাঁজার মশলা সামান্য জল দিয়ে নরম করে হাতে ডলে কল্কেতে ভরা এবং প্রথমে টান দিয়ে গাঁজায় আগুন ধরানো পর্যন্ত।

ধনাদার হাতের চোলাইয়ের স্বাদ নিয়ে ফিরে আসার পর পরই কিছুদিন তরলের চেষ্টা চলেছিল। ফল তেমন সুবিধে হয়নি। হাতিবাগানের মোড় থেকে শ্যামবাজারের দিকে একটু এগোলেই কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের উপরে একটা বিলিতি মদের দোকান আছে। কিন্তু বড্ড দাম। একদিন দুটো বিয়ার কিনে আনা হয়েছিল। অভীক ছিল না। মলয় আর মনোজিৎদা এসে যোগ দিয়েছিল। আধ গ্লাস করেও জোটেনি সকলের। শচি বলল, – বাংলা হলে সকলে যুত করে খেতে পারত। মড়ার জায়গা এমন যে কাছাকাছি একটা বাংলা দোকান নেই!

মনোজিৎদা বলল, – আছে তো। শ্যামবাজারে। কিংবা শিয়ালদা যেতে হবে। তবে কে টি-র তুলনা নেই। কে টির নাম শুনেছ?

–কেটি! সে আবার কী? কেউ শোনেনি।

মনোজিৎদা বলল, — আরে তোমরা কলকাতায় আছো অথচ কে টি-র নামই শোননি – তোমাদের তো নরকেও জায়গা হবে না। কে টি হলো খালাসিটোলা। কলকাতার তীর্থস্থান। সেখানে গেলে দেখবে বাংলা সাহিত্যের ছোটোবড়ো সব দেবতা এক নম্বর মাকালী পাঁইট থেকে মাধ্বীরস ঢেলে পান করছেন। স্যুট টাই পরা দিশি সাহেবের সঙ্গে একাসনে বসে খাটো ধুতি আর গেঞ্জি গায়ে, কাঁধে গামছা ফেলা কলকাতার রিকশাওয়ালা এখানে এক গেলাসের ইয়ার বনে যান – ভাবা যায়! খালাসিটোলা শুধু পুণ্যভূমি নয়, সাম্যভূমিও। সোভিয়েত রাশিয়াতেও এমন সাম্য দেখা যাবে বলে মনে হয় না।

আরও অনেক কিছু বলল মনোজিৎদা। খাঁটি সাহেবের দেখা পাওয়াও নাকি বিরল নয় কে টি-তে। গিনসবার্গ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা সুনীল-শক্তিরা তাঁকে নিয়ে কে-টি তোলপাড় করেছে। ঋত্বিক কিংবা কমলকুমারের দেখা পেতে হলে কে টি-ই একমাত্র ভরসার জায়গা। হাংরিদের নাম শুনেছ তো – হাংরিদের সদর দপ্তরই ছিল খালাসিটোলা। শেষে বলল, — একদিন তোমাদের কে টি দর্শনে নিয়ে যাব।

সত্যিই এক শনিবারের বিকেলশেষে হাতিবাগান থেকে ট্রামে উঠে ওয়েলিংটনে গিয়ে নামল মনোজিৎদার বাহিনী। অভীক নেই, তার বদলে মলয় আছে। যা বলেছিল মনোজিৎদা, বর্ণে বর্ণে মিলে গেল। দুয়ার-আঁটা দোকানে দুটো খাঁচার মতো কাউন্টার। সেখানে খদ্দেরের লাইন। দোকানের তাকে সাজানো রয়েছে নানা আকারের রকমারি লেবেল সাঁটা কাচের বোতল। বড়ো আকারেরটার নামই কেবল বোতল, তার চেয়ে ছোট পাঁইট, সবচেয়ে ছোট ফাইল। টাকা দাও, মাল বগলে একটা কাচের গ্লাস নিয়ে বেঞ্চিতে বসে পড়। টিনে ঘেরা অনেকখানি জায়গায় সারি সারি জোড়া-বেঞ্চি পাতা আছে। বেঞ্চিতেই জলের জগ রাখা। দরকার মনে করলে একটা সোডার বোতল কাউন্টার থেকে কিনে আনতে পার। জল বা সোডা বাহুল্য মনে করলে নির্জলা চালিয়ে দাও। টিনের ঘেরার গায়ে গায়ে হরেক রকম চাটের পশরা নিয়ে বসে আছে লোকেরা – ছোলা-মটর-বাদাম – কাঁচা, সেদ্ধ, ভাজা, পাঁঠার ছাঁট মেশানো ঘুগনি, কাটা ফল। বেঞ্চি ফাঁকা পাওয়াই মুশকিল। নাহলে ওই বেঞ্চিতেই বোতল গেলাস রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চালাও। দু-চার ঢোঁক গলায় দিলেই বসা-দাঁড়ানোয় ফারাক থাকে না। পাশের লোকের সঙ্গে এমন ভাব হয়ে যাবে, সে আপনাকে নিজের জায়গায় না বসিয়ে ছাড়বে না। আপনি বসবেন না জেদ ধরলে তার সঙ্গে মারামারিও লেগে যেতে পারে। চারদিক থেকে এত কথা, গান, কবিতা এসে মিলেমিশে যাচ্ছে যে দু-গ্লাসের পরে কোনোটার সঙ্গে কোনোটাকে আপনি আলাদা করতে পারবেন না।

বারো-চোদ্দ টাকায় সাত জনের ফুরফুরে নেশা। ফেরার পথে ট্রামে ভাড়া দেওয়ার কী দরকার! অন্তরকথা চালাচালি করতে করতে ফুটপাথের উপর দুলতে দুলতে কখন যে তারা ওয়েলিংটন থেকে হরি ঘোষে পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি।

পর পর কয়েক শনিবার চলেছিল কেটি অভিযান। তারপর কাকু একদিন সেখান থেকে ফিরে এসেই দেখল মলয় একটা পাঁইট নিয়ে তার ঘরে বসে আছে। বেশিটাই ভর্তি। মলয় বলল, – স্পেশাল শিবশক্তি শরবত খেয়ে বৈঠকখানা থেকে একটা দিশি নিয়ে দেখছিলাম দুটো মিলেমিশে কী দাঁড়ায়। কিন্তু সুবিধে মনে হচ্ছে না। পারো তো খেয়ে নাও। কেটির দ্রব্যগুণে কাকু তখন অকুতোভয়। পারব না মানে! পুরোটা নির্জলা ঢকঢক করে শেষ করে নিজের বিছানার উপর এসে শুয়ে পড়ল। স্বর্গে যখন প্রায় পৌঁছে গেছে, তখন হঠাৎ-ই সারা শরীর পাক দিয়ে উঠল, বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট। তারপরেই শুরু হল দমকে দমকে বমি। শেষ আর হয় না। মনে হচ্ছে তার পাকস্থলিটাই ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। সবাই জড়ো হয়ে গেছে। অভীক দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। শচি ঝাঁটা আর বালতি হাতে বমি পরিষ্কার করছে। মনোজিৎদা কাকুর মাথার কাছে বসে। একটু পরেই কী হল বুঝল না কাকু। সে মনোজিৎদার কাছে কয়েকটা বিষণ্ণ শব্দ জানতে চাইছিল, কারণ একটা কবিতা মাথায় আসছে তার। এমন সময় দিনু আর অনুপম মিলে অভীককে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল। পরের দিন শুনল, অভীক মলয়ের ঘরে গিয়ে তার মাথায় এক বালতি জল ঢেলে তার গালে পরপর চড় মেরে যাচ্ছিল। তার ধারণা, মলয়ই নাটের গুরু, সবাইকে নেশাখোর বানাচ্ছে।

কিছুদিনের জন্যে সব নেশার ছুটি হয়েছিল। তারপরেই একদিন শচির হাত ধরে এল গঞ্জিকা। গ্রে স্ট্রিটেই নাকি আছে একটা লাইসেন্স পাওয়া গাঁজার দোকান। একটা গুমটি মতো ঘরের লোহার শিক দেওয়া জানালার ফাঁকে হাত গলিয়ে কাগজে মোড়ানো পুরিয়া পাওয়া যায়, আট আনা পুরিয়া। এক টাকা খরচ করলেই সকলের জব্বর নেশা। মদো মাতাল হওয়ার কী দরকার!

গাঁজা খুবই উচ্চস্তরীয় নেশা। এতে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল হয় মানুষ। কাকুকে একলাটি পেয়ে অনুপম একদিন খুবই বিমর্ষ হয়ে বলল, — এইসব কবি তোদের, শক্তি সুনীল – প্রতিবিপ্লবীর মতো এদের আচরণ। যুবসমাজ চারু মজুমদারের চেয়ে এদের দিকেই কি ঢলে যাচ্ছে বেশি? আমি কীকরে মদ-গাঁজায় ডুবে যাচ্ছি!

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *