অকূলের কাল। পর্ব ৩৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

বিচ্ছিন্নতার বৈঠক

অনুপম বলল, – শালা এদিকে সব কেলো হয়ে বসে আছে। হস্টেলে আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। আমি যে সব জানি, সেটা বুঝতে পেরে আমার উপরে দায় চাপিয়েছে আজ যেন তোদেরকে শান্তর মাসির বাড়িতে অবশ্যই ধরেবেঁধে হাজির করি।

নরজিত বলল, – তুমিও চল আমাদের সঙ্গে। যাদবপুরে গিয়ে মেয়ে দুটোকে ভালো করে বুঝিয়ে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করি। কোম্পানি সুদ্ধু যেভাবে মাথা গলিয়েছে তাতে এছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই।

ক্ষিতির মুখ শুকিয়ে গেছে। গত দুদিন ধরে দোলনকে নিয়ে ঘুরছে। তার হাত ধরা তো দূরের কথা, ভালো করে দুটো কথাও বলতে পারেনি। কালও ভাবছিল বিয়ের সম্ভাবনার কথা। দুটো জীবন এক হয়ে গেলে কেমন অনুভূতি হতে পারে সেটাই কল্পনায় ধরার চেষ্টা করছিল। এখন সে চরম হতাশ। একবার বাড়ি ফিরে গেলে আর কি কোনোদিন বেরোতে পারবে!

অনুপম বলল, – দোলনের মামারা নাকি বলেছে, বাড়ি থেকে হস্টেলে পাঠিয়েছে পড়াশুনার জন্যে যখন, ছেলে দুটো নিশ্চয় মেধাবী। তারা পড়া শেষ করে চাকরিবাকরি করলে তাদের সঙ্গে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এখন অপেক্ষা করতেই হবে। তাদের কোনো তাড়া নেই। তাছাড়া বিয়ের বয়সও তো হয়নি – না ছেলেদের, না মেয়েদের। তিন-চার বছরে কী-ই বা এসে যাবে!

এসব আশার কথায় ক্ষিতির মনে কোনো উৎসাহ জাগছে না। বাড়িতে ফিরে মেয়ে দুটোর কিছু না কিছু হেনস্থা তো হবেই। এরপরে দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাও কি সম্ভব হবে! ক্ষিতি যন্ত্রের মতো সকলের পিছু পিছু বাসে চাপল। নরজিতের পিসির বাড়ি গিয়ে দেখে দুজনে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করছে পিসির সঙ্গে। দিব্যি দুশ্চিন্তাহীন মুখ। এখনও বোধ হয় ভাবছে, আজই বিয়েটা হয়ে যাবে। তারপর নতুন জীবন। ক্ষিতি ভাবল, তাঁর নিজেরও আত্মবিশ্বাস আছে কিন্তু কোথায় থাকবে, কী খাবে – সেসব নিয়ে ভাবনাচিন্তাও মাথায় আছে। এই মেয়েটার সেই বোধও আছে কিনা সন্দেহ।

অনুপম আর নরজিত পালা করে পরিস্থিতি বর্ণনা করতেই মেয়ে দুটোর মুখ শুকোতে শুরু করল। ক্ষিতি ভাবছে, নেটকির মনের ভাবটা কী? দোলন-ক্ষিতির বিয়ে হলে তার বিশেষ সুবিধে কিছু হবে কি? হয়ত ভাবছে দোলন-ক্ষিতির সঙ্গে সে যদি কিছুদিনও থাকে, তাহলে শান্ত নিশ্চয় তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে। একদিন না একদিন বিয়েটাও হয়ে যাবে তাদের। নিজের মনেই দুঃখের হাসি হাসল ক্ষিতি। শান্তর রূপেই ভুলেছে অঞ্জু, ছেলেটাকে চিনতে পারেনি একেবারেই। তাকে চিনতে ক্ষিতির সামান্য যেটুকু বাকি ছিল, গত দুদিনের ঘটনায় তা সম্পূর্ণ হয়েছে। আজকে তার মাসির বাড়িতে তারা যে-কথাই দিক, কোনোটাই রাখবে না। সব চুকেবুকে গেলে সুন্দরী মেয়ে দেখে শান্তর বিয়ে দেবেন তার বাবা। কালো নেটকিকে যে তিনি বউ করে নিয়ে যাবেন না, সে-ব্যাপারে ক্ষিতি নিশ্চিত।

দোলনের মামার বাড়ি সব কালো রঙয়ের। দোলনের মা-ও নিশ্চয় কালোই ছিলেন। তিনি এবং দোলনের ফরসা বাবা দুজনেই দোলনের মাস খানেক বয়সে পনের দিনের অন্তরে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। দিদিমার কাছে মামার বাড়িতেই মানুষ হয়েছে সে। মামাদের একান্নবর্তী বিশাল পরিবার। বড়মামা রেলে চাকরি করতেন। এখন চাকরি ছেড়ে রেলের কনট্রাকটর। মেজ মামা রেলেরই উচ্চপদস্থ অফিসার। বড় লম্বা, মেজ বেঁটে, দুজনেই খুব সুন্দর কথা বলেন- বাংলা ইংরাজি মিলিয়ে। তারাই পরিবারের কর্তা। ঠান্ডা মাথা। তাঁদের মাথা গরম ভাগ্নে, দোলনের বড়দাকে সামলেসুমলে রেখেছেন। দোলনের মেজ আর ন’দা মায়ের কালো রঙ পেয়েছে। বাকি তিন ভাই তিন বোন সকলেই বাবার ফরসা রঙটি নিয়েছে। দোলন একদিন তার ছোটবেলার শোনা কথা ক্ষিতিকে শুনিয়েছিল। পড়াশুনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। দোলন বলল, – মা ছিল না বলে খুব কাঁদত, তাকে শান্ত করতে দিদিমা নাকি দুধের সঙ্গে আফিম মিশিয়ে খাওয়াত। সেই জন্যেই নাকি তার মাথার ঘিলু কিছু শুকিয়ে গেছে। অঙ্ক বুঝতে পারে না, পড়াশুনা করতেও ভালো লাগে না। ক্ষিতি অবশ্য বিশ্বাস করেনি, দোলন আসলে মন দিয়ে পড়েই না। কিন্তু তার গানের গলা খুবই ভালো, তবু গান শিখতেও মন লাগায় না।

নেটকির নিজের দুই দাদা অনেক ছোট। জ্যাঠতুতো দুই দাদা – বড় এবং মেজই তার অভিভাবক। শান্তর মাসির বাড়ির বসার ঘরে পাশাপাশি দুই চেয়ারে বসে আছেন দুই ভাই। প্রায় বিকেল হয়েছে ক্ষিতি, দোলন, অঞ্জুর এখানে এসে হাজির হতে। সকাল থেকেই নরজিতের পিসি তাদেরকে ভালো করে ভাত খাওয়াবে বলে তোড়জোড় করেছিলেন। না খাইয়ে ছাড়লেন না। সবাইকেই খেতে হলো, অনুপমকেও। কোনোরকমে খেয়েছে সবাই, দুশ্চিন্তা খাওয়ার রুচিকে নষ্ট করে দিয়েছিল।

শান্তর বাবা বিছানায় বসা, তার পাশে শান্ত আর শান্তর গা ঘেঁসে আদুরে ভঙ্গিতে বসে আছে তারই প্রায় সমবয়সি মাসতুতো বোন। তার  মাসি আর মেসো দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দোলনের দাদা ফরসা, মোটা, বড়বড় চোখ – মামাদের উলটো দিকের চেয়ারে বসে। তার পাশে নিরীহ ভঙ্গিতে অমরশঙ্কর। অপরাধীর ভঙ্গিতে বাইরের দরজার পাশেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিন আসামি। বড়মামা হাসিমুখে দুই পলাতকার দিকে তাকিয়ে বললেন, – কীরে, তোরা নিজেরাই চলে গেলি পলাশীতে বিয়ে করার জন্য। তার আগে ওদের সাথে কিছু কথা হয়নি?

নেটকি পরিষ্কার বলে দিল, – না, ওরা কিছুই জানত না। আমি পাস করতে পারিনি, খবরটা জানতাম যে ওরা দুজনেই শান্তর বাড়ি গেছে। তাই পুতুলকেও সঙ্গে নিয়ে চলে গেলাম।

মামা বললেন, – ছেলেদের  ভালো ভালো জামাপ্যান্ট দেখে ভেবেছিস ওদের টাকাপয়সার চিন্তা নেই। বিয়ে করলেই দিব্যি সব কিছু ঘরে এনে দেবে আর তোরা সুখে সংসার করবি! বাবার দেওয়া অ্যালাউন্সে ওদের দিন চলে, সেটা কি জানিস? চিরকাল চলবে না। নিজের চাকরি ব্যাবসা – যা হোক কিছু করে রোজগার করার উপযুক্ত হলে তখন বিয়ের ভাবনা।

এবার তিনি অমরশঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললেন, – উই বিয়ার নো ম্যালিসাস অ্যাটিচিউড টু দ্য বয়। এই বয়সে এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। মেয়েরা যে নিজেই গিয়ে ওখানে হাজির হয়েছিল, ওদের অজান্তে – সেটা আমরা বিশ্বাস করেছি। গোবিন্দবাবু খুব ভালো পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরাও কোনো হার্স স্টেপ নিইনি পাছে ওদের ক্যারিয়ারে দাগ লাগে।

দোলনের দাদা বিষদৃষ্টিতে ক্ষিতির দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর চাউনি রীতিমতো ভীতিকর ঠেকছিল ক্ষিতির কাছে। অনুপম বলছিল, যেদিন রাতে ওরা পলাশী যায়, সেদিন  দোলনের ভাইপোর কাছে তোর নাম জেনে তোর খোঁজে কয়েকটা ক্রিমিন্যালকে হস্টেলে পাঠিয়েছিল ওর দাদা। আমাকে একটু অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। নইলে হয়তো তার পরের দিনই আমি হস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতাম।

শেষ পর্যন্ত মিষ্টভাষী মেজমামা তার দাদার কথা কেড়ে নিয়ে নিজে বলতে শুরু করলেন, – দাদা, তুমি থামো। দুটি ছেলেই যথেষ্ট ভালো। ইয়ে – শান্তর তো কথাই নেই। ওর বাবা রাজি থাকলে আমরা যেকোনো দিন অঞ্জুর সঙ্গে ধূমধাম করে বিয়ে দিতে রাজি আছি। আর ক্ষিতিও খুব ভালো ছেলে – আমি খবর নিয়েছি। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছে। এবার শরীর খারাপ বলে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ক্লার্কশিপ পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করেছে। চাকরি তো পাবেই, আজ না হোক – কাল। এবার ওদের বাড়ির লোকের বিবেচনা। দুই বাড়িই ব্রাহ্মণ পরিবার। আমরা তন্তুবায়। ওরা রাজি থাকলে ভবিষ্যতে যেকোনো দিন বিয়ের ব্যবস্থা হতে পারে। কী বলিস – পঞ্চু?

পঞ্চু মানে পঞ্চানন বসাক, দোলনের দাদা। তিনি অবশ্য হ্যাঁ না কিছু জবাব দিলেন না।

শান্তর পদবি ভট্টাচার্য – তার বাবা গোবিন্দ ভটচায মিষ্টি করে বললেন, – আমি যোগাযোগ রাখব।

অমরশঙ্কর কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। মেজ অনেকদূর বলে দিয়েছে বলে ঈষৎ বিরক্ত বড়মামা বললেন, – ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক। তোমরা বাবারা এখন মন দিয়ে নিজেদের পড়াশোনা শেষ করো। পঞ্চু – তুই বাড়ি চলে যা। আমরা পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বাড়িতে কিছুদিন রেখে সময়মতো পাঠিয়ে দেব’খন।

পঞ্চানন গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠলেন। প্রায় পিছু পিছু মামাদের সঙ্গে অঞ্জু আর দোলন। সবশেষে অমরশঙ্কর ক্ষিতিকে বললেন, – তুই চল আমার সঙ্গে। আমার ওখানে কয়েকদিন থেকে তারপর রাধারমণবাবু যা ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সেইমত হবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply