রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্‌ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৪। অনুবাদে অর্ণব রায়

0

গত পর্বের পর

এতক্ষণে তোমাদের নিশ্চই একটা ধারণা হয়েছে যে এই সমস্ত যাতায়াতের যানবাহনগুলি কী দিয়ে তৈরি বা কীভাবে কাজ করে। এবার বলি, এদেশে যত স্টিমার চলে তাদের সবচেয়ে দূরের গন্তব্য হচ্ছে এলাহাবাদ। এখন এলাহাবাদের দূরত্ব মোটামুটি ৮০০ মাইল। যেতে কমবেশী ২০ দিন লাগে। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীদের ভাড়া পড়ে (খাবার বাদে। খাবার খরচ ৩ টাকা প্রতিদিন) ২০০ টাকা আর এর মধ্যে তুমি ১২ মন বা ৮০০ পাউন্ডের কিছু বেশী ওজনের মালপত্র নিয়ে যেতে পারবে। এই একই রাস্তা সরকারী ডাকগাড়িতে যেতে, তাও ৫৭২ মাইলের সবচেয়ে সস্তা রুট দিয়ে, খরচ পড়বে ২৫০ টাকা ৪ আনা, মাইল প্রতি ৮ আনা (এক শিলিং) প্রায়। তাও যেখানে যেখানে দরকার নিজের পালকির ব্যবস্থা নিজেকে করে নিতে হবে। অথবা ভাড়া নিতে হবে। আর ডাকগাড়িতে কোথাও যেতে হলে যাত্রার তিনদিন আগে জানিয়ে রাখতে হবে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ডাকগাড়িতে যেতে হলে ভাড়া ছাড়াও আরও ১২৫ টাকা সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমা রাখতে হত। যাত্রা শেষ হলে সেই টাকা ফেরত পাওয়া যেত। এখন সেই ক্ষতিপূরণের টাকা জমা রাখার ব্যাপারটা উঠে গেছে। এখন স্টিমারে করে এলাহাবাদ যেতে হলে ২৫০ টাকা বা ২৫ পাউন্ড ভাড়া দিতে হয়। ইংল্যান্ডে সমপরিমান দূরত্ব তোমরা ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে চলে যাও আর এখানে যত পাউন্ড ভাড়া পড়ে প্রায় সমপরিমান শিলিং বা তার চেয়ে কিছু বেশী ভাড়া দিতে হয়।

২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়ার সময় আটজন বেহারা, বাঁকে করে মাল বইবার জন্য দুজন কুলি যারা প্রত্যেকে ৪৮ পাউন্ড করে মাল বইতে পারে, দুজন মশালচি বা মশালবাহক নেওয়ার অনুমতি থাকে। এদেশে রাস্তাঘাটে যাতায়াত করতে গেলে এই কয়টা লোক আর এটুকু সুরক্ষা নিয়ে চলতেই হয়। কেননা রাস্তা কাদা জল আর গর্তে ভর্তি। বড় বড় জঙ্গল মাঝের মাঝেই রাস্তা আটকায়। আর সেই জঙ্গল থেকে বাঘ ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে এসে পড়বে, এরকম সম্ভাবনাও প্রচুর। তোমরা নিশ্চই জানো, এই সব জন্তুগুলো আগুনকে প্রচন্ড ভয় পায়। আগুন দেখলে আর কিছুতেই এগোয় না। যদি ধরো তোমার সঙ্গে মালপত্র এতটাই কম থাকে যে একজন কুলিতেই বইতে পারবে বা রাস্তাটা এমন হয় যে একজনের বেশী মশালচির প্রয়োজন পড়বে না, তাহলে খরচও সেই অনুপাতে কমে আসবে। তোমরা তোমাদের পাশ্চাত্যের কল্পনাশক্তি নিয়ে এই সমস্যাসঙ্কুল যাত্রার কল্পনাও করতে পারবে না। তথাপি, আর কোনও ভালো উপায় না থাকায় শয়ে শয়ে কোমলপ্রাণ ভীত মহিলারা, একটা বাক্সের মত যানের ভেতরে বন্দী হয়ে, সঙ্গে সুরক্ষা দেবার কেউ নেই, কোনও যাত্রাসঙ্গী নেই, রাস্তার ধারে যাত্রীদের জন্য কোনও সরাইখানা এমনকি একটা কুটির পর্যন্ত নেই, এরকম রাস্তা ধরে, শুকনো বালি কর্দমাক্ত মাঠ জঙ্গুলে পথ ধরে পাঁচ থেকে ছ’শো মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে। মাঝে যখনই সম্ভব হয়েছে, দিন হোক বা রাত, সামনে ডাকবাংলো পেলে সেখানে ঘন্টা চারপাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে নিয়েছে। এই ডাকবাংলোগুলো মোটামুটি তেরো-চোদ্দ মাইল পরপর বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। এই সমস্ত বাংলোগুলোয় মোটামুটি তিনজন স্থায়ী কাজের লোক থাকে, একজন খানসামা, একজন বেয়ারা আর একজন ঝাড়ুদার। প্রথমজন তুমি যা বলবে সেই অনুযায়ী খাবার বানাবে, দ্বিতীয়জন ভ্যালেট বা ব্যাক্তিগত পরিচারক হিসেবে কাজ করবে। এই সমস্ত থাকার ব্যবস্থা সুযোগ সুবিধে এই সমস্ত কিছুর জন্য তোমাকে একটি টাকা দিতে হবে। আর যদি তুমি তিন ঘন্টার কম থাকো, তাহলে এই ভাড়া অর্ধেক হয়ে যায়।

এই একই পথ ইকুইরোটাল ক্যারেজ বা ঘোড়ায় টানা টাঙায় যেতে একজন যাত্রীর খরচ পড়বে ৮৮ টাকা, ভেতরে দুজনের দুটো সিটের খরচ ১৪৭ টাকা, দুজন ভেতরে আর একজন বাইরে বসে যেতে হলে খরচ ১৯১ টাকা। প্রতি যাত্রী পিছু ২০ সের বা চল্লিশ পাউন্ড মাল নেওয়ার অনুমতি আছে। সমস্ত পথটা যেতে মোটামুটি এক সপ্তাহ সময় লাগে আর পথে যাত্রীরা খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রামের জন্য ডাকবাংলোগুলিতে থামে।

যাতায়াতের এই ব্যবস্থা বলাই বাহুল্য আগেকার দিনের পাল্কিতে করে ডাক নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকে গতিতে এবং সুবিধায় অনেকটাই ছাপিয়ে গেছে। তবে একথা বলতেই হবে যে এই পদ্ধতিরও কিন্তু নানারকম সীমাবদ্ধতা আর অসুবিধে আছে। যত কমই হোক, সড়কপথে চলতে গেলে কিছু বিশেষ ধরণের দুর্ঘটনা গোটা পৃথিবী জুড়েই ঘটে থাকে। যেমন উঁচু বাঁধের রাস্তা ধরে চলতে গিয়ে পাশে গড়িয়ে পড়ে যাওয়া। খারাপ রাস্তায় ঘোড়া বা গাড়ির কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেল বা ঘোড়ার লাগাম ছিঁড়ে গেল। এখন একই গাড়ি টানতে যদি ঘোড়ার বদলে বারো জন মানুষকে লাগিয়ে দেওয়া যায় তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে কিন্তু গাড়ির গতির সাথে সাথে যাত্রার খরচও হু হু করে বেড়ে যাবে। তখন এই একই পথ যেতে খরচ পড়ে যাবে ২৪৮ টাকা।[1]

নৌকোয় যাত্রা করলে এটা ধরেই নিতে হবে যে নিজের খাওয়াদাওয়ার জন্য যা যা লাগবে তার ব্যবস্থা নিজেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। তা সে পাখির মাংস বা মাছ বা ডিম যা-ই হোক না কেন। রাস্তায় কোনও ধরনের মাংস (নিতান্ত ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চা-টাচ্চা ছাড়া) যোগাড় করা সম্ভব নয়। যদি না কোনও বড় মিলিটারি ক্যাম্প বা বড় শহরে থামা হয়। আর যদি কোনও হিন্দু গ্রামের ধারে নৌকো লাগানো হয় তাহলে পাখির মাংসও পাওয়া যাবে না, কেননা হিন্দুরা পাখি মারে না। তবে একদিনের মত দুধ আর ডিম মোটামুটি নদীর ধারের কোনও কোনও গ্রাম থেকে পাওয়া যেতে পারে। আর পাঁউরুটির জন্যে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা রয়েছে, কপাল ভালো থাকলে পথে সেরকম দু একটা কারখানা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তবে এসমস্ত জিনিস জোগাড় করাও কখনও কখনও খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

বারো জনে টানা একটা বড় নৌকায়, তা সে বজরা হোক বা বড় ভৌলিয়া হোক, এলাহাবাদ যেতে খরচ পড়বে মোটামুটি ৬৫ থেকে ১৮০ টাকা। যেতে সময় লাগবে দুই মাসের কিছু বেশী। নৌকায় একজন যাত্রী থাকুক বা গোটা পরিবার, খরচ একই পড়বে। দেশীয় নৌকা পুটেলি-র কথা আমি ইতিমধ্যে বলেছি। আমি শুনেছি ফেরিঘাটের একজন নৌকোর এজেন্ট মিঃ ব্রিয়ারলি এই নৌকার কিছু রকমফের করে এর মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করে নৌকাটার প্রচুর উন্নতি করেছেন। এখন এটা সবদিক থেকে প্রায় একটা বজরার সমান হয়ে উঠেছে। তবে লোকে বলছে যদিও এই নৌকা করে চলাফেরা করাটা খুবই আরামদায়ক হয়েছে, কিন্তু এই নৌকা ভয়ানক ধীরে চলে। বারোজন মাল্লা এই নৌকা টানে। খরচ নির্ভর করে এর আকারের ওপর। মালের জন্য প্রতি একশ মনে (মোটামুটি সাড়ে তিন টন) তিন টাকা খরচ পড়ে। মাল্লাদের মাসে ৪ টাকা বেতন দেওয়া হয়। একজন অতিরিক্ত লোকও নৌকায় থাকে। তাকে বলে গুলিয়া। সে হল হালের মাঝি, মানে ওই কান্ডারী যাকে বলে আরকি। তাকেও একই হারে বেতন দেওয়া হয়। ধরা যাক একটা মাঝারি মাপের নৌকা, তিনশ মন মাল ধরে, তাতে মোট খরচ পড়বে ১৪৫ টাকা। আর একটা সাধারণ পুটেলি-তে, লোক অনেক কম, গতি অনেক কম, কলকাতা থেকে এলাহাবাদ যেতে খরচ পড়বে মোটামুটি ৭৩ টাকা, সময় লাগবে আড়াই মাস। সবকিছু শুনে এবার বুঝতে পারছো তো যে আমরা রেলগাড়ি আসার জন্য কেন আর কীভাবে দিনরাত প্রার্থনা করছি!

সুতরাং একথা আর বলার প্রয়োজন নেই যে আজকাল নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ আর নৌকায় যাতায়াত করতে চায় না। তবে ছোটখাটো ঘুরতে যাওয়ার জন্য, বা যে সমস্ত জলপথে স্টিমার বা সড়কপথে অন্য কোনও গাড়ি চলে না, বা ডাকগাড়ির খরচ নাগালের বাইরে, সেসমস্ত পথে এখনও নৌকাই ভরসা। আর এই কথা ধরেই আমি আসতে চাই, যেখান থেকে এই সমস্ত যাত্রা শুরু হয়।

 

লেখকের টীকা

[1] ১৮৫৮- আমাদের রেল খুলে যাওয়ার পর এই ট্রানজিট কোম্পানিগুলো তাদের স্টেশনগুলোকে সরিয়ে নিয়েছে। এখন এই ডাকগাড়িগুলি রাণীগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে ছাড়া ট্রেনগুলির যাত্রা যেখানে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু প্রথমে সাঁওতাল বিদ্রোহ আর এখন এই ভয়ানক বিদ্রোহের কারনে এই ডাকগাড়ির টার্মিনাস বোধহয় আরও দেড়শো মাইল পিছিয়ে গেছে। এখন সেখান থেকে দুটো কোম্পানির গাড়ি ছাড়ে। তার মধ্যে ‘হিন্দুস্থান হর্স ডাক কোম্পানি’  যাত্রী নিয়ে রাণীগঞ্জ থেকে এলাহাবাদ যায় সাড়ে চার দিনে আর এতে খরচ পড়ে ১৭২ টাকা।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply