কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৮। শোভন সরকার

0
গত পর্বের পর: চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম লাট ভৈরব মন্দিরে। সে এক আশ্চর্য স্থান, নানা বর্ণে বর্ণময় তার ইতিহাস। 

কাশীর ইতিহাসে ১৮০৯ সনের এই ঘটনা ‘লাট ভৈরবের দাঙ্গা’ নামে পরিচিত। শুরুতে সংক্ষেপে আমি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীতেই এই দাঙ্গার ঘটনাক্রম বর্ণনা করব। তারপর আমরা বোঝার চেষ্টা করব কীভাবে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন ঔপনিবেশিক রাজনীতি সাধারণ জনমানসে নিজের প্রভাব খাটিয়েছিল। 

১৮০৯-এর এই দাঙ্গার উৎস খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় কয়েক শতাব্দী। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে কাশীতে আওরঙ্গজেবের দৃক্‌পাত হয়। তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাসন পরবর্তীকালে কাশীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়। কাশীর বেশ কিছু মন্দির তাঁরই উৎসাহে ধ্বংস করা হয়। কেন আওরঙ্গজেব এরকম ধ্বংসলীলায় উদ্যোগী হয়েছিলেন সে বিষয়ে নানা মতভেদ রয়েছে — এই নিয়ে আলোচনা যথাস্থানে করব। 

১৮০৯ সালের দাঙ্গার কেন্দ্রে যে স্তম্ভ সেটি পূর্বে কাশীর মহারুদ্র মন্দির প্রাঙ্গণে ছিল। চুনার পাথরে তৈরি সুউচ্চ,  সুন্দর কারুকাজ ও লেখাজোখাময় ছিল সেই স্তম্ভ। ফরাসি ব্যবসায়ী তথা পর্যটক টেভার্নিয়ের ১৬৬৫ সালে বেনারসে আসেন। তাঁর হিসেবে এই স্তম্ভটি প্রায় বত্রিশ থেকে চৌত্রিশ ফুট উঁচু ছিল। বলা হত সেই সময় নাকি এই স্তম্ভের মূল প্রায় একই রকম দীর্ঘ গভীরতায় প্রোথিত ছিল। 

আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধিদের রোষের শিকার হয় এই মহারুদ্র মন্দির, ধ্বংস করা হয় সেটি, এবং পরবর্তীতে মন্দিরের স্থানে এক মসজিদ তৈরি করা হয়। এত কিছুর মধ্যেও যে কোন কারণে এই স্তম্ভকে অটুট রাখা হয়। মসজিদ প্রাঙ্গণের মধ্যেই সেই স্তম্ভের পুজো চলতে থাকে। অর্থাৎ সেই সময় থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিরপেক্ষভাবে সেই প্রাঙ্গণ ব্যবহার করতে থাকে। 

এর পর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। মাঝের সময়গুলো প্রায় নির্বিঘ্নে ও দুই ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থানে কাটলেও শীঘ্রই ঘনিয়ে আসে কাশীর ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার সময়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকে কোন এক নাগর ব্রাহ্মণ ও হনুমান উপাসক মধু রাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় সে মানত করে যে সে সুস্থ হয়ে উঠলে সেই প্রাঙ্গণে স্থিত হনুমানের কাঁচা মন্দির বদলে পাকা করে দেবে। ঘটনাক্রমে মধু রাই সুস্থ হয়ে উঠলে সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে মাটির মন্দিরের জায়গায় পাথরের মন্দির গড়িয়ে দেয়। যজ্ঞের আগুনে যেন ঘি পড়ল, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুযুধান হয়ে উঠল স্থানীয় মানুষের দুই পক্ষ। অনেকের কাছে মনে হল এত বছর ধরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ যে প্রাঙ্গণ একসাথে ব্যবহার করে আসছে, পাথর বাঁধানো মন্দির সেখানে তৈরি হওয়া মানে সেই প্রাঙ্গণ পাকাপাকিভাবে অধিকার করে নেওয়া। প্রতিবাদে সেই পাকা মন্দির ভেঙে ফেলল স্থানীয় তাঁতি সম্প্রদায়ের মুসলিমরা। সেখানে আশেপাশে আরও যা কিছু পবিত্র বলে মনে করা হত সেসব নষ্ট করা হল। মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ল উত্তেজনার আগুন। এলাকার ক্ষিপ্ত রাজপুতেরা সশস্ত্রে এসে জড়ো হল। তৎকালীন কোতোয়াল এবং ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বার্ড সাহেব এসে পরিস্থিতি সেই মুহূর্তে সামলে নেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভেবে এবং শহরের অন্যত্র গোলমালের খবর শুনে তাঁরা চলে যেতেই উপস্থিত রাজপুত গোষ্ঠী সংলগ্ন ইমামবাড়ায় ভাঙচুর চালায়। ছিঁড়ে ফেলে কোরান। এর প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে প্রবল। স্থানীয় সশস্ত্র মুসলিম তাঁতিরা একত্রিত হয়ে লাট ভৈরব স্তম্ভকে ভেঙে ফেলল, সেখানে জ্বলে উঠল আগুন, কেটে ফেলা হল অশ্বত্থ গাছ। কাটা হল গরু, তার রক্ত ছেটানো হল ভাঙা স্তম্ভে, মেশানো হল ভৈরবের তালাওতে। 

এই প্রসঙ্গে বলি, কাশীর মানুষের বিশ্বাস এই যে এই স্তম্ভের মূলেই কাল ভৈরব তাঁর ভৈরবী যাতনার শাস্তি বিধান করেন। যথাযথভাবেই তাদের কাছে এর প্রতীকি গুরুত্ব যথেষ্ট।  তাছাড়াও তারা বিশ্বাস করে, এই স্তম্ভ ধীরে ধীরে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ঠিক যে সময় এটি সম্পূর্ণরূপে ভূতলে বিলীন হয়ে যাবে, সেদিনই অবসান হবে সমস্ত জাতি-ধর্ম, বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম, অন্যায় ও বিশৃঙ্খলার অন্ধকার ঘিরে ধরবে সমস্ত জগতের অস্তিত্বকে। কাজেই এই স্তম্ভের উপর আক্রমণ ছিল অত্যন্ত গুরুতর। 

সেই ঘটনার রাত্রিতে স্থানীয় রাজপুত ও গোস্বামী সম্প্রদায়ের লোকজন পাল্টা আঘাত হানার আয়োজন করতে লাগল। তাঁতিরা সতর্ক রইল নিজেদের রক্ষা করতে। সারারাত জেগে রইল সমস্ত কাশী। আগে কখনও এমন ভয়ংকর রাত আসেনি কাশীর ইতিহাসে। ধর্মের নামে যে মানুষ কেমন উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে, মনুষ্যত্ব ভুলে যেতে পারে — কাশী সেই রাতে তার সাক্ষী হয়ে রইল।  

সকাল হল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু চারপাশটা রইল গুমোট হয়ে, ঝড়ের আগের অস্বস্তি বরফের মত জমে আসছে যেন অক্টোবরের পরিবেশে। দুপুর হতেই শান্ত পরিবেশে আছড়ে পড়ল সেদিনের প্রথম অভিঘাত। শহরের রাজপুতদের নেতৃত্বে প্রায় হাজারখানেক মানুষ সশস্ত্রে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। দলে যোগ দিয়েছে শ’খানেক গোস্বামী সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে জানাতে মিছিলটি এসে পৌঁছালো আগের দিনের লাটভৈরবের ধ্বংসস্থলে। সমীপস্থ মসজিদে লাগল আগুন, হত্যা করা হল সেখানকার রক্ষণাবেক্ষণকারী সকলকে। কাটা হল শূকর, তার রক্ত ছেটানো হল সেই প্রাঙ্গণে। 

উন্মত্ত জনতা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। একের পর এক ভেঙে পড়ছে নানা উপাসনার স্থল, ভাঙা হচ্ছে ঘরবাড়ি। সেই ভয়ংকর অবস্থায় চারিদিকে কেবল ধ্বংসলীলার চিৎকার, সমস্ত কাশী হয়ে উঠল স্বয়ং মৃত্যুর অবাধ বিচরণভূমি। সেই সন্ধ্যার যেন শেষ নেই, আর্তনাদ আর হাহাকারের শব্দে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল জীবনশক্তির বাঁধ। তৎকালীন কাশীরাজ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন এই দাঙ্গা থেকে। স্থানীয় পুলিশের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে সমস্ত পরিস্থিতি। শহরের ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট চেষ্টা করলেন শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থার সামাল দিতে। গুলি চলল কিছু। অবশেষে উন্মত্ত জনতা পিছু হটল। পরদিন সকালে আরও কোন গোলমাল এড়াতে শহরে বড়সড় সশস্ত্র বাহিনী নামানো হল। এবার কাশীরাজও ব্রিটিশরাজের সাথে সমন্বিত হয়ে কাশীর শান্তি ফেরাতে উদ্যোগী হলেন। শহরের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন রইল মিলিটারি বাহিনী, নিষিদ্ধ হল প্রকাশ্যে কোন রকম অস্ত্র বহন। ধীরে ধীরে শান্ত হল কাশী। 

শেরিং সহ আরও কিছু ঐতিহাসিক বলছেন যে এই দাঙ্গার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বহুদিন ধরে তৈরি হলেও এর বিস্ফোরণ হয় সে বছর হোলি ও মুহররম একই সময়ে পরে যাওয়ার জন্য। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের উৎসব পালন করার জন্য যখন রাস্তায় বের হয়ে মুখোমুখি হল একে অন্যের, মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল দাঙ্গার আগুন।

এই দাঙ্গার বিষয়ে আগ্রহী পাঠকেরা ‘দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, খণ্ড ৬৫’ এর ১০৬ থেকে ১১৯ পাতায় এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ সরকারের কাছে হিন্দু এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে দেওয়া বিস্তারিত বিবৃতি পড়ে দেখতে পারেন। দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বেশ লক্ষ্যণীয়।  

যাই হোক, পরবর্তীতে সমস্ত শহরে সরকারী অনুমতিতে পবিত্র স্থানগুলির মেরামতি হল। লাট ভৈরবের ভাঙা অংশ বর্তমান স্থানে পুনঃস্থাপন করা হল। ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বার্ড সাহেবের তত্ত্বাবধানে সেটি তামার মোড়কে ঢেকে দেওয়া হল। তাই আপনি এখন গেলে আসল স্তম্ভটি আর দেখতে পাবেননা। 

এখন প্রশ্ন হল লাট ভৈরবের দাঙ্গা ঠিক কতটা সাম্প্রদায়িক আর কতটা রাজনৈতিক? এর পরবর্তীকালে এর কতটা প্রভাব পড়ল কাশীর মানুষের জীবনধারায়? এই বিষয়ের উপরে সংক্ষেপে আলোকপাত প্রয়োজন। তবে স্বাভাবিকভাবেই নানা জনের বক্তব্যের মধ্যে অন্তর রয়েছে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সান্দ্রিয়া বি. ফ্রাইট্যাগের আলোচনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply