অকূলের কাল। পর্ব ৩৫। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

চাকুরিওলা

পরের মাস থেকেই ক্ষিতির একটা ভালোমতো হিল্লে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেল। সৌজন্যে কোম্পানি। এই মাসের শেষের দিকে সে যখন এক রবিবারে হেলু আর বুড়িকে পড়াচ্ছে, কোম্পানি খবর পাঠালেন, সে যেন যাবার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করে যায়। কোম্পানির সঙ্গে দেখা করা মানেই দুরুদুরু বক্ষ। তিনি যে কখন মিষ্টি কথা বলবেন আর কখন যে কটু কথা – সেটা এমনকি, রঞ্জিতও আন্দাজ করতে পারে না। সকালবেলায় অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি শোবার ঘরের মেঝেতে বসে চা-টা খান আর খবরের কাগজ পড়েন। অফিস না থাকলেও তাঁর রুটিন বদলায় না।  ক্ষিতি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কাগজ থেকে মুখ তুলে তিনি একটা বিড়ি ধরালেন। বিড়ি শেষ হওয়ার আগেই ক্ষিতিকে নির্দেশ দেওয়া সারা হয়ে গেল – কাল অমিয় যখন অফিস যাবে ওর সঙ্গে বাগরি মার্কেটে চলে যাবে। ওর জয় ইন্ডাস্ট্রি যে বাড়িতে, তারই পাশের পাঁচতলা বিল্ডিংটায় অনেকগুলো ওষুধের স্টকিস্ট ব্যাবসা চালায়। বহু খদ্দের ওদের দোকান থেকে হোলসেল দরে খুচরো ওষুধ কিনে নিয়ে যায়, আবার ওরা একই দরে কলকাতা এবং আশেপাশের ওষুধের দোকানে লোক দিয়ে ওষুধ সরবরাহও করে। তুমি তিনতলায় উঠে জি এম মেডিক্যাল স্টোর্সের মালিকের সঙ্গে দেখা করে আমার নাম বলবে। লোকটার নাম গোবিন্দ সাহা, মহা ধড়িবাজ। যাই হোক – লোকটা তোমাকে কী বলে না বলে, কাল সন্ধেবেলায় আমাকে এসে জানাবে।

ব্যাস, কথা শেষ। ক্ষিতি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে আসে তাঁর ঘর থেকে। রবিবারে এখানে তাসের ভালো আসর বসে। খেলায় সুযোগ পাবে কি-না অমিয়র সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে। পেলে ভালো, এখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে খিদিরপুরে টিউশন সেরে কোয়ার্টারে ফিরবে সন্ধে নাগাদ, না পেলে এখনই ফিরে যাবে।

পরের দিন সকাল নটায় খিদিরপুরের মোড় থেকে অমিয়র সঙ্গে ডালহৌসির বাসে উঠে বসল ক্ষিতি। আগের দিন তাস খেলায় সুযোগ না পাওয়ায় আজকের ব্যাপারে অমিয়র সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। বাসে উঠে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেটাই জিজ্ঞেস করল ক্ষিতি। – কেন পাঠাচ্ছে আমাকে গোবিন্দ সাহার কাছে – জানিস?

–কেন আবার, চাকরিবাকরি কিছু যদি দেয় –

–দোকানের কর্মচারী? ওষুধ বিক্রি করতে হবে?

–হতেও পারে। তবে এই স্টকিস্টগুলো একটা খুপরি ঘরে ব্যাবসা করে। ওষুধে ঠাসা থাকে। মালিকই বসার জায়গা পায় না ভালো করে। একটাই কাউন্টার। দোকানে কর্মচারী রাখার প্রশ্নই নাই। মনে হয়, তোকে সেলসম্যান হিসাবে নেওয়ার জন্যে কোম্পানি বলেছে সাহাকে। মানে, দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে ওষুধের অর্ডার জোগাড় করে আনতে হবে।

–কোম্পানি বললেই দেবে?

–দেবে না মানে! ঘাড় দেবে। ডক লেবার বোর্ড হাসপাতালে হাজার হাজার টাকার ওষুধ বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে না সাহার!

ডালহৌসিতে নেমে অমিয় বলল, –রঞ্জিত ভাত রেঁধেছিল? খেয়ে এসেছু?

খাওয়া হয়নি শুনে পকেট থেকে কয়েকটা পাঁচ টাকার নোট বের করে তার থেকে বেছে বেছে সব থেকে ময়লাটা ক্ষিতির হাতে দিয়ে বলল, – সামনের ফুটে যে ভাতের হোটেলটা আছে, ভালোই রাঁধে। সাহার দেখা পেতে তোর এগারোটা বেজে যাবে। ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে যাবি মামা –

টাকাটা ধরিয়ে দিয়েই পাঁইপাঁই করে নিজের অফিসের দিকে ছুটল অমিয়। তার অফিসে দশটার মধ্যে হাজিরা দিতেই হবে। তার মালিক সিনহা সাহেব খুব কড়া লোক, অমিয় তার কাছে নিয়মিত বাছা বাছা গালাগালি শিখছে, প্রয়োগও করে সুযোগ পেলেই।

অমিয়র বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল সাহার জিএম মেডিক্যাল স্টোর্স। একটা আট ফুট বাই দশ ফুট খুপরি ঘর, তার মেঝে থেকে সিলিঙ পর্যন্ত ওষুধপত্তরে ঠাসা। তারই একপাশে একটা ছোট টেবিলের পিছনে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে একটি শ্যামলা রঙের রোগা, লম্বা, বছর পঁয়তাল্লিশের লোক, তার মোটা আছাঁটা গোঁফ ঝুলে আছে ঠোঁটের উপর। ক্ষিতি হাতজোড় করে ‘নমস্কার’ বলতেই সাহা চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। অবিকল মরা মাছের চোখ। ‘রাধারমণ সন্নিগ্রহী পাঠিয়েছেন’ – বলার পরেও কোনো অভিব্যক্তি ফুটল না তার চোখে। কেবল দরজার গায়ে ঠেসানো টুলটার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, – বসুন।

ক্ষিতি বসতেই সাহা একতরফা ভাবে মিনিট পনেরো কথা বলে গেল। তার স্বরে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, ওঠাপড়া নেই –

আমার ছোট্ট দোকান, সামান্য পুঁজি। দুজন মাত্র কর্মচারী আছে। একজন উত্তর কলকাতায় সেলসম্যান। বহু দিনের পুরনো লোক। আর একজন বেয়ারা আছে, সেলসম্যান ওষুধের যেসব অর্ডার আনে, সেসব দোকানে দোকানে পৌঁছে দেয়। বয়স হয়েছে তার। কদ্দিন পারবে কে জানে। স্টোরকিপারবাবুর লোক আপনি, বলেছেন যখন ব্যবস্থা তো করতে হবে। দক্ষিণে আমাদের ব্যাবসা হয়না বিশেষ। আপনি ডায়মন্ড হারবার রোডটা ঘুরতে পারেন, খিদিরপুর থেকে ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত; আর এদিকে টালিগঞ্জ থেকে ভবানীপুর। সামান্যই জায়গা। এদিকে একদিন তো ওদিকে একদিন। কী করতে হবে আপনাকে ভাবছেন তো? বিশেষ কিছুই না। আমি তিনটে কোম্পানির ওষুধ বেচি। অ্যালবার্ট, ইন্ডন আর ইমার্ক। প্রথমটা চলে না বিশেষ। পরের দুটো চলে, ইমার্ক ভালোই। আপনি প্রত্যেকটা দোকানে ভিজিট করবেন। এই তিনটে কোম্পানির ওষুধ যাতে আমাদের কাছ থেকে নেয়। আমরা হোলসেল লিস্টেড প্রাইসের উপর কেবল এইট পারসেন্ট ট্যাক্স নিয়ে দোকানে পাঠিয়ে দেব। কোম্পানিও এই দামে দিতে পারবে না। তবে মনে রাখবেন, ধারে মাল দিতে পারব না, চেকে পেমেন্ট নেব না। নগদে দাম দিতে হবে। চেক নেওয়া যেতে পারে দোকানের গুডউইল বুঝে। সে দায়িত্ব আপনার। চেক বাউন্স করলে আপনার মাইনে থেকে কেটে নেব, মনে রাখবেন। হ্যাঁ, মাইনে বেশি দিতে পারব না। একশো টাকা আর যাতায়াতের খরচ পঁচিশ। এতে যদি চলে তাহলে পরের মাসের পয়লা থেকে কাজে লেগে যান। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়বেন। ওষুধের দোকান আটটা থেকেই খুলে যায়। ঘণ্টা ছয়েক ঘুরলেই সব দোকান কাভার হয়ে যাবে। তারপর বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে চারটের সময় অফিসে এসে সেদিনের অর্ডার দোকানে দিয়ে গেলেই আপনার ছুটি। বিল তৈরি তো করতে পারবেন না। সেটা আমি উত্তরের বিকাশবাবুকে দিয়ে করিয়ে পরের দিন মাল পাঠিয়ে দেব। আপনি অর্ডারের বিল বই আজই কয়েকটা সঙ্গে নিয়ে যান। বিল বইয়ে ওষুধের তালিকা লিখে মালিক বা ম্যানেজারের সই করিয়ে এনে জমা দেবেন।

একটু থামল সাহা। গলা নামাল এক পরত। বলল, -ভালো অর্ডার আনতে পারলে মাইনে বিবেচনা করে যাবে ভবিষ্যতে।

ঠিক এই সময়েই একটি আটহাতি ধুতি আর সার্ট পরা একটি বুড়োমতো ছোটখাটো লোক হাজির হলো দোকানে। সাহা বলল, – এই হলো হরিবাবু। দোকানে দোকানে ওষুধ নিয়ে যায়। হরি, এই ছেলেটিকে দক্ষিণের জন্যে রাখছি। পরের মাস থেকে দক্ষিণেও মাল দিয়ে আসতে হবে তোমাকে। ভেবো না, টি এ বাড়িয়ে দেব।

হরিবাবুকে এই খবর উৎফুল্ল করল বলে মনে হলো না। ক্ষিতি অবশ্যই উৎফুল্ল। একশো টাকা মাইনে, তার উপর টিএ পঁচিশ। রীতিমতো বড়লোক বলতে হবে। বাড়ি থেকে সত্তর টাকাও আসত না সব মাসে। কাজটা কীরকম করতে পারবে কে জানে! দেখা যাক। এই চাকরিতে বিয়ে করলেও অসুবিধে নেই। সেটা কখন হবে কে জানে, আপাতত রঞ্জিতের রান্নাঘর তো সচল থাক।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply