সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ২। বরুণদেব

0

গত পর্বের পর

গ্রীক শব্দ Kirkos থেকে আসা circus এর এরিনার গায়ের জন্মদাগটি প্রাচীন রোমের। বিবর্তনের নানা পথ পেরিয়ে আসা আজকের সার্কাসের খেলা, আঙ্গিক ও আবহের সাথে প্রাচীন রোমের সার্কাসের আসমান জমিন ফারাক। সে ফারাক ফিলিপ অ্যাস্টলের ঘোড়ার জিনে আসা অষ্টাদশ শতকের আধুনিক সার্কাসের সঙ্গেও। সার্কাসের শিকড় খুঁজতে গেলে যুগ-যুগান্ত, সাগর –নদী পেরিয়ে রোম নগরীর উষালগ্নে টাইবার নদীর পাশে দাঁড়াতেই হয়। সার্কাসের খেলাগুলি- অ্যাক্রোব্যাটিক্স,জাগলিং, দড়ির ওপর ব্যাল্যান্সের খেলা, জিমন্যাস্টিক্স, মানবসভ্যতার ভোর থেকেই চালু ছিল। প্রাচীন মানবের কাছে  সার্কাসের অনেক ক্রীড়াকৌশলই রপ্ত ছিল। আড়াই হাজার খ্রীঃপূর্বাব্দে ইজিপ্টে চালু ছিল জাগলিং।  গ্রীকরা রোপ ড্যান্সিংয়ের কসরত দেখাত। প্রাচীন আফ্রিকার সভ্যতায়  জনপ্রিয় ছিল লোকনৃত্যর সঙ্গে অ্যাক্রোবাটিক্সের মিশ্রণ- সিরিকাসি (Siricasi)। প্রাচীন চিনে রাজদরবারের মনোরঞ্জনে চালু ছিল জাগলিং ও অ্যাক্রোব্যাটিক্স। চিনা পণ্ডিত ঝাং হেং তাঁর ‘ওড টু দ্য ওয়েস্টার্ন ক্যাপিটাল’-এ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন ১০৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে চিন সম্রাট হুওফ হানের বিদেশী অতিথিদের মনোরঞ্জনে অ্যাক্রোব্যাটিক্সের আসর বসানোর কথা। মিশরে সমাধির দেওয়ালে আঁকা হয়েছে জাগলার ও অ্যাক্রোব্যাটদের চিত্র।  ইউরোপের প্রথম সভ্যতা, ব্রোঞ্জ যুগের মিনোয়ান সভ্যতার প্রাচীরে খ্যাপা ষাঁড়ের পিঠে তরুণ অ্যাক্রোব্যাটদের লাফিয়ে পড়ার চিত্র। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার বিভিন্ন সভ্যতায় ভ্রাম্যমাণ জাগলার, অ্যাক্রোব্যাটরা বাজারে সরাইখানায় উৎসবের জমায়েতে খেলা দেখিয়ে মোহিত করত আমুদে মানুষকে। মানুষ খুশি হয়ে অর্থ দিত। ক্লাউনের আধুনিক ধারণা ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির  থিয়েটারের ফর্ম ‘কম্মেদিয়া দেলারতে’ থেকে উৎসারিত হলেও প্রাচীন মিশরের পঞ্চম রাজবংশে ক্লাউনের শিকড় ছড়িয়ে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার জনপ্রিয় খেলা ছিল ঘোড়ায় টানা রথের রেস।

অষ্টাদশ শতাব্দীর টেমস নদীর তীরে যে আধুনিক সার্কাসের জন্ম তার যাত্রা শুরু ঘোড়সওয়ারের কসরত প্রদর্শনীতে। সেই টেমসের তীর থেকে সার্কাসের উৎস সন্ধানে যাত্রা করলে জনপদ-অরণ্য-পর্বত-নদী- যুগ-যুগান্ত পেরিয়ে টাইবার  নদীর তীরে অ্যাভেন্টাইন (Aventine) ও  প্যালাটাইন (Palatine) পাহাড়ের মাঝে মুরসিয়া উপত্যকায় থমকে দাঁড়ায় সার্কাসের অশ্বমেধ ঘোড়া। লাল নীল সবুজ সাদা রথের জোয়াল তুলে নেয় কাঁধে। লাগাম ছাড়ে সারথী। তীব্র গতিতে খুড়ের শব্দ তোলে। মানুষের উল্লাসে, গগনবিদারী চিৎকারে অনুরণন ওঠে  সাত পাহাড়ের নগরে। গোটা রোম তখন সার্কাসের পথে। সার্কাস ম্যাক্সিমাস। সময়টা খ্রীঃপূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী।

 

 

—————————————————————————

 

 

রোম নগরের পত্তনের উপকথায় দুই যমজ ভাই – রেমাস ও রোমুলাস এবং ভ্রাতৃহত্যার রক্তাক্ত অধ্যায়।

দশ বছর ধরে চলা ট্রোজানের যুদ্ধে গ্রীকদের হাতে ট্রয় নগরী ধ্বংস হলে ট্রয়ের এক যুবরাজ অ্যানিয়াস (Aeneas) ট্রয় থেকে পালিয়ে নানা অঞ্চল ঘুরে হাজির হন ইতালিতে। সেখানকার রাজকন্যার সাথে তাঁর বিবাহ এবং স্ত্রীর নামে এক নগরের পত্তন- লা ভিনিয়াম (La Vinium) । অ্যানিয়াসের পুত্র আসকানিয়াস (Ascanius) রাজা হলেন যখন, তখন এই নগর জনবহুল হয়ে পড়েছে। ফলে আর এক নগর আলবা লঙ্গার (Alba Longa) প্রতিষ্ঠা। সময়টা ১১৫১ খ্রীঃপূঃ। এরপর এগারোটা প্রজন্ম। বয়ে গেল সাড়ে তিনশো বছর। ৭৯৪ খ্রীস্টপূর্বাব্দে রাজা প্রকাশ (PROCAS) মারা গেলে শুরু হল গৃহযুদ্ধ। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নুমিটর (NUMITOR) রাজা হলেন। কিন্তু ভাই আমুলিয়াসের (Amulius) চক্রান্তে সিংহাসনচ্যূত হয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। বাঁচল না তাঁর দুই পুত্র। কাকার হাতে তাদের মৃত্যু। আর ক্ষমতার আসন নিষ্কন্টক রাখার জন্য ভাইঝি রেয়া সিল্ভিয়াকে(Rhea Silvia)  বাধ্য করা হল ভেস্টাল ভার্জিন হতে- দেবী ভেস্টার পুরোহিত, প্রধান শর্ত সতীত্ব রক্ষা, কুমারীর জীবন। কিন্তু রথের চাকা উল্টোদিকে ঘুরল।

সিলভিয়ার যমজ পুত্র সন্তান জন্মাল। বলা হলো, যুদ্ধের দেবতা মার্স তাদের পিতা। খবর পৌঁছাল রাজার কানে। ফল- সিলভিয়ার কারাগারবাস এবং শিশু সন্তান দুটিকে টাইবার নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার আদেশ। কিন্তু ভৃত্য জলে না ভাসিয়ে শিশু দুটিকে রেখে এল টাইবার নদীর পাড়ে। একটি স্ত্রী-নেকড়ে (she wolf)  নদীতে জল খেতে এসে ক্রন্দনরত শিশুদুটিকে বুকের দুধ খাইয়ে নিয়ে গেল তার ডেরায়, প্যালাটাইন পর্বতের নিচে । শিশু দুটিকে সেখান থেকে উদ্ধার করে এক মেষপালক তাদেরকে তুলে দিল তার স্ত্রীর কোলে।

মেষপালক দম্পতির স্নেহচ্ছায়ায় দুই যমজ ভাই রেমাস ও রোমুলাস বড় হতে লাগল। দক্ষ শিকারি হয়ে উঠল। জনপ্রিয় হল। দস্যুদলের আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করতে লাগল। এমনই এক আক্রমণে দুই ভাই দু’দিকে গেল ছিটকে।  রেমাস  দস্যুদলের হাতে ধরা পড়ল, রোমুলাস পালিয়ে গেল। দস্যুরা রেমাসকে তুলে দিল নুমিটরের হাতে। নুমিটর আসলে সম্পর্কে তার দাদু,  যিনি একদা গৃহযুদ্ধে  ভাইয়ের কাছে আলবা লঙ্গার  সিংহাসন হারিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। ইতিমধ্যে রোমুলাস ভাইকে উদ্ধারের জন্য আক্রমণের প্রস্তুতি নিলে তাদের মেষপালক পিতা তাদের জন্মবৃত্তান্ত সামনে আনল। এরপর দাদু নুমিটরের  সাহয্য নিয়ে দুই ভাইয়ের আলবা লঙ্গা (Alba Longa) আক্রমণ, রোমুলাসের হাতে  আমুলিয়াসের মৃত্যু এবং নুমিটরের  রাজত্ব লাভ। ততদিনে  জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে আলবা লঙ্গায় (Alba Longa)  ঠাঁই নাই , ঠাঁই নাই। রেমাস ও রোমুলাস স্থির করল , নতুন নগরের পত্তন করতে হবে।

টাইবার নদীর পূর্ব পারে সাতটি পাহাড় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে। নদীর মিষ্টি জল। কৃষির উপযোগী উর্বর মাটি। ঐ সাত পাহাড়ের একটি প্যালাটাইন পাহাড়, ওখানেই একটি নেকড়ে, শিশু রেমাস ও রোমুলাসের জীবন বাঁচিয়েছিল। নতুন নগরীর জন্য দুই ভাই বেছে নিল সেই উপত্যকা। এবং সঙ্কট দেখা দিল।

রেমাস ও রোমুলাসের মধ্যে কে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল, কারও জানা নাই। নতুন নগরীর শাসনভার থাকবে কার হাতে?  নাম কি হবে সে নগরীর? তারা ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হল সংকটমোচনের জন্য। একুশে এপ্রিল, সাতশো তিপান্ন খ্রীস্টপূর্বাব্দ। প্যালাটাইন পাহাড়ের ওপর উঠল রোমুলাস। রেমাস উঠল আভেণ্টাইন পাহাড়ের ওপর। হে ঈশ্বর, সঙ্কেত পাঠাও। অ্যাভেণ্টাইন  পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে দিয়ে গেল ছ’টি পাখি। রেমাস উল্লসিত হল। সঙ্কেত পাওয়া গেছে। সে-ই হবে নতুন নগরের রাজা। এরপর পালাটাইন পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে গেল বারোটি পাখি। রোমুলাস বলল, ঈশ্বরের সঙ্কেত স্পষ্ট। বারোটি পাখি পাঠিয়েছে ঈশ্বর। সে ই হবে রাজা। কিন্তু রোমাস বলল, ঈশ্বরের সঙ্কেত সে-ই প্রথম পেয়েছে। সঙ্কট ঘনীভূত হল। সময় না সংখ্যা? নির্ণায়ক কে? এইখানে এসে আখ্যান দুটি পথে বাঁক নিয়েছে, যদিও প্রত্যেক পথেই  কাহিনীর পরিণতি একই- ভ্রাতৃহত্যা। একটি ভাষ্য অনুযায়ী, দুই ভাইয়ের তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি এবং রেমাসের মৃত্যু। অপর ভাষ্য অনুযায়ী, নিমরাজি রেমাস মেনে নেয় রোমুলাসের কর্তৃত্ব।  নগর পত্তনের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রোমুলাস, নগরের সীমারখা নির্দিষ্ট করে দেয়। ঠিক তখনই রেমাস সেই সীমানার ওপর ঝুঁকে পড়ল। ফলে রেমাস হয়ে যায় আক্রমণকারী বহিঃশত্রু। ফলতঃ রোমুলাসের হাতে রেমাসের মৃত্যু। শহরের সীমানার ওপর যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার শাস্তি মৃত্যু, সে যে-ই হোক না কেন- ঘোষণা রোমুলাসের।   নতুন নগরের পত্তন হল। নাম হল রোম। শুরু হল রোমান সভ্যতা।পালাটাইন পাহাড় হল নতুন নগরের কেন্দ্র। রাজার ঘোষণা, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির দস্যুরা, পলাতক দাসরা, অন্য শহর ছাড়তে চাওয়া বীতশ্রদ্ধ নাগরিকরা- সকলেই  নতুন নগরে স্বাগত। তৈরি হল এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী। রাজকার্য চালনা করার জন্য একশো জন জ্ঞানীগুণী অভিজ্ঞ মানুষ নিয়ে তৈরী হল  রোমের প্রথম সেনেট। এবং এক অদ্‌ভুত সঙ্কট দেখা দিল। স্থায়িত্বের সঙ্কট।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply