রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্‌ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৫। অনুবাদে অর্ণব রায়

0

গত পর্বের পর

যাত্রা শুরুর কথা বলতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে ঘাটে, যেখানে সমস্ত নৌকাগুলো এসে জড়ো হয়। আর কোন ঘাটে নৌকার সমাগম সবচেয়ে বেশী হয়, তা খুঁজতে গেলে আমাদের প্রথমেই যে ঘাটের কথা মনে আসবে সেটা হল বাবুঘাট। ঘাট বলতে কিছুই না, কয়েক ধাপ সিঁড়ি জলের দিকে নেমে গেছে। তার ওপরে একটা অনেকগুলো থামওয়ালা চাতালের মত ঢাকা দেওয়া এলাকা। যে দেশীয় ভদ্রলোক এটি তৈরি করেছেন, থামের গায়ে তার নাম খোদাই করা। পাশেই একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ অনেকটা এলাকা জুড়ে ছাতা ধরে আছে। পুন্যবতী হিন্দু মহিলাদের গঙ্গাস্নান সেরে উঠে আসার সময় হাতের তামার লোটা করে জল এনে এই অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় দিতে দেখা যায়। তামার লোটা সবসময় তাদের হাতে থাকে।

বাবুঘাট

 

এখন যেহেতু আমার যাত্রাপথ খুব দীর্ঘ নয় এবং তার দুই তৃতীয়াংশই জলপথে যেতে হয়, বুঝতেই পারছ, আমি পানসি বা বজরা নিই না। সেই একই আরাম একই খরচে পাওয়া যায় যদি একটা ছোট ভৌলিয়া বা এরকম সুন্দর আবহাওয়ায় আরও কার্যকর হয়, যদি একটা দেশি পানসি ভাড়া করে নিই। এগুলি বড় পানসির থেকে আলাদা। এতে দ্বিগুন সংখ্যক মাল্লা লাগানো যায়। আর চারখানা দাঁড় থাকায় অনেক হালকা আর দ্রুতগামী নৌকা। কলকাতার ডিঙি-গুলি, যেগুলি সাধারণত জলপথে বেশী চলাচল করতে দেখা যায়, এই নৌকা তার থেকে লম্বায় চওড়ায় অনেকটাই বেশী। ডিঙি-র তুলনায় এই নৌকাগুলির আর একটি সুবিধা হচ্ছে, এর গলুইয়ের ওপর যে বাতার তৈরি ছই থাকে, সেগুলি দরকার পড়লে খুলে নেওয়া যায়। ইউরোপীয় মানুষদের এতে খুব সুবিধে হয়।

ডিঙি

  আর ডিঙি-র কথা যদি বলতে হয়, আমার বিশ্বাস, অন্ততঃ ফেরিনৌকা হিসেবে এর দিন ফুরিয়ে এসেছে। মানুষ এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বলে যে বহু কষ্ট আর বহু অপেক্ষার পর কলকাতা আর উলটো দিকে হাওড়ার মধ্যে স্টিমচালিত ফেরিনৌকা চালু হয়েছে। এই একটা পথ যেখান দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ যাতায়াত করে [1]। যে লোক এইসব গরীব বেচারাদের ঠাসাঠাসি হয়ে নদী পার করতে দেখেছে, বা যাদের এইসব নৌকার মাঝিমাল্লারা লোভ দেখিয়ে একবার তাদের নৌকায় তুলে পারাপার করতে পেরেছে, বা যাদের দারিদ্র্য তাদের বাধ্য করেছে এই সস্তাতম যাতায়াত ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরতে— তারা প্রত্যেকেই মনেপ্রাণে চাইবে এই স্টিমচালিত ফেরিব্যবস্থা সফল হোক। কেননা এর ভাড়া দরিদ্রতম মানুষেরও সাধ্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। ডিঙিওয়ালা বা অন্যান্য নৌকার ভাড়ার থেকে অনেক কম— আধ পয়সা, যা মোটামুটি এক ফার্দিং-এর থেকেও কম। আর এর সুবিধে শুধু দেশীয় মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বেশ কিছু ইউরোপীয় মানুষ আছেন যারা ঝোড়ো আবহাওয়ায় ওই আরামহীন বিপজ্জনক টিংটিঙে ডিঙির থেকে এই স্টিমের নৌকার ওপর অনেক বেশী ভরসা রাখে। — কিন্তু, এত কথা বললেও মনে রাখতে হবে, আমরা এখনও বাবুঘাট ছেড়ে কোথাও যাইনি।

যাই হোক, বাবুঘাট থেকে একটা ছোট ভৌলিয়া বা পানসি ভাড়া করা গেল যা কিনা আমাদের সুখসাগরে (৮) নিয়ে যাবে। আর তার জন্য আমাকে ভাড়া দিতে হবে ৪ টাকা বা ৮ শিলিং। নৌকাটি ভাড়া করে আমি তার ভেতরে একখানা ভ্রমনের জন্য তৈরি ট্রাঙ্ক চালান করে দিলাম। ট্রাঙ্কের মধ্যে যাত্রাপথের আরামের জন্য কিছু টুকটাক জিনিসপত্র নিতে ভুললাম না। ধার্মিক মাঝিটি যথাবিধি ধর্মাচরণ সেরে সকাল আটটার দিকে ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দিল। এই নৌকাগুলি যারা চালায় তাদের পৃথিবীর গাড়লতম আর অপদার্থতম মাল্লা বললে বোধহয় ঠিক হয়। দাঁড় টানার ব্যাপারে এদের ধৈর্য্যেরও কোনও সীমা নাই। এদের পাল্লায় পড়ে যত দ্রুত যাওয়া সম্ভব, ততটা দ্রুততার সঙ্গে আমরা ঘাটের নৌকার ভীড় ঠেলে স্রোতের মুখে এসে পড়লাম। এরা ধর্মে মুসলমান। কিন্তু বিশেষ কোনও ধর্মবিশ্বাসে আস্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নয়। বরং যা তাদের রোজকার কাজ, তার সাথে এরা আপাদমস্তক বাঁধা। আর সেই কারনেই যুগের পর যুগ তারা একই পদ্ধতি মেনে নৌকা চালিয়ে আসছে। নৌকা চালাতে এমনভাবে বসছে যাতে করে সবচেয়ে কম শক্তি পায় শরীরে, নৌকার দাঁড়গুলো এমনভাবে কুড়ি ডিগ্রি কোন করে নৌকার সাথে বাঁধা যাতে যতই টানাটানি করো, সবচেয়ে কম প্রভাব পড়বে ওগুলোর ওপর। এত কিছু কান্ড করার ফল হচ্ছে, যখন স্রোতের গতি আমাদের অনুকূলে পাঁচ নট প্রতি ঘন্টা আমরা মোটামুটি সাত সাড়ে সাত নট প্রতি ঘন্টা বেগে এগোচ্ছি। বৃথাই কথা বলা, বৃথা ব্যঙ্গ করা, আরও বৃথা আশেপাশের পাড়ের ওপর বাজারগুলোকে দেখানো বা পাশ দিয়ে যে সমস্ত নৌকা দাঁড় টেনে হু হু করে আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে আর তার ওপর বসে থাকা হিন্দুরা আমাদের দেখে হাসাহাসি করছে, তাদের দেখানো। এরা নিজের গতিতেই চলবে।

ডিঙি নৌকার মাঝি

  শহরের ইউরোপীয় অংশ ছাড়িয়ে আর উত্তরদিকে নদীবন্দরের মুখে জড়ো হওয়া অসংখ্য মালবাহী দেশীয় নৌকার ভীড় পার করলে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়বে সেটা একটা ভাঙাচোরা দেখতে চতুস্কোন চত্তর, নদীর দিকে খোলা মুখ, বাকী দিকগুলোয় প্রাচীর দেওয়া। এই প্রাচীরের গায়ে বিরাট মাঠ। আর এই মাঠেই এক কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী কিছু সাফাই আধিকারিককে সঙ্গে করে কলকাতা শহরের মৃত চতুস্পদদের নিয়ে তার সুচারু কাজকারবার চালিয়ে থাকে। আর ওই প্রাচীরের ওপর সারাক্ষণ গোটা পঞ্চাশেক ক্ষুধার্ত শকুন হাঁ করে বসে থাকে। আর নীচে, আবর্জনা আর হাড়ের স্তুপের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় একই রকম ক্ষুধার্ত জঘন্য দেখতে কিছু রাস্তার কুকুর। তাদের সাথে ওই ময়লা ঘেঁটে পাওয়া পুরস্কার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে গোটা কুড়ি দৈত্যাকার সারস।

এই বাড়িটাকে [2] শ্মশানঘাট বলে। হিন্দুরা এই জায়গাটা ঘিরে দিয়ে অন্য জায়গার থেকে আলাদা করে রাখে তাদের মৃতদের দাহ করার জন্য। যখন আমি ‘হিন্দুরা’ বলছি, তখন বুঝতে হবে আমি বলতে চাইছি, যাদের মৃতদেহ দাহ করার ক্ষমতা আছে, তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, হিন্দু সমাজের অর্ধেকের বেশী মানুষ এই ক্ষমতা রাখে না। আর তোমরা ভালো করেই জানো, দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া (খুব অন্ত্যজ শ্রেনীর মানুষ বা সাধুসন্ন্যাসী), হিন্দুরা তাদের মৃতদেহ কবর দেয় না, পোড়ায়। আর তোমরা জানলে অবাক হয়ে যাবে, দরিদ্র হিন্দুরা কীভাবে তাদের মৃতদেহ সৎকার করে। তাদের নদীর পাড়ে খোলা আকাশের তলে ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মরার আগেই মরার জন্য সেখানে এনে ফেলে রাখা হয়, যতক্ষণ না নদীর ঢেউ এসে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর এই নদীর থেকেই কলকাতার বেশীরভাগ অঞ্চলের পানীয় জল সরবরাহ করা হয়! যদিও আমার উদ্দেশ্য গঙ্গাবক্ষে যা যা ভেসে বেড়ায় তার দিকে তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা নয়, বরং তোমাদের সাধারণ মানুষদের থেকে চারপাশ বিষয়ে আর একটু বেশী কৌতুহলী করে তোলা।

 

লেখকের টীকা

[1] ১৮৫৮- এই স্টিমচালিত ফেরিনৌকাগুলি ছাড়াও রেল কোম্পানির ট্রেনের সাথে সময় মিলিয়ে নদী পারাপার করার জন্য খুব ভালো স্টিমারেরও ব্যবস্থা রয়েছে।

[2] ১৮৫৮- আগের কথাগুলো লেখার পর সেই পুরোনো ভাঙাচোরা চতুস্কোন চত্তর কিন্তু আর নেই। এখন তার জায়গায় এক নতুন আর উন্নত বিল্ডিং দাঁড়িয়ে গেছে। আর সেই কারনেই ওপরের ছবিটা আঁকা। সেই কাঁচা চামড়ার ব্যাবসায়ীও সেখান থেকে আরও উত্তরের দিকে সরে গেছে। ঘাটের ধারে সেই শকুন আর সারসের ভীড়ও নেই। ফলে শ্মশানঘাট অচিরেই একটা শান্ত সুন্দর জায়গা হয়ে উঠবে এমন ভরসা করাই যায়।

অনুবাদকের টীকা

৮। সুখসাগরঃ গঙ্গার পারে নদীয়া জেলার চাকদহ-র কাছের ঊনবিংশ শতকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। নদীয়া জেলার নানা প্রশাসনিক কাজকর্মও এখান থেকে হত। গ্রান্টের এই চিঠিতেই দেখা যায় জায়গাটা নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এর নামটিরও কোনও অস্তিত্ব নাই।

Author

Leave a Reply