রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্‌ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৬। অনুবাদে অর্ণব রায়

0

গত পর্বের পর

নতুন শ্মশানঘাটে মড়া পোড়ানো চলছে

 

কয়েক বছর আগে কলকাতার এক খবরের কাগজে একটা খুব সুন্দর লেখা বেরিয়েছিল। সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে চাঁদা তুলে একটা তহবিল বানানো হোক। সেই টাকায় শুধু দরিদ্র হিন্দু নয়, বিত্তবান হিন্দুও তাদের মৃতদেহ যেভাবে তাদের সুবিধে মনে হয় সৎকার করতে পারবে। শহরের শৌচ ব্যবস্থার দিক থেকে দেখতে গেলেও এতে সুবিধে হবে। এই প্রবন্ধে আরও দেখানো হয়েছিল, এই পদ্ধতিতে একটি মৃতদেহ সৎকারের খরচ দুটাকার মধ্যে সেরে ফেলা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কাজের কাজ কিছুই হল না। বরং সৎকার তহবিল গঠনের বদলে পুলিশ করল কী, ঘাটের ধারে ধারে কয়েকটা নৌকো রেখে দিল। সে সব নৌকো ডোমেদের। তাদের কাজ হল গঙ্গাবক্ষে কিছু অপ্রীতিকর দেখতে ভেসে থাকলে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলা। আর এই সরিয়ে ফেলার কাজ বলতে তারা যা করে তা হল জিনিসগুলোকে ডুবিয়ে দেওয়া। আর এই ডোবানোর কাজটি সারা হয় যত নৌকোর সারি আছে, সব সামনে দিয়ে ওগুলোকে দেখতে দেখতে চলে যাওয়ার পরে। কখনও কখনও তো কোনও কোনও হতভাগার দেহাংশ কোনও জাহাজের নোঙরের শেকলে বা কোনও স্টিমারের পাখনায় জড়ামড়ি অবস্থায় পাওয়া যায়। অর্থাৎ, চোখের তো শান্তি হল, পেটের অবস্থা যা-ই হোক না কেন। একথা কে অস্বীকার করবে যে এই শয়তানকে দীর্ঘদিন এক জায়গায় আটকে রেখে আদরযত্ন করলে তা জলের দূষণ আর অশুদ্ধতার উৎস হয়ে উঠবে! আজ যদি সরকার এই ডোমেদের নৌকার বন্দোবস্তটা তুলে দিয়ে সেই টাকাটা সৎকার তহবিলে পাঠিয়ে দিত, তাহলে সেই তহবিলে কম টাকা জমা পড়ত না [1]

যাইহোক, এই বিষন্ন জায়গা থেকে আমরা এবার সরে যাব। এই জায়গার বাতাস যখন ঘাটের দিক থেকে বয়ে আসে,  এখানকার দৃশ্যের মতই সে-ও কিছুমাত্র আনন্দ বয়ে আনে না।

সামনের দিকে এগিয়ে গেলে শুদ্ধতর বাতাস আর নতুন সম্ভাবনার ঘ্রাণ আমাদের ইন্দ্রিয়কে স্বাগত জানায়। আমাদের যাত্রা শুরুর স্থান থেকে মাইল চারেক এগিয়ে গেলে চিৎপুর, শহরের উত্তরতম সীমা। আর ঠিক চিৎপুরের কাছেই নদীর একই পাড়ে দ্রুত বেড়ে উঠছে প্রথম শহরতলি, কাশীপুর। একসময় এখানে শুধুমাত্র সরকারী অস্ত্র ঢালাইয়ের কারখানা আর মেসার্স হাওড়া, হার্ডম্যান অ্যান্ড কোম্পানী-র আটা মিল আর বিস্কুটের কারখানা ছিল। কিন্তু ইদানিং জায়গাটা শান্তিপ্রিয় অভিজাত পরিবারগুলির আর ধনী ব্যাক্তিদের প্রিয় আস্তানা হয়ে উঠেছে। জায়গাটা থেকে প্রতিদিন সকালে উঠে কলকাতায় চাকরি অথবা ব্যবসার কাজে আসা কোনও সমস্যাই নয়।

কাশীপুরের আরও মাইল তিনেক ওপরের দিকে গেলে নদীর অপর দিকে বালি খালের ওপর একটা সুন্দর ঝুলন্ত ব্রিজ অনেকেরই চোখে পড়েছে। তার কাছেই একখানা স্কুল আছে। ১৮৪৬ সালে স্থাপিত। আমার বিশ্বাস মূলতঃ উত্তরপাড়ার দুই দেশীয় ধনী ব্যাক্তি, বাবু জয়কিষণ মুখার্জী আর বাবু রাধাকিষণ মুখার্জীর উদার কর্মকান্ডের ফসল। স্কুলে মোটামুটি দু’শো ছাত্র। সকলেই হিন্দু। সাধারণ ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক এখানে শেখানো হয়। তার সাথে শেখানো হয় তাদের নিজস্ব জ্ঞান, বাংলাভাষা। এটি একটি বৈতনিক স্কুল। মোটামুটি ৪০ টি উচ্চবিত্ত ঘরের ছাত্র এখানে পড়ে যাদের মাসিক বেতন দিতে হয় দু’টাকা, বাকীদের এক টাকা করে দিতে হয়। স্কুল রক্ষণাবেক্ষণের খাতে সরকার বছরে অনুদান দেয় ১২০০ টাকা। সমপরিমান টাকা এই দুই বাবু দেন। স্কুলের বাকী খরচ উঠে আসে ছাত্রদের থেকে নেওয়া ফি থেকে। তাও স্কুলের মোট রোজগারের অর্ধেকের বেশী হবে। গড়পড়তা তাও মোটামুটি ২৮০০ টাকা।

শহরের দিকে চোখ ফিরিয়ে নদীর পূর্বপাড়ে আরও মোটামুটি আট মাইল ওপরের দিকে গেলে আরও সুন্দর একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়বে। একটা সাধারণ কিন্তু সুন্দর দেখতে ছোট্ট চার্চ। প্রায় গথিক স্টাইলের কাঠামো। তারই গায়ে লাগা একটা খুব মনোরম দেখতে থাকার বাড়ি আর মিশনারি স্কুল। স্কুলটা দেশীয় আর খ্রীস্টান মেয়েদের পড়ানোর জন্য তৈরী। এই জায়গাটার নাম আগরপাড়া। একজন মহিয়সী নারী, মিসেস উইলসনের দীর্ঘদিনের দৃষ্টান্তস্থানীয় পরিশ্রমের ফল এই স্কুল। শুরুতে এই মহিলা একা হাতে একক পরিশ্রমে এই মিশনটি স্থাপন করেন ও পাশের চার্চটি, যেটিকে খাড়া করতে সেই সময় প্রায় ২৫০০০ টাকা খরচ হয়েছিল, তার জন্য প্রচুর চাঁদা তোলেন। স্কুলটি শুরু হয় ১৮৪৩ সালে। দেশীয় শিক্ষকদের জায়গায় খ্রীস্টান শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, একজন ধর্মান্তরিত খ্রীস্টান এখানকার প্রধানশিক্ষক হয়ে আসেন। আশেপাশে আরও তিন চারটি স্কুল ছিল যারা ইংরেজি শেখানো হত এবং সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাই দেওয়া হত, কিন্তু এই স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। কিন্তু ১৮৪৫ সালে সবকিছু দুম করে বন্ধ হয়ে যায় ।

 

লেখকের টীকা

[1] ১৮৫৮- উপরের কথাগুলো লেখার কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নজরে আনা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, খবরের কাগজের রিপোর্টের যা ফল পাওয়া গেছিল, এখনও তার থেকে আলাদা কিছু হয় না। কিন্তু তারপরেই দিল্লী, মেরঠ, কানপুরে— কোথায় নয়— সর্বত্র এক রাক্ষুসে চিতা জ্বলে ওঠে আর সারা ভারতে যত ইউরোপীয় রয়েছে, তাদের বান্ডিল পাকিয়ে একসাথে সেই চিতায় ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা চলতে থাকে। সেই রাবনের চিতার আলো আর তাপে বাকী সমস্ত পরিকল্পনা অন্ধকারে চলে গেছে।

অবশ্যই হিন্দুশাস্ত্রে মৃতদেহ দাহ করার কথা খুব পরিস্কার আর কড়াভাবে বলা আছে। মৃতদেহকে দাহ করা মৃতের ভবিষ্যৎ পারলৌকিক যাত্রাপথকে সুগম করার জন্য প্রথম কর্তব্য বলে মনে করা হয়। ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, কিছু লোক আর জনজাতি রয়েছে যারা এর ব্যতিক্রম। তারা হল— ১. মৃতাবস্থায় জন্মানো শিশু বা দু’বছরের কম বয়সী শিশু। ২. যাদের কুষ্ঠ বা ওই ধরনের বিশেষ কোনও রোগ হয়েছে। ৩. আত্মহত্যা । ৪. যেসব লোক কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে হিংসার শিকার হয়ে মারা গেছে বা সাপের কামড়ে মারা গেছে। ৫. সে সব লোক কোনও দেওয়ানি মামলায় বা ধর্মীয় মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ৬. এক বিশেষ ধরণের ভিক্ষুক সমাজকে অনুসরণ করে মৃত্যুবরণ করা মানুষ।  ৭. কিছু সাধুসন্ন্যাসী বা তপস্বীর মৃত্যু হলে। ৮. নিম্নবর্ণের হিন্দু তাঁতিদের। এর মধ্যে শিশুদের, সাধুদের আর নিম্নবর্ণের হিন্দু তাঁতিদের দেহ মৃত্যুর পর মাটিতে পোঁতা হয়। আর যাদের কথা ২, ৩, ৪ আর ৫ নম্বরে বলা হয়েছে, শাস্ত্র অনুযায়ী তাদের দেহ জঙ্গলে বা নদীতে ফেলে আসতে হবে, ঠিক কাঠের গুঁড়ির মত, কোনওরকম পারলৌকিক ক্রিয়া না করে। ৭ নম্বরে যে সন্ন্যাসীদের কথা বলা হয়েছে, তাদের দেহ কোনও পাথর বা কাঠের সিন্দুকের মধ্যে রেখে তার সাথে দুটো মাটির পাত্র মাটি দিয়ে ভরে মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে। এই কয়টা কারন ছাড়া মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার আর কোনও কারন নেই, একমাত্র দারিদ্র্য ছাড়া। দেহ দাহ করার জন্য যা যা লাগে, সেই কাঠ, তেল এবং আরও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে না পারার জন্য তারা বাধ্য হয় মুখে সামান্য আগুন ছুঁইয়ে তাদের আত্মীয়ের দেহ জলের হাতে সমর্পণ করতে।

বহু কষ্ট করে বহু গবেষণা করেও যখন এই বর্বরপ্রথার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বিশ্বাসের মানুষদের বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝিয়ে সহমত করা গেল না, তখন বক্তা ধৈর্য হারিয়ে, অন্ততঃ মনে মনে হলেও, কর্পোরাল ট্রিম-এর মত বলে ফেলতেই পারে, ‘বয়নেটের এক খোঁচা দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে’ (লাইনটি লরেন্স স্টার্ন-এর লেখা ১৭৬২ সালে প্রকাশিত ট্রিস্ট্রাম স্যান্ডি -র ষষ্ঠ খন্ডে কর্পোরাল ট্রিমের স্বগতোক্তি থেকে নেওয়া)।

কিন্তু কোনও বিশ্বাসের ওপরে জোরজুলুম না করেও সহজেই বিষয়টার সমাধান করা যায়। প্রথমে যে প্রস্তাবটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা কার্যকর করলেই হয়ে যায়। যাদের মৃতদের দাহ না করে অন্যভাবে পারলৌকিক কাজ সমাধা করতে হবে, তাদের সংখ্যাটা এতই নগন্য যে তার কোনও হিসাবেই আসবে না, যেমন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে জলে ডুবে মরার সংখ্যা কোনও হিসাবে আসবে না। আমাদের কাছে পাকা খবর আছে, ১৮৫৪ সালে শুধুমাত্র কলকাতার উত্তর দিকের একটি ঘাটের থেকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলা মৃতদেহের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ন’শো বিরাশি! আর এই সংখ্যাটা গড়পড়তার থেকে কিছু কমই।

যতদূর জানা যায়, সরকার, ওই যে ডোমেদের নৌকার কথা বললাম, তার পেছনে প্রতিমাসে ৯৭ টাকা করে খরচ করে। এতে করে বছরে খরচ হয় ১১৬৪ টাকা। এই টাকাটা যদি সৎকার তহবিলে দিয়ে দেওয়া হত, তাহলে ঐ সম্ভাব্য ৩৯৮২টা মৃতদেহ সৎকারের এক চতুর্থাংশ খরচ উঠে আসত। আর সরকার যদি এ ব্যাপারে নিজে বেশী খরচা করতে রাজী না থাকে তাহলে ধনীদের ওপরে কিছু কর বসিয়ে দিক। যখনই তারা তাদের বাড়ির মৃতদেহ সৎকারের জন্য আনবে, তাদের সেই কর দিতে হবে। আর সেই করের টাকা এই তহবিলকে পুষ্ট করবে। জনগনের চেতনা আর শুভবুদ্ধি বাকী কাজটা করে দেবে। আর যদি এরকম মনে হয় যে কারোর ওপর জোর করে কর চাপানো হবেনা, সেক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষেরা কারোর থেকে লিখিয়ে নিয়ে আনবে যে তারা দরিদ্র ও এই কর দিতে অপারগ, এবং সেই ঘোষনাপত্র তাদের সঙ্গে রাখবে, তাহলেই হবে।

সুতরাং এমনটা আশা করাই যায়, এমন দিন দূরে নেই যখন এই জঘন্য প্রথা ও তার নক্কারজনক প্রভাব সংখ্যায় অনেক কমে যাবে। ঠিক যেভাবে নিষ্ঠুর সতী প্রথা অনেক কমে গেছে বা সমান নিষ্ঠুর চিরবৈধব্যের যন্ত্রণা সম্প্রতি লাঘব হয়েছে (সতীদাহপ্রথা রদ আইন ১৮২৯, বিধবা বিবাহ আইন ১৮৫৬), লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর সাহস আর একজন মহাত্মার লেগে থাকার কারনেই এটা সম্ভব হয়েছে। আজ একথা নিশ্চিতভাবে বলাই যায় যে এমন কোনও শিক্ষিত বা বুদ্ধিমান ভারতীয় নেই যে অতীতের দিকে পেছন ফিরে হিন্দু বিধবাদের আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারার এই ভয়াবহ প্রথার দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে ওঠে না। ঠিক যেভাবে একজন ইংরেজ অতীতে ইউরোপে ডাইনিদের পুড়িয়ে মারার কথা ভেবে শিউরে ওঠে। ঠিক সেইভাবেই, আজ যেভাবে একজন শিক্ষিত হিন্দু অতীতের ভুলগুলি (যেমন বাধ্যতামূলক বৈধব্য), যা তাদের জীবনে দুঃখ আর কষ্ট বয়ে এনেছে, তার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছে, একদিন একথা ভেবে লজ্জা পাবে যে কীভাবে তারা তাদের আত্মীয়দের মৃতদেহগুলি কাঠের গুঁড়ির মত বা মরা কুকুরের মত নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেই নদীতে যার জল সে পান করে!

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply