অকূলের কাল। পর্ব ৩৯। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
ফেলে আসা সূত্র
তারাতলা ব্রিজের মৌসুমি, তার চাকরির প্রথম দিনেই ক্ষিতিকে – শুধু ক্ষিতিকেই নয়, বাগরিবাজারের ওষুধের মহাজন গোবিন্দ সাহাকেও চমৎকৃত করেছিল। মাসখানেক পরে তাকে টেক্কা দিল ভবানীপুরের ‘হাইজিন শপ’। ভবানীপুর ভিজিটের প্রথম দিন থেকেই সেই দোকানে ঢুঁ মেরে চলেছিল ক্ষিতি। অর্ডার পায়নি কোনোদিনই। এই দোকানের মালিক নিজেই নাকি ডাক্তার। তিনি রুগিও দেখেন এই দোকানের ভেতরে একটি ঘেরা চেম্বারের মধ্যে। ওষুধের অর্ডার তিনি নিজেই দেন। কখন দেন কে জানে! ক্ষিতি যখনই আসে, দেখে তাঁর চেম্বারের বাইরে একদিকে স্যুট বুট পরা টাই ঝোলানো মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে, অন্য দিকে রুগির দল। দেখেশুনে পরের দিকে আর এই দোকানের চৌকাঠ ডিঙোত না সে, একবার উঁকি দিয়েই সামনে এগিয়ে যেত।
তারপর আচমকাই একদিন রূপকথার গল্প। সেদিন বিশেষ কারণে একটু দেরিতেই ভিজিটে বেরিয়েছিল ক্ষিতি। কারণটা নিয়ে সবিশেষ হওয়া দরকার। ক্ষিতির অনবধনতা জীবনের এই পর্বে একটা ফাঁক রেখে এপর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। অথচ বাস্তবে সেই ফাঁক রীতিমতো ভরাট। ফেলে আসা সূত্রটায় টান পড়ল আচমকাই ভবানীপুরের সেই আনমনা ডাক্তারের ওষুধের অর্ডার দেওয়ার তুঘলকি কাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে; যদিও এই দুটো ব্যাপার একেবারেই সম্পর্ক-রহিত, মিল বলতে ঘটনাচক্রে ক্ষিতির সেদিনের অবস্থান ছিল কাছাকাছি জায়গায় – ভবানীপুর আর কালীঘাটে।
সবিশেষ হতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় বছর চারেক। যেমন অমিয়-অশোক, তেমনই ক্ষিতির আর এক ভাগ্নে নাদু – বড়দির ছেলে, বয়সে সামান্য ছোট এবং সম্পর্কে বন্ধুসমান; ধোঁয়া গেলায় ক্ষিতির হাতেখড়ির সঙ্গি হয়েছিল নবম–দশম শ্রেণিতেই। ঝাড়গ্রামে থাকতেন বড়দি, বেশ কিছুদিন বিভিন্ন বাড়িতে থাকার পর জামাইবাবু ঝাড়গ্রামেই বাড়ি করে স্থায়ী হন। কোনো এক সময় সেরকমই এক বাড়িতে প্রতিবেশী ছিলেন এক পরিবার। সেই পরিবারের এক তরুণী, নাদু-কথিত ‘স্বপ্নাদি’র গল্প শুনে শুনে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল ক্ষিতি, কিন্তু কোনোদিন তাঁকে চোখে দেখেনি। তারপর ক্ষিতি যখন এইচ এস পাস করার পর অ্যাডমিট-মার্কস শিট হারিয়ে ভর্তি হতে পারছে না কোনো কলেজে, আর নাদু পড়ছে ইলেভেনে – মামার কাছে ইনল্যান্ড মারফত একটা প্রস্তাব পাঠাল সে। স্বপ্নাদিরা ঝাড়গ্রাম থেকে বদলি হয়ে বহরমপুরে। বারবার যেতে বলছে সেখানে। তাদের বাড়িতে থেকে মুর্শিদাবাদ দর্শন, নবাববাড়ি-হাজারদুয়ারি। মামুভাইকেও যেন সঙ্গে নিয়ে আসে। আসলে স্বপ্নাদি নাদুর সাহিত্যপাঠের, আলোচনার সঙ্গি। ক্ষিতি সেই বয়সেই গল্প-উপন্যাস লিখছে, সেসব জেনে বয়সে ছোট মামাকে সে ‘মামুভাই’ বানিয়েছে, চোখে না দেখেই। যাওয়া তো যায়, হাজারদুয়ারির সঙ্গে স্বপ্নাদিকে দেখার ইচ্ছেও কম নয়, কিন্তু খরচ? খরচ আর কী! স্বপ্নাদি বলেছে, সব দায়িত্ব তার। কেবল যাওয়াআসার ট্রেনভাড়াটা যোগাড় করলেই হয়ে যায়।
হয়েছিল যাওয়া, হাজারদুয়ারি, স্বপ্নাদি-দর্শন। ক্ষিতির জীবনে অনন্য অভিজ্ঞতা। অনাত্মীয়, অপরিচিত তরুণী এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা ছেলেকে আন্তরিক ভাই-বন্ধু সম্পর্কে জড়িয়ে নিতে পারে, পরম যত্নে খাওয়ানো, বিছানা পেতে দেওয়া, সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া – কল্পনাতীত, অজানা এক সংস্কৃতির ছোঁয়া পেয়েছিল ক্ষিতি। শ্যামলের মেজদির সঙ্গেও এমনই একটা সম্পর্ক হয়েছিল ক্ষিতির। কিন্তু বহু সময় লেগেছিল সেটা হতে। একদিনেই এতটা কাছে টেনে আপন করে নেওয়ার মতো সহজতা ছিল না সেখানে।
তিনদিন ছিল তারা বহরমপুরে। তারপরে, আজ পর্যন্ত এখনও ‘মামুভাই’কে চিঠি লেখে স্বপ্নাদি। ক্ষিতি কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছে, হস্টেলে আছে জেনে স্বপ্নাদি তাকে কালীঘাটের একটা ঠিকানা দিয়েছিল। সেখানে তার এক আত্মীয়-পরিবার থাকে। ক্ষিতি যেন অবশ্যই তাদের সঙ্গে পরিচয় করে, যোগাযোগ রাখে। করেছিল ক্ষিতি।
যখন সে বলছে, কলকাতায় প্রথম আসার পর, হস্টেল-আবাস থেকে কাছাকাছি মাঝেমধ্যে তাকে যেতে হয় অমরশঙ্করের অগিলভি, শ্যামলের আরজিকর, পতুর শ্রীরামপুর আর কোম্পানি ইত্যাদিদের খিদিরপুর – তখন কালীঘাটের বড়সড় ফাঁকটা তার মন এড়িয়ে যায় হাতে ধরা মোটা সুতোটি সত্ত্বেও। সেই সুতো মল্লিকা, তার জীবনের প্রথম মেয়ে-বন্ধু। যে-বয়সে মেয়ে মানেই ভিন্ন কায় – ঠোঁট, বুক, নাভিনিম্ন, কটি-নিতম্ব – আকর্ষণের খনি, কাম কিংবা প্রেম, সেই বয়সে মল্লিকা, তারই বয়সি, ইংরাজি অনার্সেরই ছাত্রী, কী সহজ সাবলীলতায়, ক্ষিতিকে লিঙ্গনিরপেক্ষ সখ্যে বেঁধে ফেলল। ক্ষিতির দিক থেকে অতটা সহজ ছিল না প্রথম প্রথম। মল্লিকার অবয়ব যথেষ্ট আকর্ষক – বিশেষত ক্ষিতির কাছে। তার কোঁকড়ানো চুল, মায়াবি চোখ, শ্যামল-মসৃণ ত্বক, প্রতিমার মতো নাক। ক্ষিতির জীবনে ছাদপরীদের আবির্ভাবের আগেই ক্ষিতির হস্টেলে গিয়েছিল মল্লিকা। সেই নিয়ে তার বন্ধুরা খুনসুটি করতে ছাড়েনি। প্রথম দিকে লজ্জাও পেত ক্ষিতি। কিন্তু মল্লিকার উদাসীন আন্তরিকতায় ধীরে ধীরে সলজ্জ মধুরতা কমতে থাকে। দোলনের আগমনের পর থেকেই তা সম্পূর্ণ উবে যায়। ক্ষিতি স্বাদ পায় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বন্ধুতার।
কেবল মল্লিকাই নয়, তাদের পুরো পরিবারই ক্ষিতির ধারণার বাইরে থাকা এক বিস্ময়। খোদ কলকাতায় থাকা, উচ্চ বর্ণের, শিক্ষিত পরিবারও এত গরিব হতে পারে! কলকাতায় থাকলে ক্ষিতি নিজেও খুব গরিব। কিন্তু গ্রামে তারা যথেষ্ট বড়লোক। জমিজমা, ধানচাল, গরুমোষ অঢেল। কলকাতায় বড়লোকের মতো থাকতে হলে নগদ টাকার জোগান চাই, তার জন্য চাকরি করে নগদ টাকা রোজগার করা ছাড়া অন্য উপায়ের খবর জানা নেই তাদের পরিবারে। মল্লিকাদের পরিবার এমনই যে, যেভাবেই হোক টাকা রোজগার না করতে পারলে প্রতিদিনের খাওয়া-পরা জোটানোও দুষ্কর।
কালীঘাটের এক বস্তিতে থাকে মল্লিকারা। খিদিরপুরের যে-বস্তিতে কোম্পানি ইচ্ছে করেই থাকেন, তার থেকেও এক ধাপ নিকৃষ্ট বস্তিতে বাধ্য হয়ে থাকে নিকুঞ্জ চক্রবর্তীর পরিবার। কালীঘাট মন্দিরের কাছে ঠাকুরের ফুলমালা-নাড়ু-বাতাসা ইত্যাদির দোকান আছে তাঁর। এছাড়া করেন পুরোহিতগিরি। তাঁর ভাড়া নেওয়া দুটি ঘর বস্তির গলির দুই বিপরীত দিকে। স্ত্রী, এক ছেলে আর তিন মেয়েকে নিয়ে মোট ছ’জন কী-কৌশলে এই দুটি ঘরে রান্না-খাওয়াসহ বাস করেন সে এক রহস্য। হস্টেলে আসার মাস দুয়েক পর থেকে প্রায়ই এই বাড়িতে আসছে ক্ষিতি, কিন্তু যে-ঘরটি মূলত তাদের শোয়ার ঘর এবং ক্ষিতি সেই ঘরেই বসে, আড্ডা হয় মল্লিকা ও তাঁর দাদা স্বপনদার সঙ্গে, ক্ষিতিকে দৈবাৎ একা পেলে ছোট বোন, ক্লাস এইটে পড়া যূথিকাও এসে তার গা ঘেঁসে বসে – সে-ঘরের আসবাবপত্র, জামাকাপড় সর্বদাই অতি পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি দেখে ক্ষিতি। এও এক বিস্ময় তার কাছে।
স্বপনকে স্বপনদা বলে ডাকলেও, সে এবং তার তিন বোনের কাছে ক্ষিতি হয়ে গেছে তাদের ‘মামু’, সম্ভবত স্বপ্নাদির ‘মামুভাই’-এর টানে। স্বপনদা বিএসসি পাশ করে দু-চারটে টিউশন করে। মল্লিকা পড়তেই পড়তেই সময় করে কয়েকটা ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে যা হোক কিছু পায়। এই সব নিয়েই কষ্ট করে হলেও গুছিয়ে চলতে জানে তাদের সংসার। স্বপনদার একটু গোলগাল চেহারা। তার মেজবোন করবীকে দেখলেই মনে হয় রাজেন্দ্রাণী, টকটকে ফরসা, চেহারার ধরন স্বপনদার মতোই, ঘন চুলের ঢাল কোমর গড়িয়ে আছড়ে পড়েছে গুরুনিতম্বে। কিন্তু স্বভাবে সে ভাইবোনদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কথা প্রায় বলেই না। সকলের চোখের আড়ালে থাকাই তার পছন্দ। ক্ষিতি কম দিনই তার দর্শন পায়। তাদের মাকে হিসেবমত দিদি বলাই উচিত ক্ষিতির, কিন্তু সে তাকে মাসিমা বলেই ডাকে। খুবই স্নেহশীল মহিলা, দারিদ্র্যের ছাপ পড়তে দেননি নিজের মুখে। মেসোমশায়কে বাড়িতে দেখতেই পাওয়া যায় না, দোকান আর পুজা-আচ্চার ফেরে কাটাতে হয় দিনরাতের বেশিটা সময়।
তবে মল্লিকাদের সুদিন আসতে আর দেরি নেই – ঘোষণা করেছে স্বপনদা কিছুদিন আগেই। নির্বাচনে সিদ্ধার্থ রায় কংগ্রেসকে রাজ্যপাট ফিরিয়ে দিয়েছেন। গৌতমদা বলে কে এক তরুণ কংগ্রেস নেতা স্বপনদার বন্ধু। তিনি নাকি ছোটোখাটো মন্ত্রী হয়েছেন বিদ্যুৎ দপ্তরে। সেই দপ্তরেই চাকরি হতে চলেছে স্বপনদার। আবার এই সময়েই কিনা মামুও চাকরিতে ঢুকে পড়েছে! একশো টাকার চাকরিও বা কম কী! পরীক্ষা দেয়নি তো কী হয়েছে! পরের বার হবে। এই সব সুখবরে মামুর খাওয়ার নেমন্তন্ন আজ মল্লিকার বাড়িতে। কালীঘাট-ভবানীপুর ভিজিট সেরে ভর দুপুরে নরজিতের হাঁড়িতে মুখ দিতে যাওয়ার দরকার হবে না। এই কারণেই আজ দেরি করে বেরিয়েছিল ক্ষিতি।
(ক্রমশ)
