অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৮। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

কিন্তু গ্রাফিতি শিল্পী যখন সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা বা অনুগ্রহ পাওয়া যাচ্ছে না অনুযোগ করেন কিংবা রাত্রিবেলা গ্রাফিতি অঙ্কনের জন্য সরকারি আইনরক্ষকদের সহায়তা চান, অথবা সংকটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞপ্তির মতো সামাজিক বা আইনসম্মত নীতিকথা প্রচার করেন, নতুবা সরকারি দপ্তর বা দেয়ালের মালিকের অনুমতি গ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তখন গণসংগীতকে দেশভক্তিমূলক গান বলে চালানোর প্রচেষ্টার মতোই গ্রাফিতির আত্মা সংকুচিত বেদনায় হাহাকার করে ওঠে।

ভাস্কর ও শিল্পী ধ্রুপদী ঘোষ এক আলাপচারিতায় জানান : ‘ম্যুরাল বা গ্রাফিতির সঙ্গে মিউজিয়াম আর্টের স্পষ্ট ফারাক আছে। ১৯৬৮-র ফ্রান্স বা হালের সিরিয়ার দেওয়ালচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্টই বোঝা যায় এগুলির বার্তা তীব্রভাবে রাজনৈতিক। তাই এগুলি প্রশাসকেরা মুছে দেবেন এটাই স্বাভাবিক। মোছার পরেও আবার রাস্তার দেওয়ালে আঁকা হচ্ছে সেই চিত্র। শাসকের সঙ্গে শিল্পী এই লড়াই এভাবে চলতেই থাকবে নিত্য। কখনই গ্যালারি বা মিউজিয়ামের কমফোর্ট জ়োন প্রত্যাশিত নয় এসব ছবির জন্য।’ ( দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রাগুক্ত প্রতিবেদন)

প্রতিবেদক শিল্পী ধ্রুপদীর এই প্রচেষ্টার কথা আরও বিস্তারে জানিয়েছেন। বামপন্থী ঘরানার এই শিল্পী ও তাঁর সহযোগীরা মুছে দেওয়ার পরেও কলকাতার রাস্তায় বার বার পুরোনো ও চিরায়ত শ্লোগান : ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি ? / এসো তবে আজ প্রতিবাদ (বিদ্রোহ? ) করি’, ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না / তা হবে না তা হবে না’ ইত্যাদি পুরোনো শ্লোগান। কলকাতায় রাস্তায়, দেয়ালে ফ্রি প্যালেস্টাইন নিয়ে লেখার পর তা মুছে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও ধ্রুপদী দেয়াল ভরিয়েছেন রঙে আর রেখায়, তীব্র সচেতনতায়। বোঝাই যায় শাসকের রক্তচক্ষুর বাধাকে অগ্রাহ্য করে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ফিলাডেলফিয়ার গাঙ্ক, লন্ডনের ব্যাঙ্কসি, মুম্বাইয়ের টাইলার, নিউ ইয়র্কের কেইথ অ্যালেন হ্যারিং, ব্রিস্টলের থ্রিডি, নিউ ইয়র্কে তাড়িত এবং আইনের দ্বারা গ্রস্ত অজস্র শিল্পী ― সক্কলের গল্পটা প্রায় তুল্যমূল্য বলা যায়।

বাংলাদেশে ধ্বংস হওয়া স্থাপত্য, দেয়ালচিত্র  বা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাফিতি, শিল্পগুরু জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ মূর্তির নাম ভেঙে দেওয়া, দেয়ালে আঁকা বেগম রোকেয়ার ছবিতে গালি মন্তব্য লিখে দেওয়ার সঙ্গে মুম্বাইয়ে টাইলারকে শান্তিরক্ষকদের প্রত্যহ ধাওয়া করা, গাজায় ইজরায়েলের দেওয়া অবৈধ প্রাচীরের গায়ে গ্রাফিতি অঙ্কনরত ব্যাঙ্কসি ও তাঁর সহযোগী শিল্পীদের গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখানো, দেওয়াল চিত্রণ করতে গিয়ে গাঙ্কের বিপন্নতা, বাংলাদেশে সুবোধ গ্রাফিতির স্রষ্টার খোঁজে গোয়েন্দাদের তৎপরতা দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়া, কিংবা কলকাতার যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ডে অঙ্কিত গ্রাফিতির সঙ্গে দেশবিরোধিতার প্রশ্নটি জড়িয়ে দিয়ে অন্যতম শিল্পী চয়ন সেনকে গ্রেপ্তার (দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইন : ০৪. ০৪. ২০২৫) অথবা শিল্পী ধ্রুপদী ঘোষ ২০০৭ সালে যখন ভবানীপুরে একটি সিনেমা হলের গায়ে সিনেমা হলটি ভেঙে শপিং মল তৈরির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেন তখন পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। (মিন্ট : ২০১০)  অথবা দক্ষিণ কলকাতায় দেয়ালে রঙ স্প্রে করার আগেই কলকাতার শীর্ষস্থানীয় গ্রাফিতি শিল্পী স্রেককে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দলের লোকজনদের মারমুখী ধাওয়া দেওয়া (তাঁর সেই রাতের সঙ্গী ও ক্রু কলকাতার অপর অগ্রণী গ্রাফিতি শিল্পী শাফ যদি সেই অঞ্চলের রাস্তাঘাট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হতেন, তবে সেদিন গুরুতর বিপদ ঘটতে পারতো)। ২০১০ সালের জুন মাসে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে স্বাক্ষরবিহীন গ্রাফিতি ‘মেঘালয়ের রাজ্য সরকার, পুলিশ এবং চার্চকে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার জন্য অভিযুক্ত করে। এটি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করা হয়েছিল এবং রাতারাতি সংগঠিত হয়েছিল।’― এর ফলে মৌলবাদীদের সক্রিয় বিরোধিতাও দেখা দেয়। এই সবকিছুকেই একই ঘটনার রকমফের পূর্বানুবৃত্তি বলা যায়। (ক্যারাভ্যান : ১ আগস্ট ২০১৫)

মানুষের তৈরি যে-কোনো কিছুর মতো গ্রাফিতিরও নেতিবাচক ব্যবহার করা যেতে পারে ― অ্যাবি স্টেইনরকে পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গাঙ্ক। ইতিহাসের, পরিস্থিতির, চলমান ঘটনাবলীর ভুল ব্যাখ্যা, ইতিহাসের ভ্রান্ত ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা, পুরাণকে ইতিহাস বলে চালানোর জন্য অলংকরণকে গ্রাফিতি আখ্যা দেওয়া, শাসকের হাতে তামাক খেয়ে বা শাসকের প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টায় প্রগতিপন্থার কুৎসামূলক বিরোধিতা, কর্পোরেটের সঙ্গে সখ্য ও অর্থলোভে শিল্পের দোহাই দিয়ে গ্রাফিতির বিকৃত ব্যবহারের উদাহরণও কম নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মান ফ্যাসিস্টদের হাতে বইয়ে লাইব্রেরিতে অগ্নিসংযোগ করেছিল, তেমনই সাম্প্রতিকে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার নামে বিপরীত ফ্যাসিবাদী কায়দায় পাঠাগার পুড়িয়ে দেবার ঘটনাও ঘটনাও ঘটেছে।

গ্রাফিতি নিয়ে আর-এক বিপথ এই যে, গ্রাফিতির অর্থবোধ প্রায়শই ইঙ্গিতপূর্ণ, ব্যঞ্জনাধর্মী, প্রতীকী এবং বহুকৌণিক হওয়ায় তার ব্যাখ্যায় একতরফা আরোপন থেকে যেতে পারে। যেমন পূর্ব-কথিত সুবোধচিত্রে দেশের পতাকা জড়িয়ে ধরা বালিকার কথা। প্রাথমিকভাবে এই ছবি দেখে আলোচকের মনে হয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত সুবোধ গ্রাফিতির স্রষ্টা দেশপ্রেমে নিমগ্নতা দেখাতে চেয়েছেন, দেশপ্রেমের বাচালতা বাজারদর পাচ্ছে বলে, শাসকের সন্তুষ্টির প্রহরগুলিকে দেশপ্রেমের দ্বারা সেবা করা যাবে বলে!

কিন্তু এই চিত্র সম্পর্কে ভিন্নমাত্রারই শুধু নয় বিপরীতমাত্রার প্রতিবেদনও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৮ সালে ঢাকার কাকলি অঞ্চলে দেয়ালের ক্যানভাসে পূর্বকথিত এই গ্রাফিতিতে বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরীর অবয়ব, ফ্রেমে বাঁধানো একটি সবুজ-লাল বাংলাদেশের পতাকার ছবি বুকে পরম মমতাভরে জড়িয়ে ধরে আছে সে। ট্যাগ লাইনে সুবোধ গ্রাফিতির ‘হবে কি?’ লেখা। ছবিটি স্টেনসিলে অঙ্কিত। মেয়েটির মুখে শুধু বিষাদ নয়, ছায়া পড়েছে অসহায় ক্লান্তির, কিছুটা নিরুপায়তার, দেশের পতাকা যেন তার শেষ অবলম্বন। তার শরীর ক্ষীণ, প্রসাধনবর্জিত মুখ, পোশাক পারিপাট্যহীন, খাটো চুলগুলিও ঈষৎ অবিন্যস্ত। সব মিলিয়ে যেন বিপন্নতার ছাপ। পাশে শিল্পীর বয়ান ‘দিস ইজ মাই মাস্টারপিস’!

এই অতি নিরীহ গ্রাফিতিটিকে কারোর কাছে (রাজীব দত্ত) অতিরিক্ত বা লোকদেখানো দেশপ্রেমের অবলম্বন, আবার কারোর কাছে বিপজ্জনক বা আপত্তিকর বলে মনে হয়েছিল। বিশেষ করে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে। এমন কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকও সুবোধ গ্রাফিতির এমত সম্প্রসারণের কারণ বুঝে উঠতে পারেননি। গ্রাফিতি যে সামাজিক বা রাজনৈতিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেকথা জেনেও তিনি অবাক হয়েছেন এই ভেবে যে, বাংলাদেশে কেন বা কোন অসঙ্গতির জন্য এমনতর দেয়ালচিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে! এটার মূল কারণ (অসঙ্গতি ও তজ্জনিত ক্ষোভ-বিক্ষোভ ব্যতিরেকে আরও কিছু গোপন কারণ?) নাকি খঁুজে বের করা দরকার। অধ্যাপক আশা করেন এমন সব দেয়ালচিত্র রচনা করা উচিত যাতে জনমনে কোনো ধোঁয়াশার সৃষ্টি না-হয়। তাঁর পরামর্শ ছিল জনমনে প্রশ্ন তৈরি না-করে সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করা উচিত। সঠিক পদ্ধতি মানে কী? রাষ্ট্রের আইন মেনে, প্রশাসনিক অনুমতি নিয়ে, রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতির অনাচার বা কদাচারের কোনো প্রতিবাদ না-করে? অত্যাচার বঞ্চনা কিংবা স্বাধীনতাবোধের ক্ষয়কারী শক্তির কোনো বিরোধিতা না-করে গৃহপালিত প্রতিবাদ!

সুবোধ গ্রাফিতিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মতে রাজনীতির ভিতর কোনো ভীতি সৃষ্টি করতে দেয়ালে এ-ধরনের গ্রাফিতি অঙ্কন করা হচ্ছে। এগুলো প্রোপাগান্ডা, এবং জনসাধারণের মনে ভীতি সৃষ্টি করার কৌশল! সুবোধ গ্রাফিতির রূপকারকে খুঁজে বের করার জন্য ‘চৌখস গোয়েন্দা সংস্থা’কে নিয়োগ করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা এই ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত হয় সরকারের বিরুদ্ধে একটা বিশেষ চক্র এই গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছে! (একুশে ইটিভি-র প্রতিবেদন : ২০১৮) বাংলাদেশে সুবোধ গ্রাফিতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন পার্থপ্রতিম দাস।

 

বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়া, নিচুস্তরের ক্ষমতাসীনেরা, ক্ষমতার সেবাদাসদের একাংশ শুধু সুবোধ গ্রাফিতি নয়, সামগ্রিকভাবে গ্রাফিতি ব্যাপারটিকে, গ্রাফিতি শিল্পীদের গেরিলা স্বভাবকে, রাতের অন্ধকারে অননুমোদিত দেয়ালে দেয়ালে ‘চিকা মারা’র কাজকে সন্দেহ ও সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশও সুবোধ গ্রাফিতিকে পছন্দ করেননি। চট্টগ্রাম সিআরবি এলাকায় সুবোধের ট্যাগে অঙ্কিত গ্রাফিতি (হবে কি?)-তে একটি গাধার পিঠে বিখ্যাত ভাস্কর অগুস্ত রোদ্যাঁর সুপরিচিত ভাস্কর্য দ্য থিংকার-এর ভাবুক চরিত্রটিকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। (সারাক্ষণ : ১১ মার্চ ২০২৫ / করবী শিহাব : বাংলাদেশ টাইমস : ঐ / এনটিভি অনলাইন / ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ / ডেইলি বাংলা পোস্ট অনলাইন / আহমেদ মুনির : প্রথম আলো) ইত্যাদি) গাধার পিঠে এই ভাবুক কে? যে যেমন খুশি ব্যাখ্যা করতেই পারেন। কিন্তু এই ভাবুক সম্ভবত সেই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ব্যঙ্গ যাঁরা সংকটকালে পাঁচিলে বসে সুবিধা ও লাভের হিসেব কষে পক্ষ অবলম্বন করেন। কিংবা সেই বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের গড্ডলস্রোতে গা ভাসিয়ে দেন, কিংবা গাধা যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই নিশ্চেষ্টভাবে চলতে থাকেন। জ্ঞান, বুদ্ধি বা অন্তর্দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও অন্যের দ্বারা নির্বোধের মতো তাঁরা পরিচালিত হন।

ব্যাঙ্কসি বা টাইলারের মতোই সুবোধ গ্রাফিতির ঢেউও কলকাতার কূলে ধাক্কা দিয়েছে। এবং গ্রাফিতি নিয়ে সংশয়ও বহাল আছে।

বস্তুত গ্রাফিতি প্রতিবাদের শিল্পই। কিন্তু সেই প্রতিবাদের অভিমুখ কী হবে, কোন সময়ে, কোন প্রেক্ষিতে, কোন লক্ষ্যে তা রচনা করা হচ্ছে, তার দ্বারা কার কোন কাজের প্রতিবাদ করা হচ্ছে কিংবা কাকে আড়াল করা হচ্ছে সেগুলিও নিশ্চিতভাবেই বিবেচনাযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। শাসকের পৃষ্ঠপোষণায় প্রচারকার্যকেও দেশে দেশে গ্রাফিতি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

রঙ-তুলি, স্টেনসিল, ঢাল-তলোয়ারহীন, অস্ত্রবিহীন, নিয়ত পলায়নপর, কয়েকজন বাণিজ্যসফল বা সাধারণজনের সমর্থনপুষ্ট শিল্পী ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থ-সামর্থ্যহীন, বহুলাংশে রাগী ও ন্যালাখ্যাপা গ্রাফিতি শিল্পীদের ও তাঁদের শিল্পকে শাসক ও কর্তৃপক্ষশ্রেণী এতটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে কেন? আর কেনই-বা সর্বশক্তি দিয়ে তার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়!

এই প্রশ্নটিকে সুমন তাঁর পূর্বতন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করে দেখেছেন। আসলে ক্ষমতা কোনোকালেই শুধু গ্রাফিতি কেন, কোনো বিরুদ্ধতা বা প্রতিবাদী মতকে সহ্য করতে পারে না। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ক্ষমতার কাছে শুধুমাত্র নিজস্ব ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব জাহির করার কলাকৌশলমাত্র। শাসকের মৌরুসিপাট্টা কায়েম করার জন্য নানাপ্রকারের নিত্যনূতন লোভ ও ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে ক্ষমতা ও তার উচ্ছিষ্টভোগীরা সারা বিশ্বজুড়ে প্রহসন ও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ফ্যাসিবাদ’-এ পরিণত করেছে। মহান গ্রাফিতিশিল্পীরা এই প্রহসনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, ক্ষমতার এই দম্ভকেই প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করেন। বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র ও অর্থক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ওপর নজরদারি করা, সর্বদা অদৃশ্য বিপত্তির আশঙ্কা জিইয়ে রাখা, দৈনন্দিন  জীবনযাপনে অন্তর্ঘাত করা, বিবিধ আইনগত ও প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করে দিয়ে ব্যস্ত রাখা ও নিরাপত্তাহীনতার আবহ তৈরি করা, আশঙ্কা বা আতঙ্কের মধ্যে মানুষকে হয়রানি করা এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। প্রধান গ্রাফিতি শিল্পীদের অনেকেই একাধিক গ্রাফিতিক চিত্রের মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন ও এই নিয়ন্ত্রণের চেহারাকে তুলে ধরেছেন।

শেফার্ড ফেইরি একদা এঁকেছিলেন ‘ওবে’, ‘ওবে দি জায়ান্ট’। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী পেশাদার কুস্তগির আন্দ্রে দ্য জায়ান্ট (১৯৪৬-১৯৯৩ / প্রকৃত নাম : আন্দ্রে রেনে রুসিমভ)। জন্ম থেকেই রুসিমভের দৈত্যাকৃতির কারণ ছিল অতিরিক্ত মানব-হরমোনের অস্বাভাবিকতা। জায়ান্টের মুখ ব্যবহার করে শেফার্ড হয়তো ক্ষমতারসের আধিক্যে শাসকের দৈত্যে পরিণত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

আমেরিকা ও বহু ইউরোপীয় শহরে ছড়িয়ে দেওয়া স্টেনসিলে তৈরি এই গ্রাফিতিক রচনায় ফেইরি শেফার্ড নিশ্চিতভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজাতীয়তা, বিভেদমূলকতা এবং নিপীড়নের ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চেয়েছেন। এই কর্তৃত্ববাদ শেখায় ― এটি কেনো, এটি পরো, এটি শেখো, এটি পাঠ করো, এটি করার এটাই সঠিক উপায়, এগুলি তোমার প্রত্যাশা, এগুলি নিয়ম, এগুলির নামই সুখ! ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীর সেই কথা ― ‘বিশ্বাস করুন, মান্য করুন, দেশের জন্য লড়াই করুন।’

জায়ান্টের বহুবলী মুখের নিচে লেখা ‘ওবে’ শব্দটি সেই তথাকথিত দেশপ্রেমের জন্য বাধ্যতামূলক মান্যতাকে তীব্র ব্যঙ্গ করে। ‘ওবে জায়ান্ট’ শেফার্ডের মতে ছিল ‘গণতান্ত্রিকতার শিল্প।’

শেফার্ডের এমনই আর-একটি গ্রাফিতিক রচনা ‘বিগ ব্রাদার ওয়াচিং ইউ।’

বস্তুত শেফার্ড বিগ ব্রাদার চরিত্রটিকে গ্রহণ করেছিলেন জর্জ অরওয়েলের নাইন্টিন এইট্টি ফোর (১৯৪৯ / ১৯৮৪ সালে পুনর্বার প্রকাশিত) উপন্যাসের একটি চরিত্র ‘বিগ ব্রাদার’-এর নাম থেকে। এই গ্রাফিতিক ছবিতে অরওয়েলের দল, রাজনীতি ও কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একরৈখিক সমালোচনার অভিমুখ বদলে দিয়েছেন শেফার্ড। ছবিতে বিগ ব্রাদারের একটি চোখ আর একটি কান। দুটিই খোলা। অর্থাৎ বিগ ব্রাদার তাদের ‘দাদাগিরি’র খবরদারি চালু রাখেন আড়চোখে নজরদারি করে এবং এক কানে আড়ি পেতে শুনে ―মানুষের জীবনে গোয়েন্দাগিরি করে। এই গ্রাফিতিটি স্পষ্টতই মানব ভবিতব্যের একধরনের ভয়াবহতাকে চিহ্নিত করে। শাসকের ভাবাদর্শ অনুযায়ী মানুষের মনে এই ভয় জন্মিয়ে দেওয়া হয় যে, ক্ষমতা তার বহুতর মেশিনারি দিয়ে তাদের ওপর সর্বদা নজর রাখছে। বিগ ব্রাদারের প্রচারণাটি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে একটি ধ্রুবক স্মারক হিসেবে কাজ করে। এখানে ‘ওয়াচিং’ শব্দটি ঘটমান বর্তমান।

শেফার্ড বরাবরই সতর্ক ও ভয়মুক্ত গণতান্ত্রিকতার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি জানিয়েছেন― ‘আই কনসিডার মাইসেল্ফ অ্যান আর্টিস্ট উইথ অ্যান অ্যাজেন্ডা টু ডেমোক্র্যাটাইজ আর্ট। আই ওয়ান্ট টু রিচ পিপ্্ল থ্রু অ্যাজ মেনি প্ল্যাটফর্মস অ্যাজ পসিব্্ল।’ শেফার্ডের অধিকাংশ কাজই মানুষকে উদাসীন বা আত্মতুষ্ট না হয়ে সক্রিয়তা অবলম্বনের বার্তা দেয়, তাদের নিজের নিজের মতাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করে। ) শুধুমাত্র শেফার্ড নন ব্যাঙ্কসি ও ব্লেক লে ব়্যাটসহ বহু গ্রাফিতি শিল্পী বিগ ব্রাদার ও ওয়াচ টাওয়ারকেন্দ্রিক গ্রাফিতি রচনা করেছেন।

জনসাধারণের জীবন ও সক্রিয়তায় ক্ষমতার নজরদারি বিষয়টিকে গ্রাফিতি শিল্পী রনি আহম্মেদ চলচ্চিত্র ও শিল্প-ভাষ্যকার ইমরান ফিরদাউসের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ক্ষমতার ব্যবস্থানিয়ন্ত্রিত তন্ত্রে এক ধরনের বিগ ব্রাদার থাকে, অদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ারের মতো। কুতুব মিনার একধরনের ওয়াচ টাওয়ারই ছিল। আর এখন তো অদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ারের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। রনি বলেন যে, ধরা যাক একটা জানালা রাখা হলো, সেখান দিয়ে আপনাকে দেখা হচ্ছে বা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই ওয়াচ টাওয়ারের বিরুদ্ধে যাওয়াটাই গ্রাফিতি আর্টিস্টের স্পিরিট। এই কারণেই আইনের দৃষ্টিতে গ্রাফিতি অবৈধ, গ্রাফিতি অ্যানার্কিক। গ্রাফিতির বিরুদ্ধ আইন বা নিষেধাজ্ঞা তো আর কিছু নয়, শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতার দিকটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। এই কন্ট্রোলের বিরুদ্ধ যাওয়াটাই আর্ট, নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে বিদ্রোহ। আইন, ভীতি প্রদর্শন―হাতঘড়ি থেকে মিডিয়া―সবকিছু দিয়েই এই নিয়ন্ত্রণ জারি রাখা হয়। নিজেদের স্বার্থ, অর্থ, প্রচার, পদ ও পুরস্কারের লোভে এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নেন বা নিয়ন্ত্রণের ও নিয়ন্ত্রকদের ভজনা করেন―এমন শিল্পীও আছেন। ‘এরা ঠিক শিল্পী নয়, বরং বলা যায় স্লেভ আর্টিস্ট।’ ( দেশের আগামীকাল : ২০১৫)

(ক্রমশ)

……………………………………

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply