অকূলের কাল। পর্ব ৪০। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

আঙ্কিক বেচুবাবু

আজ ক্ষিতি হাইজিন শপের চৌকাঠে উঁকি দিয়েই অবাক। সব শুনশান। কাউন্টারে খদ্দের নেই। চেম্বারের দরজার সামনে বেঞ্চিগুলোতে রুগি নেই। খোদ ডাক্তারবাবু চেম্বারের বাইরে দোকানের মাঝখানে একটা ন্যাড়া চেয়ারে আনমনা বসে আছেন, আর তার সামনে কোনো এক ওষুধ কোম্পানির বেচুসাহেব ডাইনে বাঁয়ে দুলতে দুলতে ইংরেজিতে ওষুধের কীর্তন করে চলেছে, তার দুলুনির সঙ্গে তাল রেখে গলায় ঝোলানো রঙিন ‘টাই’টিও পেন্ডুলামের মতো ডাইনে বাঁয়ে দুলে চলেছে। মওকা পেয়ে গোবেচারা-মুখে দোকানের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বেচুসাহেবের টাই-নৃত্য দেখে ফিক করে হেসে ফেলল ক্ষিতি। ডাক্তারবাবু সেটা দেখতে পেলেন কি-না বোঝা গেল না কিন্তু তিনি বেচুসাহেবকে হাতের ইঙ্গিতে বিদায় জানিয়ে ক্ষিতিকে বললেন, – তোমার আবার কী চাই?

প্রথমেই ‘তুমি’ সম্বোধনে একটু ভরসা পেল ক্ষিতি। যেন নৈকট্য – ‘কী’ এর উপর নয়, ডাক্তারবাবু জোর দিয়েছেন ‘তোমার’ উপরে। এগিয়ে এসে প্রথমেই তার মাথার মধ্যে রেকর্ড হয়ে থাকা – ‘আমরা তিনটে কোম্পানির…’ ইত্যাদি ইত্যাদি আউড়ে দিল ক্ষিতি। তারপর তার ব্যাগ থেকে তিন কোম্পানির ওষুধের ছাপানো তালিকা বের করে তাঁর হাতের কাছে এগিয়ে দিল। উদাসীন চোখে সেদিকে তাকিয়ে অর্ডার বই চেয়ে নিলেন তিনি ক্ষিতির কাছ থেকে। তারপর সেই তালিকার দিকে চোখ রেখে অর্ডার বই ভরতে শুরু করেছেন। ক্ষিতি এমনই অবাক হয়েছে যে তার বুকের লাবডুব লাবডুব বেড়ে চলেছে। অর্ডার বই সেই-যে ভরতে শুরু করেছেন ডাক্তারবাবু, তা যেন শেষ করার ইচ্ছে নেই। পাতার পর পাতা উলটেই চলেছেন । তিনটে তালিকায় যত ওষুধের নাম ছিল তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই প্রায় লিখে ফেললেন তিনি ক্ষিতির অর্ডার বইয়ে। সে মনে মনে ভাবছে ওষুধের দাম বুঝি পাঁচ অঙ্কের সীমা ছাড়িয়ে যাবে! দেখে গোবিন্দ সাহার গোঁফের ঝুল কতখানি বাড়বে ভেবে আকুল হচ্ছে ক্ষিতি। সে অবশ্যই ভাববে, ডাক্তার নয়, নিশ্চিত কোনো জালিয়াতের খপ্পরে পড়েছে ছেলেটা। তাকেও ফাঁসিয়েছে এমন যে চাইলেও সে এড়াতে পারবে না এই লোভনীয় ফাঁসটিকে। পাক্কা সাত সাতটি পৃষ্ঠা জুড়ে ওষুধের বরাত – উত্তরের বিকাশবাবু তার এতদিনের চাকরিতে একদিনও কি আনতে পেরেছে!

সবশেষে ডাক্তারবাবু সই করলেন। দেখার মতো সই – দীর্ঘ, সুছাঁদ কিন্তু দুর্বোধ্য – যেন শুয়ে আছে একটি পাহাড়ি ময়াল। ক্ষিতির গোবেচারা মুখ আহ্লাদে ভরেছিল নিশ্চয়ই, ডাক্তারবাবু বললেন, – এর আগে দেখিনি তো তোমাকে। আসবে আবার, তবে ঘন ঘন এসো না যেন – বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিতির চোখের সামনে ‘হাত ঘুরালেই নাড়ু’র মতো হাতের ভঙ্গি করে নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন। ক্ষিতি তার ডাইরি খুলে ‘হাইজিন শপ’– এর পাশে ব্র্যাকেট দিয়ে লিখে রাখল ‘মজারু ডাক্তার’। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে সামনের দিকে না এগিয়ে পিছন দিকে ফিরতে লাগল। আরও গোটা তিনেক দোকান ঘোরা বাকি ছিল কিন্তু আজকের মতো ঢের হয়েছে, সাহা এই একটা বরাতই সামলাতে পারলে হয়!

দুটো প্রায় বাজে। এখান থেকে হাজরা মোড়, তারপর ডান দিকের রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে বাঁ দিকের গলি ধরে বেশ কিছুটা এগোলে মল্লিকাদের বস্তির ঘর। আড়াইটের মধ্যে পৌঁছনো দরকার। ওদের আতিথেয়তা বাড়াবাড়ি রকমের। ‘মামু’কে না খাওয়ানো পর্যন্ত কেউ বোধহয় খেতে বসবে না।

যা ভেবেছিল তাই-ই। স্বপনদা কী একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছে। বাকি সবাই মামুর অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। যুথি পর্যন্ত। ক্ষিতি নিরামিষ বলে আজ বাড়িতে কেবলই নিরামিষ পদ রান্না করেছেন তার ভুলে-মাসিমা-ডাকা দিদি। গাওয়া ঘি দেওয়া মুগের ঘন ডাল, মাখো মাখো শুক্তো, আলু ভাজা, জমজমে আলুপোস্ত, কাঁচকলার কোপ্তা, ইয়াব্বড় একখানা পোস্তর বড়া আর চালতার চাটনি। রঞ্জিতের দুর্ভিক্ষগ্রস্ত রান্নায় অভ্যস্ত ক্ষিতির রসনায় একেবারে রাজভোজ! তার খাওয়া শেষ হলে মল্লিকা বলল, মামু তুমি একটু গড়িয়ে নাও। আমরা ততক্ষণে খেয়ে নিই।

বড় ঘরের পরিপাটি বিছানা ক্ষিতিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য প্রান্তের ঘরে অদৃশ্য হলো সবাই। শোয়ার ব্যাপারে ইতস্তত করছিল ক্ষিতি। ভরা পেটে শুলে ঘুম জমাট হতে দেরি হবে না। এরা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই হয়। অথচ সাড়ে চারটার মধ্যে তাকে বেরোতেই হবে। বাগরি মার্কেট যেতে কম করে আধ ঘণ্টা। সুবিধে একটাই – এখান থেকে ডালহৌসি যাবার বাস প্রচুর। সময় নষ্ট হবে না। ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমের কবলে।

প্রথম যখন কানে সুড়সুড়ি টের পেল, ক্ষিতি ভাবল স্বপ্ন। কান থেকে নাকের দিকে সুড়সুড়ি গড়িয়ে যেতেই জোর করে চোখের পাতা মেলল সে। চোখ মেলেই দেখে ময়ূরের পালক হাতে যুথি। তার ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি। দোলনের ব্যাপারটা না ঘটলে কী হত জানে না ক্ষিতি। কারণ এখানে এলেই যুথি সুযোগ বুঝে এমন সব কাণ্ড করে যে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তার শরীর উত্তপ্ত হতে শুরু করে। নাঃ! এখানে আসাযাওয়া কমাতেই হবে। তাতেই মঙ্গল, যুথির জন্য কষ্ট হয় ক্ষিতির, মায়ায় জড়ানো সেই কষ্ট।

প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। যুথির দিকে না তাকিয়েই বলল, – আমি বেরোচ্ছি, অফিসে যেতে হবে। দরজার দিকে পা বাড়াতেই অনুভব করল তার কাঁধের কাছে যুথির গরম নিঃশ্বাস। প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ক্ষিতি।

বাসে উঠে খুব খারাপ লাগছিল তার। এত যত্ন করে খাওয়াল, আর সে কি-না কাউকে কিচ্ছু না বলেই পালিয়ে এল মল্লিকার বাড়ি থেকে! জোর করে মন থেকে এই অস্বস্তি সরিয়ে রাখতে আনমনা, ময়াল সাপের সইওলা ডাক্তারবাবুর কথা মাথায় নিয়ে এল সে। তার সাত পৃষ্ঠার ওষুধের ফরমায়েশ দেখে সাহার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটাও ভাবার মতো ব্যাপার।

যা ভাবে ক্ষিতি, তা বাস্তবে মেলে না কখনও কখনও। সাহার প্রতিক্রিয়া সেরকমই অমিল হলো। সম্ভবত মৌসুমির অভিজ্ঞতা মাথায় ছিল তার। অভাবনীয় একবার যদি ঘটতে পারে দুবার ঘটতেও অসুবিধে কী – সন্দেহ, অবিশ্বাস সরিয়ে রেখে নির্ভেজাল খুশির আঁচড় ধরা পড়ল তার চোখের ক্লান্ত পাতায় আর ঝোলা গোঁফে। গোবিন্দ সাহা এমনই। সব সময়েই মনে হয় বহুদিন নিদ্রা হয়নি তার, ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা বহু কষ্টে খুলে রেখেছে; কিংবা ওষুধ বিক্রি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষণিকের জন্য চাঙ্গা দেখাল তাকে। পরক্ষণেই চিন্তাকুল দেখাল তাকে। বলল, – বিকাশবাবুর জ্বর হয়েছে। না সারা পর্যন্ত আসতে পারবে না। এত বড় অর্ডারের বিলটা আমাকেই করতে হবে।

ক্ষিতি বলল, – আমি করে দেব?

সাহার মুখ দেখে মনে হলো এমন আশ্চর্যের কথা সে জীবনে কখনও শোনেনি। বলল, – আপনি! পারবেন?

–খুব পারব। – ক্ষিতির গলায় আত্মবিশ্বাস। মনে হয় একটু ভরসা পেল সাহা। বিল বই একটা বের করে ক্ষিতির দিকে এগিয়ে দিল। টুলে বসে নিজের হাঁটুর উপর বিল বই রেখে অর্ডারের তালিকা দেখে ওষুধ আর তার দাম লিখতে যেটুকু সময় লাগল তার। বাকি বিলের তিন পৃষ্ঠা জুড়ে যোগ এবং সবশেষে এইট পারসেন্ট ট্যাক্স মুখে মুখেই ঝড়ের বেগে যোগ করে সাহার দিকে সই করার জন্য এগিয়ে দিল ক্ষিতি। সাহা ছোট মতো একটা আয়তাকার যন্ত্র ক্ষিতির দিকে বাড়িয়ে ধরার উপক্রম করছিল। এই যন্ত্রটাকে ক্যালকুলেটার বলে। নতুন আমদানি হয়েছে। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করার যন্ত্র। সেটা নেওয়ার আগেই ক্ষিতির হিসেব হয়ে গেছে দেখে সত্যি সত্যিই হাঁ হয়ে গেল সাহা। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সে ক্ষিতির হিসেব ক্যালকুলেটারের সাহায্যে খতিয়ে দেখার পরে প্রায় মিনিটখানেক অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন সে এই ভুবনের অষ্টম আশ্চর্য! এত লম্বা যোগ, তার উপরে আবার শতকরা হিসাব – মুখে মুখে নির্ভুল উত্তর বের করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব! মনে মনে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিল ক্ষিতি। গোবিন্দ সাহা নিশ্চয়ই কোনোদিন পাঠশালায় ‘নামতা হাঁকা’-র কথা শোনেনি!

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply