অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৭। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

ব্যাঙ্কসি নিজে কখনও প্রকাশ্যে আসেননি, টেলিভিশন বা অন্যান্য কথ্য-শ্রব্য গণমাধ্যমে তিনি মুখ দেখান না, লাইম লাইটকে এড়িয়ে চলেন, সাক্ষাৎকার দেন ই-মেলে। মতামত প্রকাশ করেন হয় নিজের লেখায়, বা নিজস্ব ওয়েরসাইটে। ব্যাঙ্কসির জীবনপরিচয় কারোর কাছেই উন্মোচিত নাহলেও যেটুকু সূত্র পাওয়া যায় (শিল্পীর নিজের কথা থেকে, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের ইঙ্গিত থেকে, তাঁর রহস্যময় সাক্ষাৎকার ও বিবৃতি থেকে তাঁর জীবনের একটা ফ্রেম নির্মাণ যেতে পারে) তাতে অনুমান করা যায় যে, ব্রিস্টলের এক নিতান্ত মধ্যবিত্ত এলাকার ভূমিপুত্র।

আভিজাত্যের দাক্ষিণ্যবঞ্চিত বাল্য-কৈশোরে সম্ভবত ব্রিস্টলের সাধারণ নিম্নবিত্ত এলাকার, শ্রমিক-মহল্লার ভালোমন্দ সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। সেখানেই তিনি শিল্পচর্চায় আগ্রহ অর্জন করে থাকবেন এবং শিল্পী হিসেবে তাঁর গোপনতার সূচনাও হয় এখানেই। রাস্তার, দেয়ালের, গণশিল্পী হিসেবে ব্যাঙ্কসি এবং তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে এড়াতে এড়াতেই পুরোদস্তুর গ্রাফিতি শিল্পী ও রাস্তার পটুয়া হয়ে ওঠেন। তাড়াতাড়ি দেয়াল অঙ্কনের জন্য স্টেনসিলিংয়ের কাজে পটুত্ব অর্জনের সূচনা এই সময়েই। পুলিশকে এড়াবার জন্যই তিনি ও সহযোগীরা একদা তাঁদের সমগ্র এলাকার সমস্ত দেয়াল রাতারাতি প্রাণবন্ত চিত্রকর্ম দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। পুলিশ ও তথাকথিত রাষ্ট্রীয় রক্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গেরিলা শিল্পকর্মের দীক্ষা এইসব কর্মকাণ্ড থেকেই তিনি লাভ করেন। প্রথম থেকেই তিনি জানতেন―কেউ যদি সত্যিই শিল্পী হতে চায় তবে তাকে তাদের কাজের কারণে কষ্ট সহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে (‘অল আর্টিস্টস আর প্রিপেয়ার টু সাফার ফর দেয়ার ওয়ার্ক।―ব্যাঙ্কসি : ওয়াল অ্যান্ড পিস’)।

ব্যাঙ্কসি কখনই নিজের রাজনৈতিক মতামতকে আড়ালে রেখে নিরপেক্ষতার ভান করেননি। ২০১৭ সালের যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাঙ্কসি ব্রিস্টল অঞ্চলের ছয়টি আসনের সবকটিতে রক্ষণশীল দলের প্রার্থীদের পরাজিত করার আহ্বান জানান। তিনি জানান রক্ষণশীলদের ভোট না-দিলে (অর্থাৎ বিপক্ষে ভোট দিলেই) তাঁর পক্ষ থেকে ভোটারদের বিনামূ্ল্যে প্রিন্ট পেপার দেওয়া হবে। ব্যাঙ্কসি তাঁর ওয়েবসাইটে এই ঘোষণা করেন যে, কনজারভেটিভ ছাড়া অন্যান্য যে-কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার চিহ্নসহ ব্যালট পেপারের ছবি ই-মেল করলে তাকে ব্যাঙ্কসির কাজের একটি করে নমুনা ই-মেল করে পাঠানো হবে। এই ঘোষণার জন্য ব্যাঙ্কসির বিরুদ্ধে ভোটদাতাদের ঘুষ প্রদানের প্রস্তাব করার বিষয়ে তদন্ত শুরু করা হয়। তদন্ত-ঘোষণার পরদিনই ব্যাঙ্কসি নিজের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন।

রাজনৈতিক স্পষ্টতার মতোই ব্যাঙ্কসির রচনায় শক্তিশালী সামাজিক ভাষ্যের উপস্থিতি লক্ষণীয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই দেশে দেশে মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন তিনি। তাঁর ‘সুইপিং আন্ডার দি কার্পেট’-এর মতো কাজে একজন পরিচারিকাকে কার্পেটের (?পর্দার) নিচে আবর্জনা পরিষ্কার (নাকি চালান?) করতে দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাঙ্কসি  বিরোধিতা করেছেন সহিংসতার, মন্তব্য করেছেন―গৃহহীনতা, মানবিক মূল্যবোধের অবনমনের বিরুদ্ধে, শান্তির জন্য বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের বিষয়ে। সর্বদা তাঁর রচনা সামাজিক নিপীড়নের বিরোধিতায় এবং নিপীড়িতদের পক্ষাবলম্বনে, অরক্ষিত ও অবহেলিত শৈশবের জন্য সমবেদনায়,  সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-প্রাতিষ্ঠানিক একচোখোমি ও শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে শাসকের গায়ে জ্বালা ও বুকে ভয় জাগিয়ে সোচ্চার থেকেছে।

ব্যাঙ্কসির মতো অপরাপর সমস্ত রাস্তার শিল্পী বা স্ট্রীট আর্টিস্টের মতো মুম্বাইয়ের টাইলারের শিল্পযাত্রাও রোমাঞ্চকর। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে টাইলার সেকথা ব্যক্ত করেছেন। টাইলার রাত্রে দ্রুত আত্মগোপনের সুবিধার জন্য কালো পোশাক পরেন। সর্বদাই মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখেন। গ্রেপ্তারি এড়াবার সুবিধা এবং অঙ্কনের কাজ অতিদ্রুত শেষ করে নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করার জন্য ব্যাপকভাবে স্টেনসিল ও স্প্রে ব্যবহার করেন। প্রকাশ্য দেয়ালে, রাস্তায়, আবর্জনার স্তূপের মাঝে, ফুটপাথে, সিঁড়ির কংক্রিটের রেলিংয়ের প্রাকারে গ্রাফিতি বা ম্যুরাল আঁকার সময় তাঁকে রাষ্ট্রীয় অথবা বাণিজ্যপোষ্য শান্তিরক্ষকদের তাড়ায় দৌড়ে পালাবার জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয়। এজন্য শারীরিক সুস্থতার জন্য অনুশীলন করতে হয়। বহুবার অঙ্কনের সরঞ্জামসহ ব্যাগপত্তর ফেলে রেখেই দৌড় দিতে হয়েছে। যে সমগ্র মুম্বাই শহর কর্পোরেটের বেহিসেবি বিজ্ঞাপনে, বাণিজ্যবর্জে আস্তাকুড়ে পরিণত হয়েছে, দানবিক মাপের হোর্ডিংয়ে ঢেকেছে আকাশ, বহু ফুটপাথে আবর্জনার স্তূপই পথচারীদের পথের সাথী, পাবলিক ন্যুইসেন্সকে যেখানে প্রচলিত আইনকাঠামো নিমীলিত চোখে প্রত্যেকদিন উপেক্ষা করে চলে―সেই মুম্বাইয়ের দেয়ালে বা পথে বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পকর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যের জন্য টাইলারকে আইনভঙ্গকারীর তকমা পেতে হয়।

বহুবিধ হুমকি, শাসনিক হস্তক্ষেপের যে বর্ণনা টাইলার দিয়েছেন তাকে ডাকাতির বর্ণনা বলে ভ্রম হতে পারে (পল্লবী পুন্ডির : ২০১৯) আজকের বিশ্বের আর্থিক বিধাতা কর্পোরেট, তাদের ছায়ায় তৈরি রাষ্ট্রশক্তি, জনগণের পয়সায় পোষা তাদের রক্ষক বাহিনী, সেই বাহিনীকে পরিচালনা করার জন্য গোপন ও হিংস্র কার্যক্রম, সেই কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখার জন্য বিশাল আত্মবিক্রিত পোষ্যবাহিনী, পুঁজিবাদী ক্ষমতার শ্রেণীবিন্যাসের দাস বনে যাওয়া মধ্য বা উচ্চ-নিম্নমধ্য বা মধ্যউচ্চ, উচ্চমধ্য ভদ্দরলোকেদের একাংশের―ক্ষমতা ও অক্ষমতার সবগুলি প্রান্তই যখন রাস্তার শিল্পের বিরোধী কণ্ঠ বা ভিন্ন মত প্রকাশের ব্যাপারে আতঙ্কিত এবং তার বিরোধিতায় নীরবতাসহ গুপ্তহননে লিপ্ত তখন শিল্পী যে আক্রান্ত হবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! টাইলার শুরুর দিকে বড়ো বড়ো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ছায়ায় থাকা রাজনৈতিক প্রচারণাকে ব্যঙ্গ লেখা ‘দয়া বিনামূল্যে। ‘*স্টক থাকা পর্যন্ত অফার বৈধ’-র মতো এক-লাইনের বয়ান থেকে শুরু করে ‘গড ইজ অ্যান আর্টিস্ট’ (‘ঈশ্বর একজন শিল্পী’) নামক অঙ্কনে হাতে একটি তুলি নিয়ে শিবের ম্যুরালের মতো শিল্পকর্ম পর্যন্ত টাইলারের বেশিরভাগই কাজই পুঁজিবাদ এবং ধর্ম-উন্মাদনার বিরোধিতা করে লেখা হয়েছে।

কিন্তু যখনই পুঁজিবাদচালিত রাজনীতির শাঠ্য ও ভারতীয় গণতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারাটি নিয়ে টাইলার আমেরিকার নির্বাচনের মতোই প্রশ্ন তোলেন নির্বাচনে কে জিতবে এটা কোনো প্রশ্ন নয় বরং এটাই বড়ো প্রশ্ন যে ‘আপনার ভোট কি গণনা করা হয়’ ( শ্রেয়া দাস : প্রাগুক্ত নিবন্ধ) তখন ক্ষমতা ও কর্তৃপক্ষশ্রেণীর পক্ষে টাইলারকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা ভোট গণনায় কারচুপির হাজার অভিযোগ ও তার বিরুদ্ধে হাজার বক্তৃতা আর লক্ষ প্রচারপত্রের থেকেও এই গ্রাফিতি একশ গুণ মর্মভেদী এবং শক্তিশালী।  ভাইস ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে টাইলারকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, ভারতের মতো  দেশে পলিটিক্যাল গ্রাফিতি আর্টিস্ট হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন? তখন টাইলার প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন : ‘স্যাটায়ার হিসেবে কোনো দেয়ালে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেখছেন? দেখার কথা না। কারো সেই সাহস নেই। কিংবা সেইটাকে কেউ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না।’ টাইলারের এই কথায় ভারতীয় গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের, সািহত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতার ধারণাটির খড়মাটি বেরিয়ে পড়ে।

সারা বিশ্বেই গ্রাফিতি শিল্পীদের সমাজবিরোধী, ক্ষতিকারী, কুখ্যাত, ধ্বংসকারী, আইনভঙ্গকারী ও অবৈধ কাজে লিপ্ত আখ্যা দেওয়া হয়। যখন ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় একজন নাবালকসহ চারজন স্ট্রীট আর্টিস্টকে দেয়াল লেখার সময় পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় তখন নিউ ইয়র্ক বা ফিলাডেলফিয়া, ব্রিটেন বা ফিলিপাইন―ইউরোপ-আমেরিকা বা এশিয়ার ক্ষমতার ভাষায় তফাৎ কিছু থাকে না। এই ঘটনাকে ফিলিপাইনের সংবেদনশীল সমাজ ও সাহিত্যকর্মীরা সংস্কৃতির ওপর আঘাত বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, জনগণের প্রতিবাদকে ফিলিপিনো শিল্পীরা দেয়ালে মূর্ত করে তুলবার সময় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্ত এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার স্থান সংকুচিত করার সময়ে শিল্পের প্রতিবাদ করা কেবল ন্যায্য নয় বরং প্রয়োজনীয়। (লিয়া স্যাভিলো : ২০১৯)

রাস্তার শিল্প, গ্রাফিতি ও ম্যুরাল অঙ্কন, বিরুদ্ধ ও ভিন্ন মতের কণ্ঠস্বরকে দমন করার রাষ্ট্রীয় ও শাসনিক প্রচেষ্টা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে ভয়ানক সন্দেহ নেই। ১৯৮০ সাল নাগাদ ফিলাডেলফিয়া শহরের গ্রাফিতি নির্মূল করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল অ্যান্টি গ্রাফিতি নেটওয়ার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে। সেখানকার তরুণ গ্রাফিতি শিল্পী গাঙ্ক (এই নামেই দেয়াল লেখেন তিনি) ‘দি টেম্পল নিউজ’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘আমি এর মধ্যে (অর্থাৎ গ্রাফিতি, ম্যুরাল বা রাস্তার শিল্পের মধ্যে) অবৈধ কিছু দেখি না। আমি কোনোমতেই অপরাধী বা হিংস্র ব্যক্তি নই। আমি কেবল শিল্প সৃজন করতে ভালোবাসি। আমি এটাকে আমার চারপাশের প্রতিযোগিতার মতো মনে করি। এই শিল্পেও আপনি নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। আমি কাউকে এটা করতে বলিনি। আমি কেবল নিজের কাজ হিসেবে এই কাজ করি।’ (অ্যাবি স্টেইনর : ২০১৮)

রাস্তার শিল্পীরা কতভাবে বাধাপ্রাপ্ত, তাড়িত এবং অত্যাচারিত হন, তাঁদের বিরুদ্ধে সামাজিক,  ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা করা হয়―তা রজার গাস্টম্যান পরিচালিত এবং জন ওয়াটার্স বিবৃত ‘ওয়াল রাইটার্স : গ্রাফিতি ইন ইটস্’ (২০২৩। ‘ওয়াল রাইটার্স সেইসব দূরদর্শী ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, যাঁরা গ্রাফিতি তৈরি করেছিলেন এবং নিউ ইয়র্ক শহর এবং তার বাইরেও এক অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছেন’) নামক পূর্ণ দৈর্ঘের তথ্যচিত্রটি দেখলেই মালুম হয়।

অপরদিকে পর্তুগালের লিসবন শহরের সাবওয়ে, মেট্রো টানেলের ভেতর, দোকানের শাটার থেকে শুরু করে নদীতীর জনবহুল এলাকাসহ গলিপথেও ১৯৯০-এর দশকে প্রচুর গ্রাফিতি আঁকা হতে থাকে। একবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ব্যাপক গ্রাফিতির চর্চা ও তার সামাজিক প্রভাব শহরের এক শ্রেণীর নাগরিক প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পী, পৌরসভা―ইত্যাকার সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থ-সংঘাত  দেখা দেয়।

আমাদের কলকাতার ক্ষেত্রে সংগঠিত দেয়ালচিত্রান্দোলন মানে সেই চলমান শিল্প আন্দোলন। সেই অস্থির দশকের সুখকর সৃষ্টি-উল্লাস ছিল কম―বেদনা, যন্ত্রণা ও ভূতির আবহে তরুণের দুঃসাহস, শক্তি ও রোমান্টিক ভ্রান্তির আগুনে গাঁথা রক্তাক্ত দগ্ধ দিনগুলি সেদিন নিদারুণভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল।

বস্তুত রাজনৈতিক ভাষ্য, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, রাষ্ট্রের প্রভুত্বের আইনকে সমালোচনা করা, রাজনীতির কারবারিদের স্বার্থনিয়ন্ত্রিত আচরণের অসঙ্গতিগুলিকে খুলে দেখানো, জনসাধারণকে প্রচলিত তন্ত্রের ফাঁক ও ফাঁকি সম্বন্ধে সচেতন করার স্বনির্বাচিত দায়কে স্বীকার করে নেওয়া ইত্যাদি অন্তর্গত গুণাবলী ব্যতিরেকে গ্রাফিতিকে ‘লবণ ছাড়া তরকারি’ বা ‘যুক্তিসম্মত নির্ণয়পদ্ধতি ছাড়াই বিজ্ঞান’ বলা যেতে পারে। গ্রাফিতি নিছক শিল্পকলা নয় সাধারণজনের শিল্পবোধের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ইশতেহার। এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই গ্রাফিতি এক ধরনের গেরিলা আর্ট। কিন্তু কলকাতার চলমান শিল্প আন্দোলন আদৌ কোনো গোপন কার্যক্রমের বশবর্তী ছিল না। বেশ প্রচার সংগঠিত করেই এই কাজ শুরু করা হয়েছিল। আধুনিক শিল্প সম্পর্কে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা থাকলেও দেয়াল লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি ও সহযোগিতা নেওয়া হয়েছিল। বড়ো রঙের কোম্পানি রঙ খয়রাতও করেছিলেন। সুতরাং কলকাতার চলমান বা গতিশীল শিল্প আন্দোলন গ্রাফিতির মতো আদৌ অবৈধ কিছু ছিল না। বরং একটা গণনীয় সংখ্যার সামাজিকভাবে খ্যাতজনদের, ক্ষমতার দ্বারা বহুলাংশে অনুমোদিত ছিল। শিল্পীদের নাম ও ভূমিকাও ছিল প্রকাশ্য। তবু বিরোধিতার হাত থেকে, আক্রমণের প্রকোপ থেকে এই আন্দোলন সম্পূর্ণ মুক্তি পায়নি। শহরের দেয়ালে দৃশ্যদূষণের অভিযোগ তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত ছিল বুদ্ধিচর্চা বা এলিট কালচার নিয়ে এক ধরনের উন্নাসিক ন্যারেটিভ এবং তাচ্ছিল্যের বয়ান। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য-বিধেয় সম্পর্কে কর্তৃপক্ষশ্রেণীর সন্দেহ ও সংশয় কতটা ছিল তা জানা না-গেলেও ছবিগুলি নিষেধাজ্ঞা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার স্রষ্টা জয়নুল আবেদিন শুধুমাত্র সাদা কাগজ আর চাইনিজ কালিতে অসামান্য ইতিহাস-অতিক্রমী চিত্র সিরিজ রচনা করেছিলেন। তাঁর মত ছিল স্বাধীনতাপূর্বকালের খাদ্যের দুর্ভিক্ষকে ছাপিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তরকালের সুচিন্তা ও সুরুচির দুর্ভিক্ষ. এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না। তিনি দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকলেও (প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে তাঁর আঁকা ‘মনপুরা’ সিরিজের স্ক্রোল চিত্রের কথা মনে রেকেও) বন্যা নিয়ে আঁকেননি কেন? ―সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে জয়নুল বলেছিলেন যে, বন্যা প্রকৃতির। তাই এর বিরুদ্ধে করবার কিছু নেই। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান তাঁকে ব্যথিত করেছিল। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। দৃশ্যদূষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের অনুযোগ অনেকটা পরিসরের সৃষ্টি করে : ‘আসলে শহরের সৌন্দর্য  বেঁচে থাকে অন্তরের কান্নায়। সত্তর দশকে এ ছবিগুলো বন্ধ করা হয়েছিল শহরকে হাসপাতাল বানানোর জন্য।…এ তো পাগলামির কারুশিল্প এক রকম। মিশনারি বা ধর্মীয় আখড়ার বা হাসপাতালের বা কর্পোরেটের স্তব্ধতার বদলে আমরা চাই আবার পশম পরিহিতা ভেনাসকে। চাই, মায়াকভস্কি আবার তাঁর কবিতায় ট্রামগুলো রাঙিয়ে দিক শহরের। শানু লাহিড়ির আদ্মীয় সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদারের কথাও মনে পড়েছে। আমাদের জীবনের অসুন্দরের রাজত্বকে সরিয়ে কমলবাবু চেয়েছিলেন, দোয়েল কোকিল থাকুক আমাদের জীবনের পথ চলায়। তাই ছোট ছোট রেখা বা মন্দিরের গায়ের কারুকার্যগুলি তিনি সনাক্ত করেছিলেন ছোট রেখাচিত্রে। আজ সেসব দিয়েই এই পল্লিসভ্যতাকে বিদ্রূপ করতে পারি।’ (উল্লেখ : দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রাগুক্ত প্রতিবেদন)

কিন্তু শহরের সৌন্দর্য, রুচির চারুতা রক্ষার জন্য, লক্ষ্যে গ্রাফিতি চর্চার শাসকের স্বার্থগন্ধহীন উদ্যম থাকার কথা নয়। বোলপুর শান্তিনিকেতনের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে রাবীন্দ্রিক ম্যুরাল কিংবা মেট্রো স্টেশনের কর্তৃপক্ষপোষিত গ্রাফিতি কিংবা বিভিন্ন বিভিন্ন শহরে শাসক-সমর্থিত দেয়াল চিত্রগুলি আসলে দেয়াল অলংকরণেরই নামান্তর। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিসে রিপাবলিকান শাসনে প্রকাশ্য রাজপথে পুলিশের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওয়াশিংটন ডি সি-তে হোয়াইট হাউজের কাছে রাস্তা জুড়ে মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান যে গ্রাফিতি করা হয়েছিল তাকে শহরের মেয়র ম্যুরিয়েল বাউজ়ার সমর্থনই শুধু করেননি, ঐ রাস্তার নামও ব্ল্যাক লাইভস আন্দোলনের নামে রেখেছিলেন। (পূর্বে উল্লিখিত) কেননা তিনি তখন শহরের পুর সংস্থা শাসন করছিল ডেমোক্র্যাট পার্টি। এই দলটি হার্ডকোর বর্ণবাদের পক্ষাবলম্বন করেনি।

গ্রাফিতির এই বিদ্রোহী সত্তা গ্রাফিতিওগ্রাফিক (গ্রাফিতিতত্ত্ব বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে) স্বভাবের অন্তর্গত। বাঙালির সামনে ছিল প্রতিবাদের বৃহত্তর ও বেদনাবহ পরিসর। ইমরান ফিরদাউস লিখছেন বঙ্গ-গ্রাফিতির সেই বাস্তবতার কথা : ‘প্রাগৈতিহাসিক মানুষ থেকে আজকের শিশু―সবার কাছেই দেয়াল মনের কথার এক উদাম মাঠ। তাই…বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের সাত সমুদ্র তেরো হাঙর নদী গ্রেনেড পার করে জরা বিধ্বস্ত মানুষ যখন নিজেকে নব্য বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রাণীরূপে ঠাওর করে নিতে পারলো, আরও পারলো ক্ষমতা ভালোবাসায় মত্ত শাসক-শোষক গোষ্ঠীকে চিনে নিতে নিতে… সেদিন দেখতে পেলো ঢাউস ঢাউস সংবিধান বহিতে আহত-নিহত আত্মার রক্ত দিয়ে ‘মানুষ’কে নিয়ে অনেক মিঠা কথা লেখা হলেও, মানুষের পক্ষের কথা, মানুষের জন্যে কথা লিখা হয়েছে সামান্যই। পরন্তু মানুষ তো জেনে গেছে, সে রাজনৈতিক প্রাণ, তার আছে গলা চড়াবার দেমাগ, টুঁটি চেপে ধরলে উন্মাদ আস্ফালনের স্পর্ধা আর কপাল খারাপের রাতে… দেয়ালকে চিরকুট বানিয়ে, ভয়শূন্য চিত্তে যুতের কথা লিখে রেখে যাওয়ার শক্তি।’ (দৈনিক দেশ রূপান্তর : ২০১৮)

(ক্রমশ)

……………………………………

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply