অকূলের কাল। পর্ব ৪২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

কা তব পন্থা

কীভাবে, কোন পথ ধরে সেদিন হস্টেল থেকে নরজিতের কোয়ার্টারে এসে পৌঁছেছিল জানে না ক্ষিতি। রাস্তাঘাট বাসট্রাম বাড়িঘর – কিচ্ছু দেখছিল না সে। মনের জগৎ আর অভ্যাসের জগৎ যেন দুই ভিন্ন মেরু। অভ্যাস তাকে নির্ভুলভাবে ফিরিয়ে এনেছিল ডক লেবার বোর্ডের কোয়ার্টারে। কিন্তু দৃশ্যমান জগৎ থেকে বহু দূরে মনোজগতের রিক্ত অন্ধকারে তাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ফোনে বলা দোলনের বাক্য তিনটি। দেওয়া মানে সমর্পণ – তাই তো জানে এবং হৃদয় দিয়ে মানে ক্ষিতি। সে কি ফিরিয়ে নেওয়া যায়! মনোজগতের সেই অনন্ত, গহন অন্ধকার থেকে মুক্তি চাইছিল সে, পথ কোথায়? প্রতারক, প্রবঞ্চক নিষ্ঠুর এই জীবনকে ত্যাগ করাই কি সেই পথ নয়?

ত্যাগ করার কথাটা ভাবা খুবই সহজ, করা ভীষণ কঠিন। জল নেবে না তাকে, জ্ঞান থাকতে আগুনে দগ্ধ হওয়ার জ্বালা ভয়ংকর, ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলে পড়ার উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া দায়; এই আবাসনের ছাদে ওঠার সিঁড়িও নেই যে সেখান থেকে ঝাঁপ দেবে। হৃদয়-বেদনার আপাত-লাঘবের জন্য সে কলম হাতে ঝুঁকে পড়ল কাগজের উপরে। কবিতা কি-না জানে না ক্ষিতি, শব্দে শব্দে কষ্টকে মুক্ত করার চেষ্টা করে গেল সারা রাত। ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে যে-ঘুম এল, টানা চব্বিশ ঘণ্টা পরে সে বিদায় নিল। অন্য এক ভোরে যে-ক্ষিতি জেগে উঠল, তার মন তুলনায় শান্ত, দোলনকে বাদ দিয়েও জীবনে যে থাকা যায়, সেই সম্ভাবনা মাথায় উঁকি দিতে শুরু করেছে।

তার ঘুমের মধ্যেই কোয়ার্টারে দুজন অতিথি এসে হাজির। তাদের মধ্যে ছোটখাটো শ্যামবর্ণ মলিন চেহারার লোকটি তার সামান্য পরিচিত। তালডাংরা বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম বিধায়ক মোহিনী পন্ডা। তুলনায় সামান্য লম্বা, বেজায় রোগা এবং কালো লোকটির নাম, রঞ্জিত বলল, সত্যকিঙ্কর দাসমোহান্ত। রঞ্জিতের গ্রামেই তার বাড়ি। শিক্ষিত লোক, স্কুলের মাস্টার আর পার্টি-অন্ত প্রাণ। খুব ভাল বক্তা আর মোহিনীবাবুর অনুগত প্রিয়ভাজন।

বিধানসভার অধিবেশন থাকলে মোহিনীবাবু আসেন। সিদ্ধার্থ রায়ের গেরিলা কায়দার নির্বাচনী কৌশলও মোহিনীবাবুকে হারাতে পারেনি তালডাংরা কেন্দ্রে। তবে এই নির্বাচনের পর থেকে পার্টির যে-গুটিকয়েক মাত্র বিধায়ক, তাঁরা বিধানসভা বয়কট করে চলেছেন। তবুও মোহিনীবাবুকে ঘন ঘন আসতে হয় হাইকোর্টে চলা ভাগচাষিদের মামলার তদ্বির করতে। সেসব মামলায় পার্টির অ্যাডভোকেট মনসুর হবিবুল্লা। মোহিনীবাবু পার্ক সার্কাসে তাঁর চেম্বারে কাজ সেরে সেদিনই ফিরে যাবেন গ্রামে। সত্যকিঙ্কর থেকে যাবে। সে আইন পড়তে ল কলেজে ভর্তি হবে। মাঝে মাঝে নরজিতের কোয়ার্টারে থেকে ক্লাস করবে, বাকি সময় পড়াশুনা, পার্টির কাজ, মাস্টারি।

ক্ষিতি যখন ঘুমে, তখনই মোহিনী-সত্যকিঙ্করকে দোলন-ক্ষিতির ট্র্যাজিক আখ্যান বিস্তারিত শুনিয়ে দিয়েছে রঞ্জিত। বিধায়ক নাকি বলেছেন, জোতদার বাড়ির ছেলে তো – এদের মন এঁটেল কাদার মতো। একবার বসে গেলে উঠতে চায় না। চিন্তা করতে হবে না, সময় নেবে মেয়েটাকে ভুলতে, তবে সামলে উঠবে ঠিক। ক্ষিতি ভাবে প্রেমে ওঠা-পড়ার এই অভিনব বিশ্লেষণ সে কোথাও পড়েনি। এ কি তবে বিশুদ্ধ মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ!

দিন তিনেকের মধ্যেই সত্যকিঙ্করের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল ক্ষিতির। তার থেকে হয়তো বছর দশ-বারো বড় হবে বয়সে। বিবাহিত, দুই মেয়ের বাবা। ইকনমিকসে অনার্স। কথার যাদুকর। ভিজে ভিজে গলার আওয়াজ। মনে হয় তার কথার সঙ্গে লালা নিঃসরণও চলতে থাকে সমানে। কিন্তু এমন নয় যে তা মুখের বাইরে গড়াবে। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বলেই বোধ হয় তার বাচনভঙ্গি এক ধরনের বিশিষ্টতা পেয়েছে। বক্তা হিসাবে সুনাম অর্জনের সেটা একটা কারণ হতে পারে। রাজনীতি, অর্থনীতি আর আইন নিয়ে সে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারে। নরজিতের ধারণা, খুব অল্প দিনের মধ্যেই সত্যকিঙ্কর পার্টির বড় নেতা হয়ে উঠবে।

রাজনীতিতে ক্ষিতির আগ্রহ কম। তবু যে অল্প সময়ের মধ্যেই সত্যকিঙ্করের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হলো তার কারণ বোধ হয় নারী-পুরুষের প্রেমতত্ত্ব নিয়েও সে কম সরব নয়। তার বারো বছরের পুরনো বউয়ের সঙ্গে তার প্রেম ফিকে না হয়ে কীভাবে প্রগাঢ় হচ্ছে দিনে দিনে – সেই তত্ত্বও সে পার্টিলাইন বোঝাবার মতো করেই বুঝিয়ে দিল ক্ষিতিকে।

সপ্তাহ খানেক পরে দোলনকে হারানোর বেদনা সামান্য ফিকে হতেই ক্ষিতি সচেতন ভাবে চেষ্টা করতে লাগল প্রেমকে মাথা থেকে সরিয়ে প্রাত্যহিকীর স্বাভাবিকতায় ফিরতে। টিউশন, পড়াশুনায় মগ্ন হতে হবে কাল থেকে। সত্যকিঙ্কর বলল, – ঠিক। তবে তার আগে চলো আজ খিদিরপুরে ইভনিং শোয়ে একটা সিনেমা দেখে আসি।

জামা-প্যান্ট পরে বেরোতে যাবে, অবাক হয়ে দেখে কোয়ার্টারে ঢুকছে শাড়ি পরা এক মেয়ে। তার মুখের দিকে তাকাতেই ক্ষিতি হাঁ! এ তো জলি! সামান্য হাঁফাচ্ছে সে। ফেব্রুয়ারির যাই-যাই শীতেও তার কপালে ঘাম। খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। ক্ষিতি কৌতূহলী, আশঙ্কিতও কিছুটা – জলিকে খাটে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, – তুমি এই ঠিকানা খুঁজে পেলে কীভাবে? এতদূর – কষ্টও তো হয়েছে খুব। হস্টেলে –

শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জলি বলল, –এমনি কি আর আসি এতদূরে অজানা একটা জায়গায়! না এসে উপায় ছিল না যে!

সত্যকিঙ্কর ততোক্ষণে এক গ্লাস জল এনে জলির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিনা বাক্যে জলি ঢকঢক করে শেষ করল গ্লাসের জল। ভালোই তেষ্টা পেয়েছিল, বোঝা গেল। হাতের উলটো পিঠে ঠোঁটের জল মুছে জলি বলল, – শুধু জানতাম ডক লেবার বোর্ড হাসপাতালের কোয়ার্টারে আপনি থাকেন। বাকি সম্বল আপনার নাম। কোয়ার্টারে পৌঁছতে অসুবিধে হয়নি। তারপরে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে প্রতিটি কোয়ার্টারে জিজ্ঞেস করে চলেছি – ‘ক্ষিতি নামে কেউ থাকে’?

আবাসনের দুটো দোতলা বিল্ডিঙয়ে মোট ষাট খানা কোয়ার্টার। জলির পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা আর হেনস্থা অনুভব করতে পারছিল  ক্ষিতি। সত্যকিঙ্কর যথারীতি কথার খই ফুটিয়ে জলির কৃতিত্বকে যখন বাহবা দিচ্ছে, তাকে হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে জলি বলল, – গত সপ্তাহে পুতুল ফোন করে আপনাকে যে-কথাগুলো বলেছে সেগুলো ওর নিজের কথা নয়, ওর বড়বউদি সামনে বসে থেকে বলিয়েছে। সেদিন থেকেই কষ্টে ছটফট করছিল বেচারা। অথচ আপনাকে জানাতে পারছিল না। আজ সকালে ভাগ্যিস গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করতে। তখনই চিঠিতে সব লিখে আমার হাতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, – যেভাবে হোক এই চিঠিটা আজ ওর হাতে পৌঁছে দে। এই এতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে, আমাকে খারাপ ভেবে কী করেছে, করছে –  না জানতে পারলে আমি বাঁচব না রে!

ব্লাউজের ভেতর থেকে পুতুলের চিঠিটা বের করে ক্ষিতির হাতে দিল জলি। সে মুখে যা বলল সেটাই লিখেছে দোলন। অতিরিক্ত এই যে ওই বাড়িতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষিতি যেন যেভাবেই হোক তাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে যায়।

নিমেষেই ক্ষিতির মনে জোয়ার। প্রাণ বাজি রাখতে হয় রাখবে সে। বিনিময়ে দোলনকে নিজের কাছে আনবেই। কিন্তু পন্থা? সত্যকিঙ্কর যেন বোতলমুক্ত জিন – পক্ষীরাজ এনে হাজির করল ক্ষিতির সামনে। দেশে আইন আছে কী করতে! স্ত্রী আসতে চায় স্বামীর কাছে। তাকে আটকাবে কে! বিয়ে যে হয়নি? হয়েছে কি হয়নি সে বিচার হবে আদালতে। চিন্তার কারণ নেই। মনসুর সাহেব আছেন, সেই দায়িত্ব সত্যকিঙ্করের। আউটলাইন বাতলে দিল সে, সেই অনুযায়ী গল্পটা তৈরি করতে হবে ক্ষিতিকে।

শোনা মাত্র ক্ষিতি পৃথ্বীরাজ। দুর্গে বন্দিনী সংযুক্তা। টগবগ টগবগ ক্ষুরের আওয়াজ এগিয়ে আসছে ক্রমশ।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply