অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩৩। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

ক : ‘মুম্বাই ব্যাঙ্কসি’,  টাইলার এবং গ্রাফিতি-সমৃদ্ধি 

আমাদের মুম্বাইয়ের আন্ধেরির স্ট্রীট আর্টিস্ট টাইলার বহু বিখ্যাত গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছেন তিনি বহুলাংশে ব্যাঙ্কসির দ্বারা অনুপ্রাণিত। টাইলার নামটি সম্ভবত মার্কিন ঔপন্যাসিক চার্লস মাইকেল পালাহ্নিউক (জন্ম : ১৯৬২)-এর ফাইট ক্লাব (১৯৯৬) উপন্যাসের টাইলার ডার্ডেন চরিত্রের নাম থেকে নেওয়া। এই উপন্যাসের চরিত্রে অল্টার ইগো-র প্রকাশ দেখা যায়। নিজেকে স্ট্রীট আর্টিস্ট বলে পরিচয় দেওয়া মুম্বাইয়ের টাইলার রাষ্ট্রীয় হিংসা থেকে দূরে থাকার জন্য গেরিলা অবস্থান ও ছদ্মতার আশ্রয় নিলেও প্রকাশের দিক দিয়ে খুবই ঋজু, সরাসরি, ভনিতা ও ভণ্ডামিহীন, বিপজ্জনকভাবে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক তন্ত্রের বিপরীত, ভিন্ন, বৈকল্পিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো জ্বালাময়, আক্রমণাত্মকক্ষমতাবান পুঁজিপতিশ্রেণী থেকে শুরু করে তাদের উচ্ছিষ্টভোগী চাটুকার শ্রেণী,  কৌশলসর্বস্ব মধ্যবিত্ত-দোলাচলে আক্রান্ত ভারতীয় ভদ্দরলোক শ্রেণীর পক্ষেও পিত্তদাহকারী!

   

তাঁর আঁকার ধরন অনেকটাই ব্যাঙ্কসিরই মতো, কিন্তু বিষয়গত প্রেক্ষিত ভারতীয় তাঁকে ‘মুম্বাই ব্যাঙ্কসি’ বলার একটা প্রবণতা আছে। ব্যাঙ্কসির মতোই তিনি সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন বিষয়ে সাড়া দিয়েছেন, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়েও। টাইলারও পঁুজিবাদী যুদ্ধ, দারিদ্র্য তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাঁর কাজ একই সঙ্গে সরস ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ, সপ্রতিভ ও সাহসী, তাজা ও অভিনব, অঙ্কুশতীক্ষ্ম ও ব্যঙ্গাত্মক [‘উইটি, বোল্ড, ফ্রেশ, স্যাটায়ারিক্যাল’ ( সোনালি গুপ্তা : ২০২১)] আখ্যা দেওয়া যায়। ‘শব্দ যেখানে ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ‘শিল্প সেখানে কথা বলে’ টাইলারের কাজের বিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্রাজিলের শিল্পী ম্যাথিউস লোপেজ কাস্ত্রো (জন্ম : ১৯৮৬?)-র এই উক্তিটি খুবই কার্যকর বলে মনে করেছেন ধ্রুবিন বুসা ( হোমগ্রোন : ২০২১)   

টাইলার মূলত আন্ধেরী অঞ্চলের রাস্তায় রাস্তায় নিশিযাপন করেন দেয়ালশিল্পের সৃষ্টিউল্লাসে। ফ্যাসিবাদ, ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচার, ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তিনি তীব্র ব্যঙ্গ করেন। সেইসূত্রে টাইলার একইসঙ্গে রাজনীতিচেতন এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক সংবেদনের স্বঘোষিত অতন্দ্র প্রহরী। যোগেশ্বরী, চ্যাপেল রোড বা লোখন্ডওয়ালা অথবা সান্তাক্রুজ বিমান বন্দরের আশপাশ, আন্ধেরীসহ মুম্বাই শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রাকারগুলির ক্যানভাস টাইলারের রচনার বুদ্ধিদীপ্ত িবস্ফোরণে স্পন্দিত। টাইলার পুরোপুরি গেরিলা আর্টিস্ট। কেউ তাঁকে চেনেন না, তিনি সাক্ষাৎকার দেন টেলিফোনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে। এমন-কী তিনি নারী না পুরুষ সেটাও নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেননি প্রতিবেদক (মহুয়া দাস : ২০২৩)।

একদা এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে প্রতিবেদক বিনীতা ফার্নান্ডোকে টাইলার বলেছিলেন : ‘আমি কখনও আর্ট কলেজে যাইনি (ডিজাইন পাটাকি ইন্ডিয়া নামক ব্লগে মনীষা এআরকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, ত্রিশ মিনিট দেরিতে পরীক্ষার হলে যাওয়ার ফলে তিনি এলিমেন্টারি (প্রবেশিকা ?) টেস্টে অকৃতকার্য হন। কিন্তু শিল্পের প্রয়োজনেই তিনি একজন স্বশিক্ষিত শিল্পবেত্তা হয়ে ওঠেন)  এবং অন্যদের মতো আমি শিল্প বুঝি না। শিল্প হলো আমার মতামত প্রকাশের হাতিয়ার। আপনি গায়ক হোন বা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, মানুষের আপনার কথা শোনা উচিত।’ এবং এমন শিল্পসৃজন করা উচিত যা মানুষ দেখবে, আর বুঝবে সেই শিল্পোদ্ধৃত সৃজনকর্মটির অন্তর্নিহিত ভাষা। টাইলার বিশ্বাসই করেন না শিল্পী হওয়ার জন্য কেবল দক্ষতার প্রয়োজন। আর্ট কলেজের অধ্যাপকেরা প্রথাগত শিল্প শেখান এবং বোকা মানুষেরাই বিশ্বাস করেন যে শিল্পী হওয়ার জন্য তাদের কলেজের প্রয়োজন। বস্তুত যে-কোনো প্রকৃত শিল্প তৈরি করতে হলে শিল্পীকে কষ্ট করতে হয়। ( সোনালি গুপ্তা : ২০২১)  

শঠ সংবাদমাধ্যমের দ্বারা সমালোচিত ও আক্রান্ত হতে পারেন জেনেও হলুদ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে যেভাবে তিনি ব্যঙ্গ করেন তাতে আত্মপ্রচারের ব্যাপারে তাঁকে ততটা স্পর্শকাতর বলে মনে হয় না। ‘ইয়োলো জার্নালিজম’ বা ‘ফেক নিউজ সেলার’ নামে চিহ্নিত গৃহপ্রাকারের চিত্রলিপিতে একজন সংবাদপত্র বিক্রেতার হাতে বিবিধ সংবাদপত্র সাজানো, সেগুলির নাম উইকলি ফেক নিউজ (সাপ্তাহিক ভুয়া খবর), এভরিডে লাইস ( দৈনিক মিথ্যা), নিউজ ফ্ল্যাশ, ফেক টাইমস, দি ডেইলি ফেক নিউজ ইত্যাদি। কাগজের হেড লাইন উঁকি দিচ্ছে : ‘ লেটস্্ গো টু ওয়ার’কোনো শাব্দিক প্রচারণা ছাড়াই এই চিত্র সরাসরি বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব, বাণিজ্যিক স্বার্থপরতার, মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন, কুৎসা, অকারণ গিমিক ও চমকসৃষ্টির গালে জোরালো চপেটাঘাত। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের ব্যক্তিত্ব, আধুনিক আমেরিকার অন্যতম স্থপয়িতা তথা তৃতীয় রাষ্ট্রপতি জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) সংবাদপত্রের ভূমিকা সম্পর্কে যেসব কটাক্ষ করেছিলেন (টমাস জেফারসন বলেছিলেন : ‘আমি মাসে একটিও সংবাদপত্র গ্রহণ করি না, এমনকি একটি পড়িও না, এবং এর জন্য আমি নিজেকে অসীমভাবে খুশি মনে করি।’ কিংবা ‘বিজ্ঞাপনগুলিই সংবাদপত্রের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অংশ’ অথবা  ‘যে ব্যক্তি কিছুই পড়ে না, সে সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশি শিক্ষিত যে সংবাদপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়ে না।’) তা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে এই দেয়ালচিত্রে।

পালি মার্কেট রোডের দেয়ালে টাইলার সাদামাটা বোল্ড হরফে লেখেন : ‘নেভার ফরগেট, দি ওয়ার্ল্ড ইজ ইওরস্্।’ তার ঠিক নিচে (সমস্ত কোম্পানির প্রোডাক্টের নবজ্ঞাপনে নানাবিধ আপাত লোভনীয় অফারের নিচে যেমন প্রায় দেখতে না-পাওয়ার মতো ক্ষুদ্র হরফে েলখা হয় ‘শর্তাবলী প্রযোজ্য’ বা আরও সংক্ষেপে ‘টি অ্যান্ড সি অ্যাপ্লাই’ ঠিক তেমনভাবেই টাইলার তাঁর লেখার নিচে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদে হরফে লিখে দেন : ‘টার্মস্ অ্যান্ড কণ্ডিশন অ্যাপ্লাই।’ দেয়ালে দি টাইমস অব ইণ্ডিয়া সংবাদপত্রের লোগোটি হুবহু এঁকে টাইলার লোগোর হরফেই লিখে দেন ‘দি ব্যাড টাইমস অব ইন্ডিয়া’ 

সংবাদপত্রের লিড-হেডিং হিসেবে ‘লেটস্্ গো টু ওয়ার’-এর থেকেও যুদ্ধবিরোধী সূচিমুখ ব্যঙ্গ ফুটে ওঠে যখন একটি গ্রাফিতিতে তিনি অতি সাধারণ হস্তাক্ষরে লেখেন ‘মেড লাভ, নাউ ওয়ার।’ টাইলারের অঙ্কনে একটি বালিকা বন্দুকের ধরার ভঙ্গিতে একটি ফুলের তোড়া বাগিয়ে ধরে থাকে আর সেই স্তবকের মুখে ঝরসানো আগুনের স্ফোটকের মতো উৎক্ষিপ্ত হয় হলুদ রঙের পুষ্পরাজি। এই ব্যঙ্গের থেকেও এগিয়ে থাকে ‘হিজ প্লেগ্রাউন্ড’ নামের গ্রাফিতিটি। এই চিত্রণে একটি যুদ্ধ-ট্যাঙ্কের নল বা হাই-ক্যালিবার ক্যাননের ডগায় একটি বাচ্চা ছেলে খালাচ্ছলে দোল খাচ্ছেএই চিত্রণ যুদ্ধবাজদের বিশ্বব্যাপী উন্মাদনার বিপরীতে শান্তির জন্য মানুষের সংগ্রাম ও শুভত্বের প্রতীক হয়ে থাকে।  

বিগত একটি দশক-অতিক্রমী ‘রাস্তার শিল্পী’ হিসেবে টাইলার (নিজের কাজকে এই বলেই তিনি অভিহিত করে থাকেন) অনেক রচনায় স্বাক্ষরের সঙ্গে ‘স্ট্রীট আর্ট’ কথাটির উল্লেখও করেন। টাইলার বরাবর ব্যাঙ্কসির মতোই সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সাধারণের জীবনের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সচেতন। বলাইবাহুল্য সেইসূত্রে কর্পোরেট সংস্কৃতি, লোভ, মিডিয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধতায় তাঁর চিত্রলিপিগুলি আকীর্ণ। শিশু, বালক-বালিকারা প্রায়শই এগুলির মুখ্য চরিত্র।

কিন্তু ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকে টাইলার ক্রমেই রাজনৈতিক এবং পুরোদস্তুর রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন। একাধিক সাক্ষাৎকার ও ভাষ্যে তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আমেরিকান-কানাডিয়ান ভাইস ম্যাগাজিন (সংবাদ, সংস্কৃতি, শিল্প বিষয়ক বৈকল্পিক পত্রিকা। মন্ট্রিলে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়)-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টাইলর তাঁর এই রাজনৈতিক হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট, হুমকি, আক্রমণ, গ্রেপ্তারির আশঙ্কা ইত্যাদির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি সরাসরি এতটা রাজনৈতিক হয়ে উঠলেন ? ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচন কীভাবে ও কেন তাঁকে বদলে দিল। টাইলার উত্তর দেন : ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার চারপাশের কিছু লোকের দেশ সম্পর্কে এমন সব মতামত ছিল যা উগ্র। এবং আমার থেকে একেবারেই আলাদা। 

আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল, কারণ তারা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত বি-স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং তারা সমাজে যথেষ্ট পরিচিত। তবুও, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাদের মতামত হৃদয়বিদারক। আমি কী করব? আমার কি শুধু বসে বসে চিন্তা করা উচিত, নাকি আমার এ বিষয়ে কিছু করা উচিত? শিল্পের উদ্দেশ্য হলো আপনাকে একটু খুশি করা এবং সঙ্গে সঙ্গে একটু (চৈতনিক) অস্বস্তিতেও রাখা। আমি আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের দেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে প্রায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কারণ এটি অবাধে পাওয়া যায় এমন বিশাল তথ্যের দ্বারা পুষ্ট। টিভিতে, সংবাদপত্রে, রেডিওতে, ভিডিওতে, সোশ্যাল মিডিয়াতে এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে এগুলিকে স্প্যাম ফরোয়ার্ড করা হয়। এই কাজ প্রচারণার দ্বারা মগজ ধোলাই করার সমতুল্য। এবং প্রচারণাকে পরাজিত করার জন্য, আদর্শ কাজ হল সৎ, বাস্তব রাস্তার শিল্প দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।’ 

টাইলর প্রথমে সামাজিক বিষয়ের অসঙ্গতি নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে ব্যঙ্গ-শ্লেষ-বিদ্রূপ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সার্কাস্টিক- মজা করে আনন্দ পেতেন। কিন্তু বছরের পর বছর দেশ-কাল-পরিস্থতির জটিল ও ক্রমজালিক পরিস্থিতি, অন্যায়-অত্যাচারের নীতিহীন বৈধতা, ক্ষমতার অপভাষ্যপীড়িত চেহারা দেখে তিনি অনুভব করতে পারেন যে, তিনি নিজের এই দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন, ব্রিটিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাসের উত্তরাধিকার সূত্রে আজকের পরিস্থিতিতে অনেকটা মুক্তিযোদ্ধা’র মতো মনে হয় তাঁর নিজেকে। এখন থেকে কম কিছু নয়। তার প্রতিবাদেই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা ও ফতোয়া উড়িয়ে দিয়ে দেয়ালের গায়ে, রাস্তার জন্য তিনি তুলি ধারণ করেন। রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতা,  প্রাদেশিকতা, ভাষা ও বর্ণ (বিশেষ বিশেষ রঙকে বিশেষ ধরনের সংকীর্ণতা ও প্রচারণা সর্বব্যাপী প্রতীক করে তোলা) সন্ত্রাসের বিরোধিতায় টাইলারের তুলি-মার্কার-স্প্রে-স্টেনসিল চলতে থাকে।

এই শিল্প অভিযানেই টাইলার আঁকেন ভারতের মানচিত্রকে দ্বিখণ্ডিত করতে উদ্যত মোদি ও রাহুল গান্ধীর টানাপোড়েনের ছবি, তাঁর বিখ্যাত গ্রাফিতি টাগ অব ওয়ার’ এর চেয়েও কঠিন ব্যঙ্গ প্রকাশিত হয় তখন, যখন স্যুটেড-বুটেড মোদি ও রাহুল গান্ধীর হাতে শিল্পী সখ্যের ছলে লাভ-সাইন বেলুন ধরিয়ে দেন। এই রচনাকে যে যেভাবে পারেন ব্যাখ্যা করুন না কেন এই শিল্পবস্তুর ব্যঞ্জনার পরিসর বাড়তেই থাকবে। এই সঙ্গেই উল্লেখ্য মহাত্মা গান্ধীর চিরাচরিত উপস্থিতির সঙ্গে গিভ মি ফ্রিডম’ বয়ানটি, মহাত্মা গান্ধীর হাতে স্প্রে প্রিন্ট ক্যানকিংবা কার্টার রোডে গান্ধীর ম্যুরালটির সঙ্গের বিবৃতি ‘ভণ্ডামি কি ভি সীমা হোতি হ্যায়’ (ভণ্ডামির একটি সীমা আছে। উল্লেখ : ধ্রুবিন বুসা : ২০২১)জহরলাল নেহরুর (তাঁর হাতেও সম্ভবত একটি স্প্রে পেইন্ট ক্যান) ম্যুরালের সঙ্গে এই আর্তিও লেখা থাকে : না, মোদিজি না’ মুম্বাই বিমানবন্দর কমপ্লেক্সের একটি পরিত্যক্ত ভবনের ভাঙা দেয়ালের ও কংক্রীটের ধ্বংসস্তূপের সামনে টাইলারের এমন আরেকটি অসামান্য কাজ ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রদায়িক জবরদস্তি ও ইতিহাসের বিকৃত ন্যারেটিভের বারংবার বলে চলার প্রচারকৌশলের চেহারাকে উলঙ্গ করে দেয়। মলিন দেয়ালে সবুজ রঙের জমি তৈরি করে তাতে অবিরাম লিখে চলা একটিই বাক্য : ‘আই মাস্ট সে জয় শ্রীরাম টু প্রুভ মাই ন্যাশনালিটি’ (আমার জাতীয়তা প্রমাণের জন্য আমাকে অবশ্যই জয় শ্রী রাম বলতে হবে’)এই অদ্ভুত ও শক্তিশালী অথচ স্বৈরাচারী বার্তাটিকে দেখছে বার্ট সিম্পসন (বার্ট সিম্পসন হলো আমেরিকান টেলিভিশনের অ্যানিমেটেড দ্য সিম্পসন’ সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র। বার্ট সিম্পসন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান ও একমাত্র পুত্র। বার্ট সিম্পসনের বয়স দশ বছর। সে দুষ্টু, বুদ্ধিমান, তার্কিক, ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী, কৌতুকপ্রবণ, খামখেয়ালি ধরনের)। বার্ট তার দুষ্টুমির জন্য বিখ্যাত এবং কর্তৃত্বের প্রতি তার অবজ্ঞার জন্য পরিচিত।’ ( শ্রেয়া দাস : ২০১৯)  

টাইলারের অপর অসামান্য কাজ লস এঞ্জেলসে হলিউড ‘দি ওয়াক অব ফেম’-এর (হলিউডের বুলেভার্ডের ফুটপাথে তারকাদের নাম খচিত হয়ে আছে হলিউডের ঔজ্জ্বল্যের হিসেবে। ‘চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, থিয়েটার, রেডিও এবং সংগীতের প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচটি ভিন্ন প্রতীক রয়েছে, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া সহজ করে তোলে’) প্যারডিস্বরূপ টাইলার ‘দি ওয়াক অব শেম’ প্রকল্পের মাধ্যমে ‘দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ উপস্থাপক, ছদ্ম-বুদ্ধিজীবী সেলিব্রিটি এবং সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখা ভণ্ডদের উপর পাল্টা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি মালাডের একটি ফুটপাথকে বেছে নিয়েছেন। টাইলার তাঁর ইনস্টাগ্রাম কমেন্ট সেকশন সকলকে ভোট দিতে এবং এমন ব্যক্তিদের মনোনীত করার সুযোগ দেন যাদেরকে মানুষ মনে করে যে তারা মানুষের ক্ষতি করে, হয় তাদের পক্ষপাতের মাধ্যমে অথবা সামাজিক বিষয়গুলিতে আত্মতুষ্টিমূলক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে। টাইলারের ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে ভোটার হিসেবে নাম লেখানো হয় এবং পরের সপ্তাহে বিজয়ীর নাম ‘ওয়াক অফ শেম’-এ খোদাই করা হয়। (ধ্রুবিন বুসা : প্রাগুক্ত প্রতিবেদন) সেখানেই তিনি এমন সব নামের সিরিজ এঁকেছেন যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাবশালী, সেলিব্রিটি, ক্ষমতার জোরে জনগণের স্বার্থবিরোধী মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত।

টাইলার এবং অকাল প্রয়াত হানিফ কুরেশি ওরফে ডাকু (১৯৮২-২০২৪), নারীবাদী শিল্পী শিলো শিব সুলেমান, পূর্বোক্ত আনপু ভার্কে, জ্যাস চরঞ্জীবা, কাজল সিং (?), ঝিল গোরাদিয়া (?), অবন্তিকা মাথুর (?), লীনা ম্যাকার্থি, উল্লাস, আপ্পুপেন, বন্ড, আইকো (এআইসিও), আনও (এএনও), জ়াইন ( জ়েডআইএনই), ইনটি (আইএনটিআই), রুচির সোনি, ভরত গুজরাটি (?) , সমীর কুলাভুর, অন্ধা রাস (?), ঋত্বিকা পাণ্ডে, খ্যাতি ত্রিহান (?), ট্রেসপাসারস, অস্থি মিলার, গেস হু, অর্জুন বহল, অঙ্কুশ চৌধুরী, ভরত যাদব, আফজ়ান ফিরজাদে, ফোর এভার ওপিসি প্রা. লিমিটেড (?), মিট ক্রিয়েটিভ আর্ট (?), ইন্ডিয়ান ওয়াল আর্টিস্ট (?), এসটি.+আর্ট, ইণ্ডিয়া, যন্তর, ভরত ঠাকোর, প্রমুখ শিল্পী ও সংস্থার দ্বারা অঙ্কিত রাস্তার শিল্পের সৌজন্যে আবর্জনালাঞ্ছিত, কর্পোরেট ও বাণিজ্য বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে দমবন্ধ, ‘পুঁজিবাদী এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক কংক্রিট জলাশয়ে পরিণত’ (তদেব), রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারণায় পীড়িত বৃহত্তর মুম্বাইয়ের (দিল্লি, পুনেসহ অন্যান্য শহর) বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ অন্যত্রও (ব্যাঙ্গালোর, গোয়া ইত্যাদি উল্লিখিত অঞ্চলগুলি) বহুলাংশে বদলে যায়, অনুভব করা যায় নিষিদ্ধ ভিন্নমতের বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতার আলো।

টাইলারের মতোই ডাকুকেও ভারতীয় ব্যাঙ্কসি বলেন কেউ কেউ। ডাকুর কাজের উল্লেখ ছাড়া বিশেষভাবে দিল্লির স্ট্রীট আর্ট বা রাস্তা শিল্পের আলোচনা সম্পূর্ণতা পেতে পারে না। টাইলারের মতো ডাকুরও পরিচয় প্রকাশে অনীহা ছিল। টাইলারের মতোই সরাসরি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত জীবনকে তিনি সরাসরি সমালোচনা করেছেন। রান্নার গ্যাসের দামবৃদ্ধিকে ব্যঙ্গ করেন তিনি (গ্যাস সিলিন্ডার তাঁর হাতে বৃহৎ বোমার চেহারা পায়), প্রত্যেকটি ‘স্টপ’ সাইনের বোর্ডের নিচে ডাকু শপিং, গসিপিং, প্রমিসিং বা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ, হনকিং, ব়্যাপিং, ব্রাইবিং, প্রিটেন্ডিং, ভ্যান্ডালিজম ইত্যাদি শব্দ লিখে দেন ( সোহম মণ্ডল : ২০১৫)। ডাকু বরাবরই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পথে হেঁটেছেন। নিজেকে মালিকের অনুমতিহীন দেয়াল-ছিনতাইকারী হিসেবে চিহ্নিত করছেন তিনি।

পুনের শিল্পী কার্তিকে শর্মাও গ্রাফিতিকে মানুষের সৃজনশীল অস্তিত্বের হাতিয়ার বলে মনে করেন। গ্রাফিতি দেয়াল নোংরা করে বা দৃশ্যদূষণ ঘটায়― এমন অভিযোগের উত্তরে আনপু ভার্কে বলেন যে, তামাকের দাগ এবং সিনেমার পোস্টারে আকীর্ণ দেয়ালে সুন্দর ছবি দেখার অভিজ্ঞতা বরং ভালো। অপরদিকে দিল্লির মতো শুষ্ক ও কুৎসিত শহরের দেয়ালে গ্রাফিতির মতো সুন্দর বস্তু থাকাই তো ভালো― বলেন যন্ত্র (?যন্তর)।

(ক্রমশ)

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply