সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ৮। বরুণদেব
উনিশ শতকের বিশ্বভ্রামণিক জিউসেপ্পে চিয়ারিনি (Giuseppe chiarini)। ৫৮ বছর ধরে সার্কাসের দল নিয়ে চরকির মতো ঘুরেছেন মহাদেশে মহাদেশে- ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বের যেসব অঞ্চলে সার্কাস সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না, সেখানে চিয়ারিনি গিয়েছেন, জয় করেছেন। ফিরে গিয়েছেন যখন, সেখানে তাঁর অনুপ্রেরণায় তৈরী হয়েছে সার্কাসের দল।
চিয়ারিনি পরিবারের শিকড় প্রাচীন ইতালিতে। বৃহৎ পরিবার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভিস্যুয়াল অ্যাক্ট নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই পরিবারের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা থেকে উঠে এসেছে আক্রোব্যাট, রোপড্যান্সার, ব্যালে ড্যান্সার, ঘোড়সওয়ার, পাপেটিয়ার। প্রথম নথিভুক্ত উপস্থিতি ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে। ফ্রান্সের এক প্রাচীন মেলা সঁ লঁরা (saint-laurent)। জার্মান কবি কার্ল ভন হলটেই (Holtei) তাঁর ১৮৯৫ সালে লেখা উপন্যাস ডি ভাগাবুন্ডেনে (Die Vagabunden) অমরত্ব দিয়েছেন এই বংশের ফ্রান্সেস্কো চিয়ারিনিকে, ইনি ১৭৮০ সালে অ্যাক্রোব্যাট ও পাপেটিয়ারদের নিয়ে এক জনপ্রিয় শ্যাডো পাপেট থিয়েটার চালাতেন। তাঁর মেয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক খ্যাতিমান ঘোড়সওয়ার। প্যারিসে অ্যাস্টলে প্রতিষ্ঠিত অ্যাম্ফিথিয়েটার, যা পরে হয়ে যায় ফ্রাঙ্কোনির অ্যাম্ফিথিয়েটার , সেখানে তিনি খেলা দেখাতেন। চিয়ারিনি পরিবারের আরেক শাখার অবদান পারিসের ‘মাইম কোরিওগ্রাফিক চিরিয়ানি কোম্পানি’ যা ১৭১০ এর প্যারিসে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই শাখা থেকে উঠে এসেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রোপড্যান্সার আডেলাইডে চিয়ারিনি (Adelaide chiarini)।
জিউসেপ্পে চিয়ারিনির জন্ম ১৮২৩ এর রোমে। তাঁর বাবা গায়েতানো (Gaetano) ছিলেন একজন ট্রিক রাইডার ও হর্স ট্রেনার। অ্যাডলফ ফ্রাঙ্কোনির ছাত্র গিউসেপ্পে হয়ে উঠেছিলেন এক দক্ষ ঘোড়সওয়ার।
গিউসেপ্পের বয়স যখন ১৬ বছর, ইতালিয়ান আলেসান্দ্রো গুয়েরার (alessandro Guerra) দলের সদস্য হয়ে বেড়িয়ে পড়লেন ভিয়েনা, সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে। সেন্ট পিটার্সবার্গে রয়ে গেলেন এক বছর। ইতিমধ্যে রাশিয়ার প্রথম সার্কাস পল কুজেন্ট (PAUL CUZENT) উঠে এসেছে রাশিয়ার মাটিতে। জনপ্রিয় হয়েছে। এই দলটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে না উঠে ইতালিয়ান দলটি ফিরে এল ভিয়েনায়। ফিরলেন চিয়ারিনিও। এর চার বছর পর চিয়ারিনি পাড়ি দিলেন লন্ডন। সময়টা ১৮৫০। ততদিনে আধুনিক সার্কাসের জনক অ্যাস্টলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাঁর সার্কাসকে বাঁচিয়ে রেখেছেন উইলিয়াম বাট্টি যোগ দিলেন চিয়ারিনি। আর এখান থেকেই চিয়ারিনির কেরিয়ার বাঁক নিল এক অন্য পথে।
বাট্টি আমেরিকান সার্কাস এন্টারপ্রেনার সেথ বি হোয়েসের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে নিউ ইয়র্কে প্যারিসের বিখ্যাত ফ্রাঙ্কনির প্রতিষ্ঠিত হিপ্পোড্রোমকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করলেন। ফ্র্যাঙ্কোনি মারা যাবার পর তাঁর উত্তরসূরিরা তখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন এই হিপোড্রোম। প্যারিস-লণ্ডন-নিউ ইয়র্ক। মালা গাঁথা হলো। ১৮৫৩-র সেই উদ্যোগে চিয়ারিনি অংশ হয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে রিচার্ড সান্ডসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুলে ফেললেন ইটালিয়ান সার্কাস। সেই সার্কাস নিয়ে টুরে বেরিয়ে পড়লেন। ১৮৫৬ নাগাদ খুলে ফেললেন নিজের সার্কাস দল। রয়্যাল স্প্যানিশ সার্কাস। কিউবার হাভানা থেকে বিশ্বজয় শুরু হলো। গেলেন সেইসব অঞ্চলে যেখানে সার্কাস কখনও যায় নি বা কচ্চিত কদাচিত তার পদার্পণ হয়েছে। কিউবা তখন স্প্যানিসদের অধিকৃত। এখানেই চিয়ারিনির সঙ্গে দলবল নিয়ে যোগ দিলেন আমেরিকান ঘোড়সওয়ার জন গ্লেনরি। গ্লেনরি এখানেই ঘোড়ার পিঠের ওপর প্রথম সমারসল্ট দিলেন। ব্রিটিশ অ্যাক্রোব্যাট জর্জ ওরিনের সঙ্গে পার্টনারসিপে তাঁর সার্কাসকে আরও শক্তপোক্ত করে নিয়ে কিউবার দ্বীপে দ্বীপে ঘুরতে শুরু করে দিলেন। ইতিমধ্যে ইয়েলো ফিভারে কাবু কিউবা। বাদ গেল না তাঁর সার্কাসও। তার মধ্যেই সার্কাস নিয়ে গেলেন হাইতি ও দোমিনিকান রিপাবলিক। গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপপুঞ্জ। এই সময়ে তাঁর দলের দুই কিউবান দাসকে মুক্ত করে দিয়ে প্রশিক্ষণ দিলেন অশ্বারোহণ ও রোপ ড্যান্সারের খেলায়। দেশে দেশে যুগে যুগে সার্কাস নিছক বিনোদনের মঞ্চ হয়ে থাকে নি, শৃংখলমোচনের এরিনাও হয়ে থেকেছে। সে এরিনা কখনো প্রাচীন রোমের সার্কাস ম্যাক্সিমাস, কখনো তা উনবিংশ শতাব্দীর রয়্যাল স্প্যানিশ সার্কাস।
অখ্যাত অজ্ঞাতকুলশীল অসার্কাসীয় জনপদে জনপদে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল আটটা বছর। চিয়ারিনির রয়্যাল স্প্যানিশ সার্কাসের ঘরে আর্থিক লাভ ঢুকল। এবার চিয়ারিনি চললেন মেক্সিকো। সেখানে গিয়ে সার্কাস হয়ে গেল ‘রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাস’। সে দলে ইটালিয়ান,স্প্যানিশ, ব্রিটিশ নানা জাতির ফুলে ফুলে গাঁথা এক মালা। মেক্সিকো শহরে তৈরী হলো তিন হাজার দর্শকাসন বিশিষ্ট এক অ্যাম্ফিথিয়েটার। ইউরোপিয়ান মডেলের। পাথরের। মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান-১ এর জন্য এক রয়্যাল বক্স। তারও আগে মেক্সিকোর এক দুর্গে চিত্তাকর্ষক খেলা দেখিয়ে সম্রাটের কাছ থেকে পেলেন প্রচুর উপহার। এর দু’সপ্তাহ পরে মেক্সিকোর রাজপরিবারের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হলো চিয়ারিনির সার্কাসের।
এদিকে মেক্সিকোর রাজনৈতিক আবহ দূষিত হয়ে উঠছিল। বুদ্ধিমান চিয়ারিনি মেক্সিকো ছেড়ে কিউবায় ফিরলেন। কিউবা থেকে চললেন নিউ ইয়র্ক। ওদিকে মেক্সিকোয় বিপ্লব শুরু হলো, ক্ষমতার পালাবদল হল। আর চিয়ারিনির ফেলে আসা অ্যাম্ফিথিয়েটার কিছুদিনের জন্য হল নতুন মেক্সিকোর পার্লামেন্ট। ক্ষমতাই শুধু সার্কাসকে আশ্রয় দেয়নি, কখনো কখনো সার্কাসও ক্ষমতাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আমেরিকা, পানামা ঘুরে গেলেন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফিরলেন মেক্সিকো। ততদিনে মেক্সিকো শান্ত হয়েছে। সেখান থেকে আবার আমেরিকা, আমেরিকা থেকে পর্তুগাল, স্পেন। ঘোড়া ও টাট্টু ঘোড়া মিলিয়ে সংখ্যাটা তিরিশ। ইউরোপ থেকে ফিরলেন আমেরিকায়। আর কখনো ফিরে যান নি ইউরোপে।
চিয়ারিনি এবার পাড়ি দিলেন অন্য প্রান্তে-নিউজিল্যাণ্ড হয়ে অস্ট্রেলিয়া।রয়্যাল ইটালিয়ানে তখন দেড়শো জন সদস্য, ঘোড়া বাষট্টিটি। অস্ট্রেলিয়ানদের মন জয় করে নিলেন চিয়ারিনি। কিন্তু সিডনিতে দলের কিছু সদস্যের সঙ্গে বাঁধল মতবিরোধ। তারা ফিরে গেল আমেরিকা। চিয়ারিনি নতুন করে সাজালেন তাঁর সার্কাস। চললেন বাটাভিয়া, বর্তমানের জাকার্তা।সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। ১৮৭৪ সাল। সিঙ্গাপুর থেকে চিয়ারিনির সার্কাস পা রাখল ভারতে। বম্বে। বীজ বপন হল ভারতের নিজস্ব সার্কাসের ভাবনার, বিষ্ণুপন্থ ছত্রের হাত ধরে যা ভারতের মাটিতে বাস্তবায়িত হলো।
এরপর চিয়ারিনি যখন ব্রাজিলে গেলেন তখন থেকে অতিরিক্ত ঘোড়া বিক্রি করে দিয়ে তাঁর শো-তে বন্যপ্রাণীর প্রবেশ ঘটালেন। দেশে দেশে উৎসাহ বৃদ্ধি পেল। হয়ত সেই দেশে সেই প্রাণীটির দর্শন মেলে না বা কম দেখা যায়। দলে দলে লোকে ছুটল সার্কাসে। দলে ছিল একটি জিরাফ। ব্রাজিলিয়ান ট্যুরের সময় সেটি মারা গেল। ছিল জেব্রা, বাইসন, বাঘ, , সিংহ শাবক, ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শো-এর শেষে বিশাল খাঁচায় হাজির করানো হতো প্রাণীগুলিকে।
ব্রাজিল থেকে পেরু, পেরু থেকে আবার অস্ট্রেলিয়া, সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়া। এবং কলকাতা। সময়টা ১৮৮১। সিপাহী বিদ্রোহত্তর ভারতে ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্তভাবে কায়েম হয়েছে। ভারতে ততদিনে চালু হয়েছে রেল। চিয়ারিনি রেলপথে ঘুরলেন। কলকাতায় তাঁর দলের টাইগার ট্রেনার চার্লস ওয়ার্নার গুটিবসন্তে মারা গেলেন । এরপর যখন চিয়ারিনির সার্কাস মালয়শিয়ায় গেল, কলেরায় চলে গেলেন আরও দু’জন সদস্য। গেলেন ম্যানিলা, চিন। সে সময় চিনে সার্কাস আসত খুবই কম। অ্যাক্রোব্যাটিক থিয়েটারে অভ্যস্থ চিনা দর্শক বিস্মিত হয়ে দেখল ঘোড়সওয়ারের কেরামতি, বাঘকে নিয়ে খেলা। চিন থেকে সিঙ্গাপুর, বার্মা, থাইল্যান্ড , জাপান। চিয়ারিনি তাঁর রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাস নিয়ে আবার ভারতে এসেছিলেন ১৮৮৩-র দিকে। ১৮৮৮ আরও একবার। এপ্রিল ১৮৮৮ তে আগ্রায় তাঁর দলের ঘোড়সওয়ার চার্লস স্টুডলে মারা যান।
চিয়ারিনি বিভিন্ন ট্যুরে দলের কমপোজিসিনে পরিবর্তন করতেন নিয়মিত। চিয়ারিনির বয়স যখন ছেষট্টি বছর, ততদিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সার্কাসকে। ছেষট্টি বছর বয়সেও তিনি সার্কাসের অক্লান্ত ভ্রামনিক। সার্কাস বিক্রি করে দেওয়া বা অবসর নেওয়ার চিন্তা করলেন না। তাঁর কোম্পানিকে পরিণত করলেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। এই বয়সে সাগর পাড়ির ঝুঁকি নিলেন না ঠিকই কিন্তু পরের সাত বছর মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, পেরু র মতো লাতিন আমেরিকান দেশগুলিতে উড়ল তাঁর সার্কাসের ঘোড়ার খুরের ধুলো। ১৮৯৭-এ পানামায় তাঁর সার্কাসের শেষ শো হচ্ছে যখন, তখন চিয়ারিনি তিয়াত্তর। পানামা শহরে হোটেল আমেরিকানোতে শেষ হল এক বিশ্বপথিকের পথ চলা। চলে গেলেন সার্কাসের বিশ্বভ্রামনিক। কপর্দকশূণ্য অবস্থায়। লাভের গুড় বিনিয়োগ করতেন সার্কাসে। চিরজীবন দিন আনি দিন খাইয়ের জীবন তাঁর।
রাশিয়ার জার নিকোলাস ১, মেক্সিকোর ম্যাক্সিমিলিয়ান১, ব্রাজিলের দোম পেদ্রো, জাপানের মিতসুহিতো, সিয়ামের রাজা রাম৫, ভারতীয় রাজা মহারাজাদের, বিভিন্ন সরকারী উচ্চপদস্থ আমলা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর জন্য শো করেছেন। তাঁর রয়্যাল ইটালিয়ান সার্কাস কখনো কখনো হয়ে গিয়েছে রয়্যাল স্প্যানিশ সার্কাস। আবার তাঁর সার্কাস দলের ভিত্তিভূমি আমেরিকা হলেও গিউসেপ্পে চিয়ারিনি আসলে এক বিশ্বনাগরিক। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই তাঁর সার্কাস শেষ হয়ে যায়। তাঁর উত্তরসুরীরা কেউ আর এই জগতে থাকেন নি। বিশ্বজুড়ে জিউসেপ্পে চিয়ারিনি এক শ্রদ্ধার নাম। দর্শকের কাছে। সার্কাসজীবীদের কাছে।
যেখানে যেখানে চিয়ারিনির সার্কাসের ঘোড়া ছুটেছে, তাঁবু ফেলেছ, দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে দিয়েছে সে দেশের মাটিতে। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে সে দেশের সার্কাস-সংস্কৃতি। যেমন ভারতে। ১৮৭৪-র ২০শে নভেম্বরের বম্বে। চিয়ারিনির সার্কাস শো। এই শো থেকেই শুরু ভারতীয় সার্কাসের ভাবনা । সেই ভাবনাকে বাস্তবের সার্কাস এরিনায় নিয়ে এসেছিলেন বিষ্ণুপন্থ ছত্রে।
(ক্রমশ)
