সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

কালিম্পং: আরো বাড়ি, আরো মানুষ

লিংউড-এর গল্পে ফিরবো। তার আগে আরো আরো বাড়ির ও শহরনিসর্গের কথা বলি। কালের মায়া এবং পুঁজি বাড়ানো(ও বানানো)র মহাখেলায় গোটা হিমালয়ের নিচের দিকটার যা হাল হয়েছে, কালিম্পং বাদ যাবে কেন, সেখানেও ঘিজিঘিজি করে দেদার মোটা লম্বা বাক্সগোছের বাড়ি উঠছে, তাদের কোনোটায় ক্যাটকেটে হলুদ রঙের হোটেল, কোনোটায় গোলাপি লাল ইস্কুল, কোনোটায় বেগুনি রঙের বাজার। এসব কথা আগে এ আখ্যানে এসেছে, আরো আসবে, কি করা, যতবার পাহাড়ে আসি আর দেখি, বড়রাস্তার দুধারে গায়ে গায়ে লাগানো নতুন নতুন বাড়ি, পাহাড় গাছপালা আকাশ ইত্যাদি দেখা যায় না বললেই হয়, যেদিকে তাকাও উঁচু উঁচু ইমারত, পথের ওপর ফেলে রাখা বালি পাথরের স্তূপ, সরু সরু প্যাচাঁনো রড, ইঁট সিমেন্ট। এরকম হয়, হবার কথা, যত বাড়ি তত পয়সা, যত পয়সা তত ফুর্তি ও বিকাশ, জানি। এ ভিন্ন, সায়েবদখলের আগের পাহাড় পরের পাহাড় এক নয়, কালিম্পং-এর কথাই যদি বলি, সায়েদপূর্ব পাহাড়বন, লেপচা-ভুটিয়াদের জুমক্ষেত এবং এখানে ওখানে একটা দুটো গ্রাম, এগুলো নিয়েটিয়ে সবটা বদলে ফেলা হয়েছিলো ছকে ফেলে, খাজনা অর্থাৎ পয়সা বাড়ানোর ছক, যেমন দার্জিলিং-এ, বা হিমালয় পাহাড়ের অন্যত্র। সায়েবদের করা নিসর্গবদল ও পয়সা বানানোটা মেনে নি যদি, হালের দিশি ‘উন্নয়ন’টিকে মেনে নেবো না কেন, পাহাড় জুড়ে রঙদার নবনির্মাণের ধূম দেখলেই রাগ হবে কেন?

রাগ, মন খারাপ এসব যে হয় তার কারণ আছে। সায়েবরা নিসর্গ তৈরি করতো ভালোবেসে ও ভাবনাচিন্তা করে, বাড়ি বানাও, সেজন্য পাহাড় কাটো, জঙ্গল সাফ করো, কিন্তু যা করবে তা যেন দেখতে ভালো হয়, এবং যে বাড়িতে তুমি থাকছো বা কাজ করছো সেখান থেকে যেন খোলা আকাশ, পাহাড়ের ঢেউ, নদীঝর্ণা জাতীয় সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্যমান হয়, যেমনটি সায়েবদের স্বদেশে। আমাদের পাহাড়ে হোক বা উপমহাদেশের অন্যত্র উঁচু ঠান্ডা জায়গায়, সায়েবরা যতদিন ছিলো, সেই দেশ খুঁজে গেছে। ফলে সেখানে ঘরবাড়ি শহরটহর যা বানানো হয়েছে, সেগুলো দিব্যি দেখতে, তা সে লন ও বাগানওলা কাঠপাথরের হাফ-টিম্বার্ড একতলা দোতলা বাংলো হোক, কিম্বা পুরো পাথরের, মক-টিউডর, ভিক্টোরিয় আধা-গথিক ইত্যাদি। সায়েবদের পিছনপিছন দিশি জমিদার, বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা পাহাড়ে এসে যখন বাড়ি বানাতে শুরু করলো, তাদের স্থাপত্যভাবনা ও নিসর্গনির্মাণ প্রায় পুরোপুরি সায়েব-অনুসারি, সামনেপিছনে ছেড়ে রাখা জমিতে বাগান, লন, একটু দূরে ছোট নিচু কুটরিতে চাকরচাকরানির বাসস্থান, বাড়ির ঘর থেকে দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা, নিদেনপক্ষে তিস্তা, নাহলে নীলকালো পাহাড়ের সারি, ঘরের ভিতরে অ্যান্টিক কাঠের আসবাব, ফায়ারপ্লেস, বাইরে ঢালু ছাদের ওপর চিমনি। কালিম্পং শহরের যে চেহারাতে চোখ ও মন অভ্যস্ত, সেখানে এই ধরণের বাড়িগুলোকে থাকতেই হয়, নচেৎ সাহেবি শৈলশহর অর্থাৎ হিল স্টেশনের নিসর্গ তৈরিই হয় না। বড় ও বেশি নামী শহরগুলো অনেক আগে থেকেই বদলাতে শুরু করেছিলো, যেমন আমাদের দার্জিলিং, উত্তর ভারতের সিমলা, মুসৌরি, নৈনিতাল। গত শতাব্দীর শেষ অবধিও কালিম্পং সেভাবে বদলায় নি, যখনই গেছি বা থেকেছি, নতুন বাড়ি চোখে পড়েছে কালেভদ্রে। পুরোনো বাড়িগুলো আলাদা করে চোখে পড়েনি, পাহাড়ে তো এরকমই হয়, হবার কথা। যখন থেকে বাড়িগুলোকে, তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পগুলোকে আলাদা করে খুঁজতে ও বুঝতে শুরু করেছি, বাড়িগুলো হয় ভাঙা পড়েছে, নয় বড় বড় নতুন বাড়ির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে।

অতএব, যুগপৎ ঐতিহাসিক ও নান্দনিক পরিপ্রেক্ষিত বর্তমান, কালিম্পং শহরের নিসর্গ বদলের ঘটনায় আমাহেন পুরোনো ও লোলচর্ম লোকজনের রাগদুঃখ হতেই পারে। হয়তো দুঃখ ভুলতেই ইতিহাস ও গল্পের বিভিন্ন পরত সরিয়ে দেখতে হচ্ছে, নান্দনিক সাহেবি নির্মাণের পিছনে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবিস্তারের যে বড় ও ভুলে যাওয়া গল্পটল্প আছে, সেগুলোও খুঁজে, খুঁড়ে, বার করতে হচ্ছে, নিজেকে বারবার বলতে হচ্ছে, সায়েবরা এত লুটপাট অত্যাচার করেছে প্রায় দুশো বছর, তাদের তৈরি ইতিহাস, নিসর্গ, সেই নিসর্গের অংশ বাড়িঘরদোর থাকলেই কি গেলেই কি, গেলেই বরং ভালো, নতুন কিছু তৈরি হবে, ফিরে আসবে, জুমিয়াসময়ে পুরোনো পুড়ে যাওয়া বনের জমিতে যেমন ফিরে আসতো নতুন গাছপালা। নিজেকে যাই বোঝাই, অথবা চোখকান কার্যত বন্ধ করে রাখি, মোদ্দা অবস্থাটা বদলায় না, পাহাড় কাটা পড়তে থাকে, জঙ্গল গাছপালা নষ্ট হয়, পুরোনো বাড়িঘর পথঘাট সব বেমালুম উধাও হয়ে যায়, সেইসঙ্গে ইতিহাস, গল্প, যা যেখানে ছিলো।

কখনো কখনো অন্যরকমও হয়। আমাদের দেশে যেমন, যেটাকে আগে তৃতীয় বিশ্ব বলা হতো, ইদানিং দক্ষিণ গোলার্ধ বা গ্লোবাল সাউথ বলা হয়, অর্থাৎ কিনা পৃথিবীর যে বিশাল অংশে বিভিন্ন রকমের সাহেবরা এসে উপনিবেশ তৈরি করেছিলো, সেখানকার নেতামন্ত্রী ও বড়লোকরা নিয়মমাফিক প্রকৃতি ও ইতিহাস ইত্যাদিকে নিরন্তর দুচ্ছাই(উন্নয়নই সব)করে থাকেন—এক যদি না সেখানে দেবতার জন্ম হয়(শিবরাম চক্রবর্তীর বিখ্যাত গল্প মনে করুন, যেখানে রাস্তার মামুলি পাথর রাতারাতি দেবতা হয়ে যায়), অথবা নিজেদের সুবিধামাফিক ধর্মটর্ম বসিয়ে প্রকৃতি ইতিহাস মানুষ জায়গা যথা যাবতীয় বিষয়আশয়কে পবিত্র করে ফেলা যায়। অন্য, দূর দেশের কথা থাক। আমাদের পাহাড়ে গত বছর কয় ধরে বিপুলাকৃতি ও যারপরনাই রঙিন হনুমানঠাকুরেরা যত্রতত্র স্থাপিত হচ্ছেন, পাহাড়ের মাথায়, চা বাগিচার মধ্যে, ঘাসের ঢালে। লোক সেসব দেখছে গদগদ ভক্তিভরে পেন্নাম করছে, এবং মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে এন্তার সেলফি তুলছে। এই বাজারে পুরোনো বাড়ি নিসর্গ এসব বাঁচাতে গেলে আপনাকে কিছু একটা তুক লাগতেই হবে, যাকে গোদা বাংলায় বলে ভ্যালু অ্যাডিশন। যেমন, হেরিটেজ। সে বস্তুটি কি এবং কেন কেউ জানে না, অথচ সবাই মিলে তারস্বরে বলা হচ্ছে হেরিটেজ হেরিটেজ হেরিটেজ। হেরিটেজ মানে যা ইচ্ছে হতে পারে, ভূত(ভূতখ্যাত মরগান হাউস) প্রেত কন্ধকাটা(কার্সিয়াংয়ের ডাওহিল), কিম্বা সিল্ক রুট, চিমনি,  নিদেন একটা কাঠের বাড়িটাড়ি।

ছ্যাবলামি হয়ে যাচ্ছে। গল্পে ফিরি। বেশ কিছুকাল ধরে, আমাদের পাহাড়ের সায়েববাড়ি (বা হেরিটেজবাড়ি) খুঁজে বেড়াচ্ছি, বিশেষত কালিম্পংয়ের। বাজার থেকে রিংকিংপং পথ ধরে দূরবীন পাহাড়ে ওঠার শেষ চড়াইয়ের মুখটায় ডানদিকে বাঁদিকে বেশ কিছু ওইরকম বাড়ি আছে, তন্মধ্যে বাঁদিকের মর্গান হাউজ এবং তৎসংলগ্ন তাসিডিং বহুবছর যাবত সরকারি পর্যটন আবাস, সেখানে ওঠা হয়েছে থাকা হয়েছে অনেকবার। বাঁদিকের বাড়িগুলো সেনাছাউনির মধ্যে, ঢোকা যায় না। সব বাড়িই সুদৃশ্য মনোরম, এবং গল্পময়। সে গল্পের সবটা পড়ে ওঠা যায় না, তথাপি মরগান হাউজ নিয়ে আলাদা করে বলতেই হবে।

আপাতত অন্য কিছু বাড়ির গল্প বলি। অধিকাংশই রিংকিংপং এবং আপার কার্ট পথের চৌহদ্দিতে, যেমন, না থাকা মঞ্জুলা। এই এলাকায় পাহাড়বন কেটে বাড়ি উঠছে গত তিরিশের দশকে, সেকারণে সম্ভবত এলাকার নাম ছিলো ডেভলপমেন্ট এরিয়া, বা উন্নয়ন এলাকা। বাজার এবং বাজার থেকে বেরুনো পেডং পথ বা তিস্তা অবধি যাবার পথ, সে এলাকাটি তুলনায় পুরোনো, সেখানেও কিছু সাহেবি আধাসায়েবি বাড়ি অদ্যাবধি আছে, যথা ধর্মোদয় বিহার। বিহার থেকে আরো কিছুটা তিস্তার দিকে এগিয়ে, আর্কেডিয়া নামের একটি বাংলোবাড়ির সন্ধান পাওয়া গেলো। সে বাড়ির বর্তমান মালিক খুব গপ্পে মানুষ, কালিম্পংয়েরই বাসিন্দা, শহরের পুরোনো বাড়িঘর ও মানুষজন সম্পর্কে বিস্তর গল্প তাঁর জানা। সে সব গল্পে যাবার আগে, আর্কেডিয়া বাড়ির কথা জানলাম কি করে বলি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply