কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ২। শোভন সরকার
গত পর্বে: কাশীর গলিতে রাস্তা হারিয়ে আমদের দেখা হল এক স্থানীয় বাঙালি ভদ্রমহিলার সাথে। উনার কাছেই জানতে চাইলাম কালভৈরবের কাহিনি।
‘হ্যাঁ ঠিক। আপনি কালভৈরবের উৎপত্তির গল্প দিয়েই শুরু করুননা। অনেকে অনেক রকম বলে, বিভ্রান্তি হয়।’
‘সে সত্যিই এক অদ্ভুত গল্প। আর এর সঙ্গে কাশীর নিবিড় যোগও রয়েছে। আমি যা বলছি তার উৎস মূলতঃ স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ড।
একবার হল কি, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে প্রচণ্ড তর্ক বেধে গেল। কী নিয়ে সেই তর্ক? তর্ক এই যে কে সবচেয়ে শক্তিশালী? ব্রহ্মা বলেন তিনি শ্রেষ্ঠ, তো বিষ্ণু বলেন তিনি। কিন্তু যখন সেই তর্কের কোন সমাধান হলনা, তাঁরা চতুর্বেদকে স্মরণ করলেন। তাঁদের অনুরোধ করলেন এই সমস্যার যথোপযুক্ত সমাধান দিতে। একে একে চার বেদের প্রত্যেকেই বললেন যে ব্রহ্মা বা বিষ্ণু কেউই নয়, বরং মহাদেবই হলেন শ্রেষ্ঠতম। বলা বাহুল্য, এই উত্তরে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, বরং তাঁরা মহাদেবকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সেই উত্তর অগ্রাহ্য করলেন। তখন তাঁদের ঠিক মাঝখানে এক পরম জ্যোতিস্তম্ভ উদ্ভূত হল। তার আদি-অন্ত খুঁজে পাওয়া যায়না। বিষ্ণু তো নিজের হার মেনে নিলেন। জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নিলেন নিজের মূঢ়তায়। অন্যদিকে সেই জ্যোতির্লিঙ্গে শিবকে দেখে ব্রহ্মা নিজের অহংকারে অন্ধ হয়ে তাঁকে নিজের শরণে আসতে বললেন। ব্রহ্মার এই স্পর্ধা দেখে শিবের ভয়ানক ক্রোধ সৃষ্টি হল। তখন তাঁর সেই ক্রোধ থেকে জন্ম নিল ভয়ালদর্শন কালভৈরব। শিবের নির্দেশে ব্রহ্মাকে ‘শিক্ষা’ দিতে কালভৈরব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক তাঁর নখ দিয়ে খুঁটে তুলে ফেললেন। কিন্তু হত্যা করলে তো শাস্তি ভোগ করতেই হবে, এই হল বিধান; সে তিনি স্বয়ং শিব হোন বা তাঁর ভয়াল রূপ। কালভৈরবের হাতে ব্রহ্মহত্যা হল। ব্রহ্মহত্যার পাপের জন্য ব্রহ্মার সেই মুণ্ড ভৈরবের হাতেই আটকে রইল। কোন কোন সূত্র বলে ব্রহ্মার মুণ্ডচ্ছেদ করার কারণে এক ভয়ালদর্শন ব্রহ্মহত্যাস্বরূপ পাপ তাঁর পিছু নিল। কিংবা দুটোই একসাথে হয়েছিল। সে যাই হোক, এখন উপায়? শিব স্বয়ং, অন্যমতে বিষ্ণু, কালভৈরবকে বললেন কাশীতে যেতে। ওখানেই তিনি তাঁর সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হবেন। কালভৈরব তখন ব্রহ্মার সেই হাতে লেগে থাকা ‘কপাল’ অর্থাৎ করোটি হাতে ‘কাপালিকবৃত্তি’ ধারণ করলেন।’
মনে প্রশ্ন এল – কী এই কাপালিকবৃত্তি? ভদ্রমহিলা বোধ হয় সেটা আঁচ করেই বললেন যে, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা মনে আছে তো? সেখানে কিন্তু ছিল এক কাপালিক। এই কাপালিকরা শৈবধর্মের এক তান্ত্রিক সম্প্রদায়। এরা সাধারণতঃ নরবলি দেয়, নরমুণ্ড রাখে, শ্মশানের ছাই মাখে, ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন করে। এইভাবে ঠিক কালভৈরবের অনুকরণে এরা বারো বছর ধরে ‘মহাব্রত’ পালন করে নরবলির পাপ থেকে মুক্ত হতে। এই ব্রত আসলে ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপের নিদান। পাপমুক্ত হতে গেলে বারো বছর ধরে তাকে নরকরোটি ও মুগুর বয়ে বেড়াতে হয়, ভিক্ষান্নে স্বল্পাহার করে জীবনধারণ করতে হয়, ভিক্ষা করতে করতে নিজের পাপকর্মের কথা ঘোষণা করে অনুশোচনা প্রকাশ করতে হয়। তবে আজকাল এই ধরণের সম্প্রদায়কে দেখা যায় না। এদের থেকেই পরবর্তীকালে এক নতুন ধারা বেরিয়ে আসে, তারাই অঘোরী। এই তো রবীন্দ্রপুরী থেকে মদনপুরা যাওয়ার সময় দেখতে পাবে বাবা কীনারাম স্থল। ওটাই হল অঘোরপন্থীদের মূলকেন্দ্র।’
‘আচ্ছা, তারপর কী হল আমাদের কালভৈরবের? ব্রহ্মহত্যা পিছু ছাড়ল?’
‘হ্যাঁ, ছাড়ল। সমস্ত লোক ঘুরে আসার পর কালভৈরব কাশীতে এসে পৌঁছানোমাত্রই ব্রহ্মহত্যার পাপ তাঁকে ত্যাগ করল। হাত থেকে খসে পড়ল সেই করোটি। যেখানে এই কাণ্ড হল সেই জায়গাই কপালমোচন তীর্থ নামে পরিচিত।’
এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলি। কাশীখণ্ড বা শিবপুরাণে বর্ণিত অনুরূপ গল্পে কয়েকটা জিনিস বিশেষ লক্ষ্য করার মত। যেমন একটি হল কাশীতে শিবের সর্বাধিক প্রাধান্য। বিভিন্ন কাহিনির মাধ্যমে এই তত্ত্বকে বারবার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেমন আমরা দেখলাম কালভৈরবের গল্পে, এখানে শিব সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। আবার রাজা দিবোদাসের কাহিনিতে দেখি রাজার কারণে সমস্ত দেবদেবীকে কাশী ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কৌশলে শিব সপার্ষদ আবার কাশীতে নিজের স্থান অর্জন করেন। এই কাহিনিগুলো কাশীতে বহুকাল ধরে শৈবধর্মের সাথে অন্যান্য মতবাদের যে দ্বন্দ্ব চলে এসেছে তার পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়। আবার, নানা সময়ে শৈবধর্মের সঙ্গে প্রাধান্য স্থাপনের প্রতিযোগিতায় বৈষ্ণব ধর্মও যে কাশীতে নিজের যথোপযুক্ত শক্তি প্রদর্শন ও নিজের অবস্থান পাকাপাকি করেছে তার ইঙ্গিতও এখান থেকে পাওয়া যায়। লক্ষ্য করে দেখুন, শিবের সমান না হলেও আজও কাশীতে বিষ্ণুর উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রথযাত্রা, রামলীলা, নাগনাথৈয়া, বিতর্কিত বিন্দুমাধব মন্দির ইত্যাদি এই সমস্ত কিছুই কাশীতে বিষ্ণুর গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। এই ব্যাপারে অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আরও একটি ব্যাপার এই যে, কাশীকে ঘিরে যে পাপমুক্তির এক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে, কালভৈরবের কপালমোচনের এই ঘটনা সেই বিশ্বাসকেই জনমানসে আরও দৃঢ় করে তোলে। সত্য বা মিথ্যার প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে মিথ বা লোকবিশ্বাস তত্ত্বরূপে সচেষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে।
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘দিদা, ঠিক কোন জায়গায় এই কপালমোচন তীর্থ?’
‘দেখ, এই নিয়ে মতভেদ আছে। আসলে এটা আশা করি তোমরা বোঝ যে পৌরাণিক কথকতা অনেক সময়ই রূপক হয়। কোন এক বিশেষ তত্ত্বকে মানুষের কাছে সহজবোধ্য, বিশ্বাসযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সক্রিয় প্রবণতা এই সমস্ত গল্পে দেখা যায়। এই যে পুরাণ বা বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রকে অকাট্য বলে মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে দেখি, মনে রাখতে হবে যে অনেক সময়ই এগুলো প্রথমে মুখে মুখে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রচলিত হয়; লিখিত আকারে আসে অনেক পরে। কাজেই নানা মতভেদ, ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা পক্ষপাতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই এই সব লেখায় চলে আসে। এই কারণেই একই কাহিনির বা তত্ত্বের ভিন্নান্তর দেখা যায় হামেশাই।
কপালমোচনের অবস্থান নিয়েও ব্যাপারটা অনেকটা তাই। অনেকের মতে এই কপালমোচন তীর্থ মৎস্যোদরী কুণ্ড (বর্ষাকালে গঙ্গা থেকে এখানে জল প্রবেশ করে ভরে গেলে এর আকার অনেকটা মাছের পেটের মত দেখাত বলে এর এরূপ নাম হয়) তথা বর্তমান কালের মচ্ছোদরী কুণ্ড ও গঙ্গার সঙ্গমে অবস্থিত ছিল। ছিল এই কারণে বলছি যে শহরের ক্রমবিস্তার ও আধুনিকীকরণে গঙ্গার জল এখন আর এই কুণ্ড অব্দি পৌঁছায়না। আবার কেউ কেউ বলেন এখন কাজ্জাকপুরায় লাট ভৈরবের যে কুণ্ড রয়েছে সেটাই নাকি আসলে কপালমোচন কুণ্ড। তবে বেশিরভাগ তথ্যসূত্র প্রথম তত্ত্বকেই বিশ্বাস করে। যেমন জানা যায় ঊনবিংশ শতাব্দির শুরু পর্যন্তও প্রবল বর্ষায় বরুণা নদীর জল পাপমোচন কুণ্ড, ঋণমোচন কুণ্ড, কপালমোচন কুণ্ড হয়ে মৎস্যোদরী কুণ্ডের জল বাড়িয়ে দিত। ভীষণ পবিত্র বলে মনে করা হত এই সময় মৎস্যোদরীকে। দ্বাদশ শতকে গহড়য়ালদের লিপিতে বর্ষার সময়ের ভরা কপালমোচনের উল্লেখ পাই আমরা।’
পরবর্তীকালে এই বিষয়ে পড়তে গিয়ে জয় নারায়ণ ঘোষালের ‘কাশী পরিক্রমা’ গ্রন্থে আরও কিছু বিবরণ পাই — “কামেশ্বর শিবলিঙ্গের নিকট প্রাচীন মৎস্যোদরীতীর্থ ছিল। শিবপুরাণাদিতে এই প্রাচীন তীর্থের উল্লেখ আছে। মৎস্যোদরীতীর্থে স্নান করিলে মানবের গর্ভযন্ত্রণা থাকে না। এই তীর্থের এখন চিহ্নমাত্র নাই, প্রায় ৫০ বর্ষ পূর্ব্বে কোন সাহেব (অন্যত্র লেখক এঁকে জেমস্ প্রিন্সেপ বলে উল্লেখ করেন) ইহা ভরাট করিয়া দেন। পূর্ব্বে অনেক তীর্থযাত্রী এখানে স্নান করিতে আসিত।” স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দের সম্পাদনায় ‘শিবপুরী কাশী’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বলা রয়েছে যে জেমস্ প্রিন্সেপ প্রকৃতপক্ষে ‘মৎস্যোদরী টানেল’ নামে এক ভূগর্ভস্থ জলনিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। লক্ষ্য — বেনারসকে অহরহ জমা জল ও আবর্জনার হাত থেকে রক্ষা করা। সেই উদ্দেশ্যেই এই জলাশয়টি ১৮২৬-২৭ সাল নাগাদ ভরাট করে দেওয়া হয়।
‘কিন্তু দিদা, একটা প্রশ্ন আমার মনে এখনও আসছে। কেন সবাই বলে যে কালভৈরবের অনুমতি ছাড়া কাশী দর্শন বৃথা? এর পেছনেও কোন গল্প আছে নাকি আবার?’ শেখর জিজ্ঞেস করল।
‘সে না হয় বলছি, কিন্তু শোন, আজকে রাতে তোমরা আমার এখানেই খেয়ে যাবে। হোস্টেলে গিয়ে কি আর খাবার পাবে?’
এই বলে ভদ্রমহিলা উঠে পড়লেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘চলে যেতে বলছ, দিদা?’
উনি আবার হাসলেন। বললেন, ‘আরে না না, আমার নিজেরও বেশ ভাল লাগছে তোমাদের সাথে কথা বলতে। কাশীতে এসেছ, কাশীর আতিথ্য দেখবে না? তোমরা বস, আমি আসছি।’
উনি আমাদের সামনের কাপ, বাটি সব নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি সত্যি আপ্লুত তখন। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা দু’জন অল্পবয়সী ছেলেকে কোন ভরসায় এই ভদ্রমহিলা এত স্নেহের সঙ্গে আপ্যায়ন করছেন? পরবর্তীতে বেনারসে থাকার সময় ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে এখানে মানুষেরা সত্যিই অত্যন্ত সাদা-সিধে। দূর থেকে একজন বহিরাগত হিসেবে এই শহরকে ধূলো-আবর্জনায় ঢাকা এক ব্যস্ত শহর বলে মনে হবে। প্রতি বছর বহু মানুষ নানা কারণে এই শহরে আসছে, ঘুরছে, নোংরা করছে, চলে যাচ্ছে। তাদের কাছে বেনারসের কেবল বাহ্যিক চেহারাই চোখে পড়ে। এত প্রাচীন একটা শহর, এত ভাবে এত যে এর বিস্তার, এই শহরকে সম্পূর্ণ অনুধাবন করা অলৌকিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে বসবাস করা মানুষদের সঙ্গে মিশতে গেলেই ধীরে ধীরে বুঝবেন যে কোন পরিস্থিতিকে অবিচলিত হয়ে গ্রহণ করা, একসঙ্গে সময় কাটানো, আমোদ-ফূর্তি করা এদের রক্তে মিশে আছে। মৌসুমী দি’র সাথে আমার পরিচয় বেনারসের একটি স্কুলে চাকুরি করতে গিয়ে। উনি হেসে বলেন, ‘এখানে সবাই পাগল।’ পাগল অল্প খুশিতে, অল্প দুঃখে, অল্প রাগে, আবার হাসি-ঠাট্টায় রঙিন পাগল। ভোলার শহরে পাগল থাকবে না তা কী করে হয়! বন্ধুরা এই হয়তো তুমুল ঝগড়া-মারপিট করছে, আবার তারাই একসাথে টেবিলে বসে খাবার কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। আবার হয়তো দেখবেন ঘাটে বসে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একজন মানুষ অল্প সময়েই যেন একেবারে আপনার হয়ে হাসিঠাট্টা করে জীবনের দু’টো গূঢ় কথা বলে চলে যাবে। বেনারসে থাকার সময় সোনিয়ালের সঙ্গে আলাপ হয়। সে এখানেই জন্মেছে, বড় হয়েছে। একবার কথায় কথায় সোনিয়াল আমায় বলে, ‘বাইরের মানুষেরা একজন বানারসিকে অনেক সময়ই ধূর্ত-চতুর-প্রতারক হিসেবে দেখে। আসলে সেটা তাদের করতে হয় নিজেদের পেট চালাতে। ভুললে চলেনা যে বেনারসের আয়ের অনেকটাই নির্ভর করে এর পর্যটন শিল্পের উপর। সেখানে দাঁড়িয়ে যেটুকু দরদাম না করলেই নয় সেটুকু তারা করে, আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আদতে এরা অত্যন্ত সহজ মানুষ, সরল হৃদয় এদের। সামান্যেই তুষ্ট, ঠিক যেন শিবের শহরে সবাই আশুতোষ।’
(ক্রমশ)
