রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৭। অনুবাদে অর্ণব রায়

আগড়পাড়া
আগড়পাড়ার কাছেই একটি জায়গা রয়েছে, দকিনশহর (অবশ্যই দক্ষিণেশ্বর)। আগেকার দিনে জায়গাটায় চিৎপুরের নবাবরা শিকার করত। এককালে ওখানে বাঘ গিজগিজ করত। এখন ওর পাশেই একটা ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রচুর ব্রাহ্মণ বাস করে।
নদীপথ ধরে এগিয়ে গেলে চোখের সামনে একের পর এক ছবির মত সুন্দর জিনিস উদ্ঘাটিত হবে। সুন্দর দেখতে হিন্দু প্যাগোডা (মন্দিরকে গ্রান্টসাহেব প্যাগোডা বলছেন)। তার সামনে টানা বারান্দার দুপাশে একই রকম দেখতে ছোট ছোট মন্দিরের সারি। মন্দিরের মাঝখানে বা চারপাশে তেঁতুল আর অশ্বত্থ গাছের ঘন ছায়া ঢেকে আছে, গ্রাম্য ঘাট, ভাঙাচোরা উঁচু নদীর পাড়, তার ওপর উঁচু উঁচু বাঁশ ও অন্যান্য ভারতীয় গাছের ঘন জঙ্গল নদীর পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর নদী বেয়ে চলতে থাকলেও দুপাশে আর দেখবার মত কিছু নেই। বেশ কিছুটা, মোটামুটি ষোল মাইল যাওয়ার পরে দূর থেকে ব্যারাকপুর মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের সরকারী বাড়ি আর সুন্দর সুন্দর পার্কগুলি দেখা যায়। তোমরা খুব ভালো করেই জানো, এই জায়গাটার প্রতি ভালোবাসার আমার বিশেষ কারন রয়েছে। এখানে এলেই আমার অকালে বিদায় নেওয়া অমায়িক বন্ধু জেনারেল সি—র কথা মনে পড়ে। যাকে সবাই ভালোবেসে ‘দ্য গুড জেনারেল’ নাম দিয়েছিল।(৯) ১৮৪৪ সালে তিনি এই স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন। আর আমি নিশ্চিন্ত হয়েই একথা বলতে পারি ওই সময়টায় তাকে যারা জানত, তাদের একনিষ্ঠ ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম। এই জায়গাটার সাথে আমার এত সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে যে এই জায়গাটার স্বাভাবিক আকর্ষণ আমার কাছে দশগুন হয়ে ধরা দেয়। আর আজ যখন আমি ওই সুখস্মৃতি ভরা ঘাট বা ওই ছড়ানো বাসস্থানগুলো পার হয়ে যাই, যেখানে একসময় আমি এত উষ্ণ আপ্যায়ন পেয়েছিলাম, আমার মনটা কী পরিমান বিষন্নতা আর আফশোসে ভরে যায়, তা তোমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারো।

শিবমন্দির
ব্যারাকপুরের সরকারী আবাসনকে গভর্নর জেনারেলের গ্রামের বাড়ি বা বাগানবাড়ি বলা যেতে পারে। প্রত্যেক শুক্রবার হয় ঘোড়ায় টানা গাড়ি বা জলপথে হলে সুন্দর পানসি বা স্টিমারে টানা বজরায় করে তিনি সেখানে যান। আবার মঙ্গলবার সকালে কলকাতায় ফিরে আসেন। ব্যারাকপুরের বাড়িটা যদিও সাদামাটা দেখতে, কিন্তু বেশ বড়ো আর মজবুত। আর নদীর পাড় থেকে বাড়ি পর্যন্ত বেশ প্রায় এক মাইল ছড়ানো একটা সুন্দর পার্কের শেষপ্রান্তে অবস্থিত।

গভর্নমেন্ট হাউস, ব্যারাকপুর
বড়লাটের বাড়ির সামনের পার্কটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়েই করা। মাঝে মাঝে ঢেউ খেলানো জমি। (জমির এই ঢেউ খেলানো ব্যাপারটা কিন্তু বাংলাদেশে বিরল, আর তাই আমাদের চোখে বেশ আরামদায়ক লাগে)। গোটাটা বড় বড় বৃক্ষের ছায়ায় ঢাকা। এছাড়া সুন্দর সুন্দর বাগানের গাছও চাষ করা হয়। (এই পুরো ব্যাপারটা করা হয় একজন ইউরোপীয় মালীর রক্ষনাবেক্ষণে। তার নীচে একদল দেশী মালী কাজ করে।) বাগানের একটা দিক আলাদা করে রাখা আছে নানারকম পরীক্ষামূলক গাছপালা লাগানোর জন্য। আর গোটা বাগানের এলাকাটাকে সুন্দর সুন্দর রাস্তা এঁকেবেঁকে ছেদ করে চলে গেছে। এই সমস্ত রাস্তা হাঁটা ও গাড়ি চালানো, উভয়ের জন্যই খুব উপযোগী। সমস্ত বাগানটা যে রুচিপূর্ণভাবে সাজানো তাই নয়, সবসময় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়।
নানারকম গাছ, ফুল এবং মনোরম হাঁটার পরিবেশ ছাড়াও (সকালের দিকে এখানে এমন একটা যাকে বলে নির্জনতার মোহ ছড়িয়ে থাকে, যে কেউ এখানে হাঁটাটা সত্যিই উপভোগ করবে) এই পার্কে মনোরঞ্জনের অন্যান্য নানারকম আকর্ষণও রয়েছে।
এই পার্কের পূর্ব দিকের প্রবেশপথের কাছে, যেখানে রাস্তাটা পার্কটাকে গোল করে ঘিরে আছে, সেখানে একটা ছোটমতন চিড়িয়াখানা আছে। সেখানে কিছু সাধারণ জীবজন্তু আর পাখির নমুনা রাখা আছে, যেমন বাঘ, চিতাবাঘ, ভালুক, ক্যাঙ্গারু, বাঁদর আর বসন্তবৌরি জাতের বেশ কিছু অপূর্ব সুন্দর পাখি। রাস্তার উল্টোদিকে খড় আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা গোলমত জায়গা করা আছে যেখানে একটা জিরাফ থাকে। সেখানে একজোড়া খুব সুন্দর উটপাখি আর একটা দৈত্যাকার কচ্ছপও দেখা যায়।
ওই একই রাস্তা ধরে দক্ষিণে পার্কের শেষ কোনার দিকে এগিয়ে গেলে একটা মজবুত করে ঘেরা জায়গা দেখা যাবে। তার ভেতরের দিকটা বাঁশ দিয়ে শক্ত করা, আর কাঁটা দিয়ে খোঁচা খোঁচা করা। এখানে দুখানা পূর্ণবয়স্ক গন্ডার থাকে। এখানেই তাদের জন্য কাটানো পুকুর রয়েছে। এই পুকুর ঘেরা জায়গাটার বেশীর ভাগ অংশ জুড়ে অবস্থান করছে। সকালে গেলে দেখা যাবে গন্ডারদুটো এই পুকুর ছেড়ে উঠে তাদের বিশাল বপু এলিয়ে আরাম করছে।

গন্ডারের জন্য ঘেরা জায়গা
আমি যখন ব্যারাকপুরে ছিলাম, শুনেছিলাম, কিছুদিন আগে এই জন্তুগুলোর মধ্যে যেটা পুরুষ তার হাতে এক হতভাগ্য সেপাই মারা যায়। সেই সেপাই যখন দেখে যে অসাবধানতাবশত জন্তুটা খোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তার দিকেই তেড়ে আসছে, তার ভেতরে বোধকরি মানবিক বুদ্ধিবৃত্তি লুকিয়ে পড়েছিল আর পাশবিক প্রবৃত্তিই জেগে উঠেছিল। যেজন্য সে উন্মাদের মত সেটার মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হয়েছিল কি, তিনজন সিপাই পার্ক দিয়ে হেঁটে আসছিল। হঠাৎ করে তারা লক্ষ্য করে, এখুনি যেমন বললাম, দূরে গন্ডারটা ঘেরা এলাকার বাইরে খোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। — “আরে ভাই”! তাদের মধ্যে যে বয়স্ক আর তুলনায় বুদ্ধিমান সে চেঁচিয়ে ওঠে, “দেখো, লর্ড সাহেবের জন্তুটা এদিকেই ছুটে আসছে। পালাও!” “পালাও!” (হতভাগ্য কমবয়সী সেপাইটি বলে ওঠে। সে বেচারা পালানোর মধ্যে কাল্পনিক কাপুরুষতা দেখতে পায় এবং তার হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য চরম মাশুল দেয়)— “কভি নেহি! যদি ওটা আমাকে মারে, আমিও ওটাকে মারব!”— সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই উন্মত্ত গন্ডার তার ছিন্নভিন্ন লাশ, যেমনটা তোমরা আন্দাজ করছ, সারা বাগানটা টেনে নিয়ে ছুটে বেড়ায়। [1]
গন্ডারদের থাকার ঘেরা জায়গাটা পার করে কিছুদূর যেতে না যেতে বাগানের কোনার দিকে খানিকটা অংশ নিয়ে সুন্দর একটা বাঁশবনের মধ্যে গথিক স্থাপত্যের ছবির মত একটা বাড়ি আছে। এই বাড়িটাকে সবাই লর্ড অকল্যান্ডের স্কুল বলে চেনে। সেই মহান ভদ্রলোক যখন বড়লাট ছিলেন বাঙালী ছেলেপুলের লেখাপড়া শেখার জন্য এই স্কুল স্থাপন করেন। স্কুলে মোটামুটি একশ কুড়ি জন ছাত্র। সকলেই হিন্দু। এখানে তাদের ইংরেজী শেখানো হয়। তাদের নিজেদের ভাষাও শেখানো হয়। ছাত্ররা তাদের পিতামাতার অবস্থা অনুযায়ী খুবই সামান্য মাইনে দিয়ে (একটাকা বা তারও কম) এই স্কুলকে সাহায্য করে। বাকী খরচ দরবার ফান্ড নামে একটি তহবিল থেকে মেটানো হয়।
এই রাস্তা ধরে গোল করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলে রাস্তাটা একটা বিকেলে হাঁটার পথে গিয়ে মেশে। সেই হাঁটাপথ সবসময় নদীর বাতাসে ঠান্ডা হয়ে থাকে। তার একদিক থেকে নদীর পাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে। অন্যদিকে অসংখ্য গাছ ছাতার মত ছায়া দিচ্ছে। জায়গাটা ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর আনন্দে আর বীরত্বে চনমন করছে। সপ্তাহে দুদিন বিকেলবেলা এখানে মিলিটারি ব্যান্ডের অপুর্ব বাজনা শোনা যায়। এতে জায়গাটার আকর্ষণ আরও দুর্নিবার হয়ে ওঠে।
ব্যারাকপুরের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে একসময়ের ডেনিশ বসতি, শ্রীরামপুর। খুব সুন্দর, ছোট্ট, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা শহর। এই শহরের একটা বড় সুবিধে হল, নদীর পাড়ে উঁচু জমিতে অবস্থিত। আর যেহেতু নদীর চওড়া খোলা দিকটা পুরোটা পায়, স্বাস্থ্যকর বলে জায়গাটার সুনামও আছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই জায়গাটা তার অপর পাড়ের প্রতিবেশী ব্যারাকপুরের থেকে কিছুটা এগিয়েই থাকবে।

শ্রীরামপুর
লেখকের টীকা
[1] ১৮৫৮- সাম্প্রতিক বিদ্রোহে দেশী সিপাইদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে, তার মধ্যে একটা দিক অন্ততঃ এখানে যথাযথভাবে দেখানো হয়েছে— মুর্খের বলিদান। সাধারণ বুদ্ধির অভাবে বর্তমানের আরামের জীবন, ভবিষ্যতের উন্নতির সম্ভাবনা, যা তাদের দেশীর বাকী লোকেদের থেকে এগিয়ে রাখতে পারত, সেসব জলাঞ্জলি দেওয়া। এই তিন সিপাই যেন আগেরকার বেঙ্গল আর্মির প্রতিভূ। বয়স্ক বুদ্ধিমান সেপাইটি যেন ৩১ নং, ১৩ নং আর ৪৮ নং রেজিমেন্টের প্রতিনিধি, লখনৌ এবং স্যাঙর-এর ঝামেলার সময় এরা নিজেদের সসম্মানে সরিয়ে রেখেছিল। উন্মত্ত গন্ডারটি হল উন্মত্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। আর এই গোঁয়ারগোবিন্দ সেপাইটি হল বিদ্রোহের সেই সব সেপাই যারা তাদের নিরেট মাথা নিয়ে ব্রিটিশদের সাথে টক্কর নিতে গেছে আর মানসম্মান খুইয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে।
অনুবাদকের টীকা
৯। জেনারেল সিঃ খুব সম্ভবত জেনারেল হেনরি চার্লস কটন।
(ক্রমশ)
