রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল। কোলস্‌ওয়ার্দি গ্রান্ট। পর্ব ৩। অনুবাদে অর্ণব রায়

0

গত পর্বের পর

ইকুইরোটাল ক্যারেজ বা টাঙা এদেশে অনেক পরে এসেছে। এর চারটি চাকার মাপ হুবহু সমান। সেখান থেকেই এই গাড়ির নাম। যতদূর জানা যায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড এলেনবরো (৫) প্রস্তাব দিয়েছিলে একটি দু’চাকার গাড়ি বানানো হোক যাতে করে এই দেশে ডাক ব্যাবস্থাকে আরও দ্রুতগামী করা যায়। সেই প্রস্তাব মাথায় রেখেই মিঃ ক্যামেরন, যিনি কিনা কলকাতার একজন গাড়ির নকশাকার ছিলেন, এই গাড়ির নকশা বানান। এই বর্তমান গাড়িটির নকশা এমনিই যে এগুলি কিন্তু ঘোড়ায় টানবে না। একে টানবে মানুষে। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ডাক বেহারারা। আর তাই এর কাঠামো এতই হালকা হতে হবে যাতে চলতে গিয়ে রাস্তায় বা রাস্তা না থাকায় গাড়িটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়লে এর চাকাগুলো যাতে খুলে নেওয়া যেতে পারে। এর অ্যাক্সেল কাঁধে বওয়ার বাঁকের চেয়ে ভারী না হওয়ায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়াও সহজ। রাস্তা খারাপ হলে করতে হবে কী, এর অ্যাক্সেলটা খুলে নিয়ে তার জায়গায় দুদিক দিয়ে সাধারণ ডান্ডা ভরে দিতে হবে যাতে করে গাড়ির বাহকরা একে সাধারণ ডাক পাল্কির মত বহন করে নিয়ে যেতে পারে। যদিও এখন এই আইডিয়াটা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে আর এই গাড়ি এখন চাকার ওপরেই চলে। কিন্তু সেটাকে কী উপায়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে সেটা নির্ভর করে রাস্তার অবস্থার ওপর। এখন যে রাস্তাটাকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা বেনারস নিউ রোড বলে সেটার ওপর দিয়ে চালানোর সময় এই গাড়িকে ঘোড়ায় টানে। যে রাস্তা পিচ বাঁধানো নয়, সেই রাস্তায় এই গাড়ি মানুষে টানে, কখনও কখনও খুব অল্প ক্ষেত্রে বলদও ব্যবহার করা হয়।

ইকুইরোটাল ক্যারেজ

 

আমাদের সমস্ত পিচবাঁধানো রাস্তা, যাকে এদেশের ভাষায় পাক্কা সড়ক বলে মূলত সামরিক বা অসামরিক জনবসতিতে গিয়ে মেশে। যদিও আমি শুনলাম যে সরকারী উদ্যোগের বাইরেও প্রচুর কাজ হয়েছে। আর একথা তো ঘোষণাই করে দেওয়া হয়েছে যে কৃষ্ণগড় (কৃষ্ণনগর) আর যশোর জেলায় নীলকররা, বিশেষতঃ যারা ফেরি ফান্ড কমিটি –র (৬) সাথে যুক্ত ও সক্রিয় সদস্য, তারা তাদের নিজেদের কারখানার আশেপাশে অনেক অনেক মাইল জুড়ে চমৎকার রাস্তা বানিয়েছে।

যে সমস্ত লোকের অত তাড়াহুড়ো নেই বা যে সমস্ত পরিবারের সঙ্গে একগাদা মালপত্র বা আসবাব রয়েছে, তারা যাতায়াতের জন্য নৌকোর মত পুরোনো মাধ্যমই পছন্দ করে। এখন এই নৌকোগুলি কেমন হবে, তার বৈশিষ্ট্য, আকার আর কতটা আরামদায়ক হবে সেটা সম্পুর্ণভাবে যাত্রীর পকেটের রেস্তর ওপর নির্ভর করে। আমি এখানে সাধারণত ইউরোপীয়রা যে সমস্ত জলযান যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে, সেগুলোরই নাম নিচ্ছি।

জলযানের মধ্যে পানসি সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সুন্দর। তবে সাধারণতঃ এই নৌকা ভাড়ার থেকে ব্যাক্তিগত মালিকানাতেই বেশী দেখা যায়। এগুলি নীলকর বা নীল ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি হয়। আর যখন এগুলোকে কলকাতায় ভাড়া করা হয় তখন মূলতঃ পরিবার নিয়ে প্রমোদভ্রমণ বা কাছেপিঠে কোথাও যাওয়ার জন্যই ভাড়া করা হয়। কেননা পানসি ভাড়া করে দূরে কোথাও যাওয়াটা অত্যন্ত ব্যায়সাপেক্ষ। এই পানসিগুলি বিভিন্ন আকারের হয়। আকার অনুযায়ী এরা বারো থেকে কুড়ি টন মাল বইতে পারে। আর মোটামুটি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফিট লম্বা হয়। এই পানসিগুলি দেখতে অনেকটা স্কুনার বা ছোট পালতোলা জাহাজের মত। স্নানের ঘর ছাড়া এর মধ্যে দুটি কামরা থাকে। বড় বড় পালওয়ালা এই নৌকাগুলিতে বারো থেকে পনের জন মাল্লা থাকে যারা বাতাস না থাকলে দাঁড় টেনে নৌকোটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পানসি

 

বজরা এক ধরণের বড় আর সুপ্রশস্ত নৌকো। কিন্তু অত্যন্ত ভারী আর ধীরগতির। দেখেই বোঝা যায় একে তৈরিই করা হয়েছে আরামের জন্য, গতির জন্য নয়। যাই হোক, এই নৌকা সাধারণত নদীপথে মফঃস্বল বা গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।

বজরা

  ভৌলিয়া হল বজরাই হালকা সংস্করণ। আকারে একটা মাঝারি বজরার থেকে আমাদের সাধারণ যাত্রী চলাচলের ডিঙির মত হতে পারে। এই নৌকা নানারকম সাধারণ কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেরকম যেরকম লোকওয়ালা নৌকা ভাড়া করতে চাও, সেরকম সেরকম আকারেরই পাওয়া যায় (চারজন থেকে আটজন, বা কখনও বড় ভৌলিয়ার ক্ষেত্রে বারোজন পর্যন্ত মাল্লা লাগানো যেতে পারে)। এই নৌকাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। হয়ত মফঃস্বল বা গ্রামের দিকে যেতে হল, বা কোম্পানির বোটানিকাল গার্ডেনে একটা ছোট পার্টি দিতে হল। এইরকম ছোট ছোট আরামদায়ক যাত্রার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ কোনও যাত্রার পক্ষে এই নৌকা বেশ ঠুনকো। কখনও কখনও কোনও উচ্চবংশীয় মহিলাকে নদী পার করার জন্যও সাধারণ ডিঙিনৌকার বদলে এই নৌকা ব্যবহার করা হয়।

ভৌলিয়া

 

নীলকরদের নৌকাগুলিও এরকমই হয়। কিন্তু কলকাতার সাধারণ ভৌলিয়া নৌকার থেকে এগুলি আকারে বড়, লম্বা আর অনেক দ্রুতগামী হয়। এই নৌকাগুলির মাল্লারা সাধারণতঃ ক্ষেতমজুর যারা যখন ক্ষেতে চাষের কাজ থাকে না, তখন দুটো পয়সার জন্য নৌকোটানার মত নানারকম লাভজনক কাজে লেগে পড়ে।

যদিও সমস্ত ভারতীয় নৌকাকে দাঁড় টানার উপযোগী করে তৈরি করা হয়, না হলে পরবর্তীতে দাঁড় টানার ব্যবস্থা করা হয়, তথাপি সমস্ত ভারতীয় নৌকাই মূলতঃ পালতোলা নৌকা। এর তলদেশ গোল বা চ্যাপ্টা যাই হোক না কেন, তলায় ব্যালেন্স করার জন্য যে কাঠের পাটাতনটি দেওয়া হয়, সেটি না থাকলে যদি হঠাৎ হাওয়া ওঠে বা মাঝিমাল্লার অসাবধানতায় খরস্রোতের মধ্যে গিয়ে পড়ে, তাহলে হঠাৎ করে উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। ফলে এখানকার নদীতে হঠাৎ করে ঝড় উঠে বা উত্তর-পশ্চিমী ঝঞ্ঝার সময় নৌকা উলটে লোক মারা যাওয়ার সংখ্যা খুবই বেশী। সাম্প্রতিক যে দুঃখজনক ঘটনাটা আমার মনে পড়ছে, তাতে তেরো জন ইউরোপীয় আর আশি জন দেশীয় লোক প্রাণ হারায়। বাংলার সাধারণ দেশীয় মানুষরা খুবই ভীরু আর শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু এখানকার মাঝিমাল্লাদের এরকম ডাকাবুকোভাব আর অ্যাডভেঞ্চার প্রবনতা আমাকে খুবই অবাক করে। এদের এরকম হওয়ার কারন সম্ভবত এদের নিয়তির ওপর অগাধ আস্থা। এই আস্থা এতটাই বেশি যে এই দুর্ঘটনাগুলি না ঘটলেই তা অবাক হওয়ার মত ব্যাপার হত।

এই যে সমস্ত উঁচু শ্রেণির কুলীন নৌকার কথা বললাম, তার পাশাপাশি দু-তিন ধরণের নীচু জাতের নৌকার কথাও বলতে হয়। পুটেলি (পুতুল নৌকা) (বা কুটোরা)  বা হিন্দুস্থানী মালবাহী নৌকা, বিরাট বড় চ্যাপ্টা তলাওয়ালা ধাতুমল বা পোড়া ঝামা দিয়ে তৈরি বিচ্ছিরি দেখতে দেহাতি নৌকা। প্রায় হাজার মন (ইংরেজিতে বললে মন্ডস) অর্থাৎ মোটামুটি পঁয়ত্রিশ টন মাল বইতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও এদের এর দ্বিগুণ মালও বইতে হয়। এই নৌকাগুলি মূলতঃ তুলো বা গ্রামদেশে উৎপন্ন অন্যান্য নানারকম জিনিস পরিবহন করতে ব্যবহার করা হয়।

পুটেলি

 

এতক্ষণ যে নৌকাগুলোর কথা বললাম, সাধারণতঃ মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারগুলি নদীর উজানের দিকের রাজ্যগুলিতে যেতে ব্যবহার করে। আর এখনও পর্যন্ত সরকারও নিজস্ব নৌকার অভাবে সেনাবাহিনীকে প্রদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে রেসিডেন্সি বা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া আসার কাজে এই নৌকোগুলিই ব্যবহার করে এসেছে। ফলে মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানিও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি এতটাই বেড়ে গেছিল যে বর্মার যুদ্ধের শেষদিকে (৭) নদীপথে সেনাবাহিনীর দলকে গঙ্গা দিয়ে ইরাবতী নদীতে নিয়ে গিয়ে ফেলার জন্য সরকার, ওই যে বেসরকারী স্টিমার কোম্পানী যাদের কথা বলছিলাম একটু আগে, তাদের থেকে স্টিমার ভাড়া করেছিল।

পুলওয়ার একরকমের ছোট সাইজের দেশীয় বেড়ানোর নৌকা। গড়ন অনেক আঁটোসাঁটো আর এতে দেহাতি ব্যাপার অনেক কম। কখনও কোনও দরিদ্র মানুষ একা কোথাও যাওয়ার জন্য এই নৌকা ব্যবহার করলেও এগুলোকে মূলত যে সমস্ত বড় নৌকার কথা এতক্ষণ বললাম, তাদের পেছনে রান্নার নৌকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

পুলওয়ার

 

অনুবাদকের টীকা

লর্ড এলেনবরোঃ ১৮৪২ থেকে ১৮৪৪, দু বছরের জন্য ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। নাম এডওয়ার্ড ল (১৭৯০-১৮৭১), ইনি এলেনবরোর প্রথম আর্ল ছিলেন।

৬। ফেরি ফান্ড কমিটিঃ যে সমস্ত ঘাটে নৌকা পারাপার করত, সেখানে ছিল অব্যবস্থার চুড়ান্ত। সেখানে একটি সঠিক সিস্টেম চালু করার জন্য মোটামুটি ১৮১৯ সাল নাগাদ ডেপুটি কমিশনার, এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, সিভিল সার্জেন ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের তত্ত্বাবধানে এই কমিটির ভিত স্থাপন করা হয় যাদের কাজ ছিল জলপথে নৌকা ইত্যাদির যাতায়াতের একটি সুচারু ব্যবস্থা চালু করা। যদিও এই কমিটি ঠিকঠাক ভাবে চালু হতে অনেক দেরী হয়।

৭। বর্মার যুদ্ধঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর রক্তক্ষয়ী বর্মার যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। লড়াই হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর (পরবর্তীকালে ব্রিটিশ রাজশক্তির সাথে) সাথে কন-বাউং রাজবংশের। প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ হয় ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছিল ১৮৫২ সালে। এখানে এই যুদ্ধের কথাই বলা হচ্ছে। কেননা তৃতীয় যুদ্ধটি হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply