সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ১০। বরুণদেব

0

গত পর্বের পর

ভাস্কো দা গামার অভিযান ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে ইউরোপের যে  বাণিজ্য পথ খুলে দিয়েছিল সেই পথ ধরে একে একে ভারতে ঢুকতে শুরু করে ডাচ, ব্রিটিশ, দিনেমার, জার্মান, ফরাসী, সুইডিশ, নানা ইউরোপীয় জাতি।  ১৬০২ সালে ইস্ট ইণ্ডিজে বাণিজ্য করার জন্য বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক কোম্পানি ডাচ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তৈরী হলে ব্যবসা বণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতের সমুদ্রপথে ডাচেদের প্রবেশ। ১৬০৪ সালে কালিকটের জামোরিন রাজার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি দিয়ে ডাচেদের বাণিজ্য অভিযান শুরু। এরপর অন্ধ্র প্রদেশের মছলিপত্তনমে প্রথম ডাচ বাণিজ্যকুঠি তৈরী হলো। সংঘাত বাধল পর্তুগীজদের সাথে। মাদ্রাজের কাছে নাগাপাত্তিনাম দখল করে নিল ডাচেরা পর্তুগীজদের কাছ থেকে। মালাবার উপকূলে বেশ কিছু পর্তুগীজ দুর্গ দখল করে নিল। তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে ডাচ বাণিজ্যকূঠি স্থাপিত হলো, স্থাপিত হলো গুজরাটের সুরাট, কেরালার কোচিতে। গোলমরিচকে ইউরোপে বলা হতো কালো সোনা। সে ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করল ডাচরা। একশো বছরের পর্তুগীজ আধিপত্যের সমুদ্র বাণিজ্যে থাবা বসাল ডাচরা। ভারতবর্ষের মশলা বাণিজ্যের রাশ ডাচেদের হাতে এলো।

১৬০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার সনদ পেয়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যতরী ঢুকল ভারত মহাসাগরে। পরবর্তী দুই দশকে সিয়াম, কাম্বোডিয়া, জাপানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হলেও ভারত ভূখণ্ডে বাণিজ্য করার ব্যাপারে  তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিন্তু বাজার মহাদায়। পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সিল্ক ও সুতির কদর। ইংরেজদের উলেনের বাজার জমল না। ফলে উইলিয়াম হকিন্সের জাহাজ নোঙর করল মুঘল আমলের জমজমাট বন্দর সুরাটে। বাণিজ্যের সম্ভাবনা ইংরেজ জলযানের পালে হাওয়া লাগালো। আগ্রায় জাহাঙ্গীরের দরবারে স্যার টমাস রো  বিবিধ সুবিধাজনক শর্তে এদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি আদায় করে নিলেন। ভারতের পশ্চিম উপকূলের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য বন্দর সুরাটে তৈরী হলো প্রথম বাণিজ্যকুঠি। চার বছর পর মুসলিপত্তনম। এরপর জেলেদের ছোট্ট গাঁ মাদ্রাজ। আমেদাবাদ, ক্যাম্বেতে তৈরী হলো বাণিজ্যকুঠি। সংঘাত বাঁধল ডাচদের সাথে। জয় হলো ইংরেজদের।

১৬৬১ সালে ডাচেদের কাছে প্রায় সমগ্র মালাবার অঞ্চল হারিয়ে যখন পর্তুগীজরা প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে, সেই বছরই পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথেরিনের সঙ্গে ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের শুভ বিবাহ। আরব সাগরের তীরের সাতটি দ্বীপ তখন পর্তুগীজ দখলে – বোম্বাই, মাজাগাঁও, পারেল, ওরলি, মাহিম, কোলাবা ও লিটিল কোলাবা। এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে বারোশো মাইল দূরে বসে পর্তুগালের রাজা কন্যাপণ হিসাবে এই সাতটি দ্বীপ তুলে দিলেন ইংলণ্ডের রাজপরিবারের হাতে। এর সাত বছর পর রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে গলার কাঁটা মনে হওয়ায় এই দ্বীপপুঞ্জের স্বত্ত্ব ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বার্ষিক দশ পাউন্ডের বিনিময়ে প্রদান করলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। অনেক টালবাহানার পর পর্তুগীজদের হাত থেকে সে দ্বীপপুঞ্জ হাতে এলো ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির।

ভৌগোলিক কারণে মহারাষ্ট্রীয় অশ্বারোহীদের বা পর্তুগীজ বা ডাচ জলদস্যুদের সাগর বেষ্টিত এই অঞ্চল আক্রমণ করা  কিছুটা অসুবিধাজনক। শিবাজীর হাতে লুন্ঠিত হওয়া তাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র সুরাটের বদলে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বোম্বেকে বেছে নিল পশ্চিম ভারতে তাদের বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসাবে। বাণিজ্য কুঠি নয়, নগর তৈরীতে হাত লাগাল তারা। জেরাল্ড অঙ্গিয়ারের নেতৃত্বে কলকাতার অনেক আগে বোম্বেকে ঘিরে হলো নগরায়নের পরিকল্পনা।

জেলেদের গ্রাম বোম্বাই। পলাতক আর ভবঘুরেদের আস্তানা। গ্রামে জেলেদের কিছু কুঁড়েঘর। পর্তুগীজ আমলে তৈরী  মাহিম আর বান্দ্রার চার্চ। সমুদ্রপথে পর্তুগীজ ও মুঘলদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য বোম্বে দুর্গের কাজ শেষ করা হলো। স্থাপিত হলো সেন্ট থমাস ক্যাথিড্রাল। জাহাজঘাটা তৈরী হলো। টাঁকশাল হলো। শহরের আইন শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য ছ’শো পুলিশ নিয়োগ করা হলো। কোর্ট বসল।একজন বিচারক এলেন। মানুষের জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখার আশ্বাস দিলো এ শহর। দিলো নিজ নিজ ধর্মাচরণের অধিকার। পার্সিদের জন্য টাওয়ার অফ সাইলেন্স, ফায়ার টেমপেল, মুসলিমদের জন্য মসজিদ, ইহুদিদের জন্য সিনাগগ তৈরী হলো। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী ও কারিগদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল বোম্বে। মুঘল পাঠান,পর্তুগীজ দেশি বিদেশি ক্ষমতার কাছে নীপিড়িত মানুষদের এ শহর ছাদ দিলো। বণিকদের উৎসাহ দেওয়া হলো বোম্বেতে এসে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য, তাদের জন্য  ব্যবস্থা করা হলো বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার। শ্রমের বিনিময়ে জীবন ও জীবিকার হাতছানি দিলো এ শহর।

ইহুদি, গুজরাটি, শিয়া, পার্সি, থেকে ব্রাহ্মণরা, নানা সম্প্রদায় এলো শহরে। মহারাষ্ট্রের চাউল থেকে রেশম তাঁতিরা এলো, তাদের জন্য বাড়ি করে দেওয়া হলো। পার্সিরা এসে নিজেদের বাড়ি বানাল, জাহাজ বানাল। কচ্ছ থেকে, দিউ থেকে, সুরাট থেকে বেনিয়ারা  এলো। চাউল থেকে ভাণ্ডারী, মাদাগাস্কার থেকে আফ্রিকান, রাজস্থান থেকে ভাটিয়া, নানা জাতি বোম্বেতে বসবাস করতে লাগল।

১৬৭০-এ পার্সি বণিক ভিমজী পারিখ প্রথম প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে এলেন। ১৬৬১ থেকে ১৬৭৫ এর মধ্যে জনসংখ্যা দশ হাজার থেকে বেড়ে হলো ষাট হাজার। ১৭৩৫-এ জাহাজ তৈরী শুরু হলো বম্বেতে। ভারতীয় ও ব্রিটিশ বণিকদের সমাগমে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে বম্বে চাল, আইভরি, কাপড়, লেড, তরবারির ব্লেড ও আরও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে উঠল। বোম্বে থেকে ভারতের অন্যান্য বন্দরগুলির  পাশাপাশি মক্কা, বাসরা বিভিন্ন আরব শহরে ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বোম্বে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য নগরী হয়ে উঠল।

উনবিংশ শতাব্দীতে এসে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া অঞ্চলে অ্যাপোলো বন্দর দিয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ চালু হলো। স্থাপিত হলো ব্যাঙ্ক অফ বোম্বে। ১৮৪৫ এর মধ্যে সাতটি দ্বীপের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হলো। দেশের তৃতীয় মেডিকেল কলেজ গ্রান্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল তৈরী হলো বোম্বেতে। প্রথম কটন মিল দ্য বোম্বে স্পিনিং এন্ড উইভিং কোম্পানি স্থাপিত হলো। সিপাহী বিদ্রোহের বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই বোম্বেতে প্রতিষ্ঠিত হলো বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৬১তে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমে সুতোর চাহিদা বেড়ে যায়। বোম্বেতে বয়নশিল্পের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে।  সুয়েজ খাল খুলে গেলে বোম্বের সমুদ্রপথে ব্যবসা বাণিজ্যে জোয়ার আসে। ভারতের প্রথম রেলপথও বসল এই বোম্বেতেই।

১৮৪৪ সালে লন্ডনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাছে ভারতে রেলব্যবস্থা প্রচলনের প্রস্তাব পেশ করলেন আর এম স্টিফেন্সন। পরবর্তীকালে ইনিই ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। লর্ড হাডিঞ্জ তখন ভারতের গভর্নর জেনারেল। তিনি কলকাতা থেকে দিল্লী রেলপথের পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। ততদিনে ইংলণ্ডে রেল চালু হয়ে গিয়েছে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনের কর্মকর্তাদের সাথে ভারতের গভর্নর জেনারেলের মত বিনিময়ে উঠে এলো- ইংলন্ডের রেলওয়ে ব্যবস্থায় মুনাফা আসে যাত্রী পরিবহন থেকে, পণ্য পরিবহন থেকে নয়। ভারতের মতো গরীব দেশে যাত্রী পরিবহন থেকে মুনাফা উঠে আসার সম্ভাবনা কম। ভারতে যে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে সেগুলিকে বাজারজাত করা ও তা থেকে মুনাফা অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় দ্রুত ও সস্তার পরিবহণ ব্যবস্থা। কাজেই সেই স্বার্থে রেল ব্যবস্থা চালু করা উচিত ভারতে। রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকেও ভারতে রেলব্যবস্থা ভীষন জরুরি বলে লর্ড ডালহৌসি তাঁর গভর্নর জেনারেলের মেয়াদকালে বারবার মত প্রকাশ করেন লণ্ডনে কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে। লণ্ডন থেকে পরামর্শদাতা এলেন এ দেশে রেলব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্যে। স্থির হলো, পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে কলকাতা থেকে দিল্লি রেলপথ তৈরী হবে।

ওদিকে বোম্বের নাগরিক সমাজ বোম্বে থেকে ভোরঘাট পর্যন্ত রেলপথের দাবি জানালেন। গুরুত্বের সঙ্গে তা বিবেচনা করা হলো। লণ্ডনে কোম্পানির ডাইরেক্টররা ঠিক করলেন, বাংলার সাথে সাথে পরীক্ষামূলকভাবে কম দূরত্বের রেল বসানো হবে মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রদেশেও। বাংলায় এ কাজের দায়িত্ব পেল ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি, মাদ্রাজে মাদ্রাজ রেলওয়ে কোম্পানি আর বোম্বেতে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিন্সুলা রেলওয়ে কোম্পানি। লর্ড  ডালহৌসি  কলকাতা দিল্লীর রেলপথকে আগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বললেন। পাশাপাশি বোম্বের রেলপথও জরুরি বলে মনে হলো তাঁর।

১৮৫১ সালে বোম্বে থেকে থানের মধ্যে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হলো। যদিও রেলপথের অগ্রাধিকার ছিল কলকাতার, কিন্তু বোম্বে পেল প্রথম ট্রেন । বোম্বের নাগরিকরা  জনসভা করে চাপ বাড়াচ্ছিলেন সরকারের ওপর। কলকাতায় এই ধরনের কোনো সেন্টিমেন্ট তৈরী হয় নি। আবার লিভারপুল কটন ইন্ডাস্ট্রির চাপ ছিল গ্রেট ইণ্ডিয়ান পেনিন্সুলা রেলওয়ে কোম্পানির ওপর যাতে বোম্বের রেলপথের কাজ দ্রুত শেষ করা যায়।

১৬ই এপ্রিল, ১৮৫৩। বোম্বের যে অঞ্চলে রেল স্টেশন তৈরী হলো,সেই অঞ্চলের নাম বোরিবন্দর। সমুদ্রের কাছেই। স্টেশনটি কাঠের তৈরী। প্ল্যটফর্মের ওপর ম্যাট পাতা।সূর্যের আলো আড়াল করার জন্য চারিদিকে সাদা পর্দা টাঙানো। নানা রঙের কাপড়, পতাকা দিয়ে সাজানো স্টেশন চত্বর। প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে আঠারোটা পতাকা, তার মধ্যে ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ নিয়ে অহংকারী ইঞ্জিন। বোম্বে শহরে সেদিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বোরিবন্দর থেকে চারশো যাত্রী ও চোদ্দটা কামরা নিয়ে থানের দিকে রওনা দিলো ভারতের প্রথম ট্রেন। ৩৪ কিলোমিটারের যাত্রাপথ। নিমন্ত্রিত দেশি ও বিদেশি অতিথি অভ্যাগতদের নিয়ে একুশটা গান স্যালুটের মধ্যে দিয়ে বিকেল তিনটে পঁয়ত্রিশ মিনিটে ছাড়ল ভারতের প্রথম রেলগাড়ি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকল বোরিবন্দর।

আর ছাব্বিশ বছর আট মাস পর এই বোরিবন্দর অঞ্চল সাক্ষী হয়েছিল আর এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরে বোরিবন্দর রেল স্টেশনের কাছে ভারতের মাটিতে প্রথমবার তাঁবু ফেলে চিয়ারিনির রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাস, যে তাঁবুতে ক্রিসমাসের রাতে জন্ম নেয় ভারতীয় সার্কাসের সংকল্প।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply