সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ১১। বরুণদেব
১৮৭৯-র ক্রিসমাসের রাতে ভারতীয়দের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন চিয়ারিনি। বোরিবন্দর রেল স্টেশনের কাছে ক্রস ময়দানে তাঁর রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাসের তাঁবুতে।
জিউসেপ্পে চিয়ারিনি (Giuseppe Chiarini)। পৃথিবীবিখ্যাত অশ্বারোহী ও অশ্বপ্রশিক্ষক। ১২ই ডিসেম্বর,১৮৭৯, চিয়ারিনির রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাসের প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বোম্বে প্রদেশের গভর্নর রিচার্ড টেম্পল। এর কয়েকদিন পর ক্রিসমাসের রাতে চিয়ারিনি ছুঁড়ে দিলেন চ্যালেঞ্জ-
আমি জানি, ভারতে কোনো সার্কাস দল নেই। আরও অনেক বছর ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে নিজেদের সার্কাসের জন্য। চ্যালেঞ্জ করছি, যদি কেউ আমার মতো ঘোড়ার খেলা দেখাতে পারে, তাকে আমি ভারতীয় মুদ্রায় এক হাজার টাকা দেবো। সেই সঙ্গে আমার প্রশিক্ষিত ঘোড়াগুলোর মধ্যে যে কোনো একটা দিয়ে দেবো। ছ’মাস সময় দিচ্ছি। আছেন কেউ? কেউ আছেন? থাকলে এগিয়ে আসুন।
এই বিস্ময়কর ইউরোপীয় শিল্পের সম্মোহন প্রত্যক্ষ করতে সার্কাসের তাঁবুতে আসছেন দেশীয় রাজারা, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ক্রিসমাসের সে রাতে দর্শকাসনে সপারিষদ উপস্থিত মহারাষ্ট্রের কুরুন্দওয়াদ (Kurundwad) প্রদেশের রাজা বালাসাহেব পটবর্ধন আর ছিলেন বিষ্ণুপন্থ মোরেশ্বর ছত্রে, অশ্বারোহী ও কুরুন্দওয়াদ রাজপ্রাসাদের আস্তাবালের সুপারিনটেনডেন্ট।
যুদ্ধ থেকে যাপন, পরিবহন থেকে পরিযায়ন, সভ্যতার নানা বিপন্ন বাঁকে বাঁকে, মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী যে প্রাণীটি, সেই ঘোড়ার লাগাম ধরে শারীরিক শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চাকে, পশুকে বশ করার মানুষী আধিপত্যবাদের বাহাদুরিকে, যে প্রাতিষ্ঠানিক মোহময়ী রূপ দিয়েছিল ইউরোপীয় সার্কাস, তার আকর্ষণের বলরেখায় আবেশী গোটা বিশ্ব। মুগ্ধ বিস্ময়ে শুধু দেখেই যাচ্ছিল ভারত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি থেকে রানি ভিক্টোরিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সিপাহী বিদ্রোহত্তর ভারতের শরীর চর্চার সংস্কৃতি বিভিন্ন প্রাদেশিক মার্শাল আর্ট আর পথেঘাটে মাদারি কা খেল। সার্কাসের মতো কোনো সংগঠিত শিল্পের পরিসর গড়ে ওঠে নি। রাজন্যবর্গের হাততালি ও উপহারের ডালি জুটলেও, না ছিল সার্কাসীয় পরিকাঠামো, না ছিল উদ্যোগ। বোরিবন্দরের ক্রিসমাস রাতের সার্কাসের রিঙে চিয়ারিনির চ্যালেঞ্জ ও তাঁর অশ্বারোহণের নানা কসরতের আভিজাত্যের সেই মায়াবী কয়েক ঘণ্টা সার্কাসের বীজ বুনে দিয়েছিল ভারতীয় মননে, যার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সেদিন দর্শকাসনে বসে থাকা বিষ্ণুপন্থ ছত্রের হাতে। সময়ের চলমানতায় সে চারাগাছ ক্রমশঃ বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, ছায়া দিয়েছে, ভরসা জুগিয়েছে। ভারতের প্রান্তিক জনজীবনকে দিয়েছে আশ্রয়, জীবনযাপনের রসদ।
চিয়ারিনির চ্যালেঞ্জ, ভারতীয়দের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সেই অবজ্ঞার শব্দগুলো, বিদ্ধ করল কুরুন্দওয়াদের রাজা বালাসাহেবকে। বন্ধু টিল্লুকে বললেন, ছত্রে এই সাদাটার চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না? ছত্রে বললেন- আগে দেখি, তারপর প্রত্যুত্তর।
চিয়ারিনির চাবুক হিসহিস শব্দ তুলল। তেজি ঘোড়াগুলি রিঙে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। বেজে উঠল ড্রাম। তালে তালে নাচ দেখাতে শুরু করল ঘোড়াগুলি। তাঁবুর দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ল চিয়ারিনির সার্কাসের জাদুতে।
ছত্রে চ্যালেঞ্জটা নিলেন। মনিব বালাসাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে উঠে দাঁড়ালেন-
আমি কুরুন্দওয়াদ রাজ্যের এক অশ্বপ্রশিক্ষক। এমন একটি প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাওয়ার জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ আমরা । মহারাজ বালাসাহেবের সম্মতিক্রমে আপনার চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করলাম। আপনার দেওয়া ছ’মাস নয়, তিন মাসের মধ্যেই আমি আমার ঘোড়াগুলিকে নিয়ে আপনার মতোই খেলা দেখাতে পারব। আর যদি না পারি, তবে প্রতিজ্ঞা করছি, ব্রিটিশ-ভারতীয় মুদ্রায় দশ হাজার টাকা আপনাকে দেবো, সঙ্গে দশটা ভালো জাতের ঘোড়া। আপনি বললেন বছরের পর বছর লেগে যাবে ভারতের মাটিতে ভারতীয় সার্কাসের জন্ম হতে, আমি বাজি ধরছি, এক বছরের মধ্যেই আমি ভারতীয় সার্কাসদল তৈরী করব আর সে দল নিয়ে যাবও আপনার দেশে।
তাঁবুর ভারতীয় দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। রাগে লাল হয়ে গেলেন চিয়ারিনি এক নেটিভের ঔদ্ধত্য দেখে।
ব্রিটিশ ভারতে কিছু দেশীয় রাজ্য ছিল যার শাসনব্যবস্থা ছিল ব্রিটিশ মুকুটের আনুগত্য ও কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া ভারতীয় শাসকদের হাতে। এমনই একটি রাজ্য মহারাষ্ট্রের জামখান্দি।বিষ্ণুপন্থের জন্ম আঙ্কাখোপ গ্রামে। পিতা মোরেশ্বর ছত্রে ছিলেন জামখান্দি রাজকোষের কোষাধক্ষ্য। কোনো এক ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ায় তাঁকে সে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। আশ্রয় ও জীবিকা মিলেছিল আর এক দেশীয় রাজ্য কর্ণাটকের রামদুর্গে। বিষ্ণুপন্থ থেকে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রেই। ছোটোবেলা থেকে বিষ্ণুপন্থের পায়রা, বাঁদর, কাঠবিড়ালি নিয়ে দিন কাটে, তাদের ধরে এনে পোষা, খাওয়ানো, দেখভাল করা, খেলা করা। পড়াশোনায় মনোযোগ বিশেষ নেই। একটু বড়ো হলেন যখন, পশুপাখির পাশাপাশি ঘোড়ার নেশা ধরল। আর পড়লেন সঙ্গীতের নেশায়। অন্যান্য ছেলেদের মতো তাঁর ছেলেরও গতানুগতিক জীবন চেয়েছিলেন বিষ্ণুপন্থের বাবা। ঘড়ে বেঁধে রাখার জন্য বিয়ে দিয়ে দিলেন ছেলের। বিষ্ণুপন্থ তখন ষোলো বছরের কিশোর। বিয়ের পর বাবার সুপারিশে রামদুর্গ রাজপ্রাসাদের ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ জুটে গেল। মনের মতো কাজ। পাশাপাশি চলল সঙ্গীতচর্চা। কিন্তু বেশিদিন সেই আস্তাবলের কাজে থাকা হলো না। ঘোড়া ও সঙ্গীত নিয়ে আরও চর্চার ইচ্ছেয় একদিন পালালেন রামদুর্গ ছেড়ে। দু’মাস ধরে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করে পৌঁছলেন মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে। সেখানকার রাজপ্রাসাদের ঘোড়ার আস্তাবলে জুটিয়ে ফেললেন একটা কাজ। সে আস্তাবলে ঘোড়ার চিকিৎসক ও প্রশিক্ষক বাবাসাহেব আপ্তের কাছে শিখতে লাগলেন ঘোড়াদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মেজাজমর্জি, চিকিৎসার খুঁটিনাটি, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। একসময় জুড়ে গেলেন কুরুন্দওয়াদের রাজা বালাসাহেব পটবর্ধনের সঙ্গে।
ক্রিসমাসের রাতের সেই সার্কাসীয় তাঁবুতে চিয়ারিনির ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কুরুন্দওয়াদে ফিরে প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন ছত্রে । বালাসাহেবের আস্তাবল থেকে বেছে বেছে কয়েকটি ঘোড়া নিয়ে শুরু করে দিলেন তালিম।
১৮৮০-র ২০শে মার্চ। অর্থাৎ চিয়ারিনির চ্যালেঞ্জের তিন মাসের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করল ছত্রের সার্কাস। আমন্ত্রণপত্র পৌঁছাল সম্ভ্রান্তদের কাছে, পাঠানো হলো চিয়ারিনির কাছেও। কুরুন্দওয়াদ রাজপ্রাসাদের মাঠে ভারতের প্রথম সার্কাস- গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাস। উদ্বোধন করলেন বম্বের গভর্নর জেমস ফারগুসেন।
ছত্রে চেয়েছিলেন চিয়ারিনির সামনেই তাঁর খেলা দেখাতে। চিয়ারিনি তখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ ঘুরে কলকাতায়। বোম্বের বোরিবন্দরের সেই প্রদর্শনীর পর তাঁর প্রতিটি ক্যাম্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রভূত আর্থিক ক্ষতি নিয়ে কলকাতায় তাঁবু ফেলেছেন। কলকাতাও মুখ ফিরিয়ে নিল। দলের অধিকাংশ শিল্পী তখন দেশে ফিরে যাবার জন্য উদগ্রীব। সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে যাবার মতো অর্থ চিয়ারিনির কাছে নেই তখন। সেই সময় চিয়ারিনির সঙ্গে দেখা করতে ছত্রে পৌঁছালেন কলকাতায়। চিয়ারিনির অসহায় অবস্থা তাঁকে কাঁপিয়ে দিলো। সাহায্যের হাত দিলেন বাড়িয়ে। কয়েক মাস আগে যাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণকে এক নেটিভের ঔদ্ধত্য বলে হেয় করেছিলেন চিয়ারিনি, সেই নেটিভ সেদিন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সার্কাসশিল্পের ধর্মে কোনো কাঁটাতার, কোনো গোরা-নেটিভ হয় না।কুরুন্দওয়াদ ও ইচলকরঞ্জির রাজকোষাগার থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে চিয়ারিনির দলের ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন। জাহাজে ওঠার আগে চিয়ারিনি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ছত্রেকে দিয়ে গেলেন তাঁর তাঁবু, কিছু সরঞ্জাম, জীবজন্তু। এবং শুভেচ্ছা।
কিন্তু শুভেচ্ছা জানায়নি চিয়ারিনির সদর দপ্তর যে দেশে, সেই দেশ, আমেরিকা।
গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাসের প্রথম শোয়ের পর ছত্রে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কাছে তাঁবু আছে, কিছু সাজসরঞ্জাম, জীবজন্তুও আছে, কিন্তু নেই লোকবল, নেই প্রশিক্ষিত সার্কাসশিল্পী। ছত্রের স্ত্রী, আভুদাবাঈ পারুলেলকার, ট্রাপিজ শিল্পী হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন, নিলেন পশুপ্রশিক্ষকের দায়িত্বও। ছত্রের সার্কাসের একমাত্র মহিলা শিল্পী। ভারতের প্রথম সার্কাসে প্রথম মহিলা সার্কাসশিল্পীও। ছত্রে রাস্তা থেকে তুলে আনলেন ‘মাদারি কা খেল’-দের। প্রশিক্ষণ দিলেন। বেড়িয়ে পড়লেন তাঁবু নিয়ে। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের শহরে শহরে গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের তাঁবু পড়ল। প্রথম পর্যায়ে সার্কাস সংগঠনের মূল দায়িত্ব নিলেন ছত্রের স্ত্রী। তাঁবু পড়ল বোরিবন্দর রেলস্টেশনের কাছে সেই ক্রস ময়দানে, যে ময়দানে চিয়ারিনির অবজ্ঞা থেকে তৈরী হয়েছিল জবাব দেওয়ার তাগিদ, ভারতীয় সার্কাসের ভাবনা। সেই ময়দানেই ছত্রে পেলেন অভূতপূর্ব সাড়া। এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। রাজা বালাসাহেব ও ইচলকরঞ্জির রাজকোষ থেকে নেওয়া সমস্ত ধারদেনা শোধ করে দিলেন ছত্রে। ছত্রের সার্কাসের বিজয়রথ দেশের মাটি ছাড়ল এবার। প্রথম প্রদর্শনীর চার বছর পর ১৮৮৪ সালে মাদ্রাজ থেকে পাড়ি জমালেন শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, জাকার্তা, ফিলিপিনস, পূর্ব এশিয়ার নানান দেশ। গেলেন জাপান। জাপান থেকে পাড়ি দিলেন উত্তর আমেরিকা। পৌঁছালেন সানফ্রান্সিস্কো। এখানেই পেলেন চরম অসহযোগিতা ও অপমান।
সানফ্রান্সিসকোর প্রবল শীতের মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত গরম পোশাক বা জুতো ছত্রের দলের সদস্যদের ছিল না। পোশাক বলতে সুতির ধুতি, কুর্তা আর কালো মারাঠি টুপি। আর ছিল অদম্য সাহস ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। একদিন সকালে দেখা গেল, কারা যেন সার্কাসের গেটের কাছে রেখে গিয়েছে জুতো আর স্যান্ডেলের পাহাড়। ‘ভিখিরির সার্কাস’ বলে উপহাস মিলল আর মিলল আমেরিকার সার্কাসদলের কাছে প্রবল বাধা।
(ক্রমশ)
