সার্কাসের ইতিকথা : প্রান্তজনের করতালি। পর্ব ১। বরুণদেব
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিবর্তনের নানান ধারা উপধারায় জাতপাতহীন, কাঁটাতারহীন, মিলাবে মিলিবে ক্রীড়াসংস্কৃতির এক একান্নবর্তী যাপনের সংস্কৃতির নাম সার্কাস। হিন্দু বিণা দাশের হাত ধরে ট্রাপিজের খেলা দেখায় মুসলিম জাহেদা। খ্রিস্টান হ্যারির বাইকের খেলার জন্য জাল টাঙয় কায়স্থ রবি। বর্ধমানের সইফুলের সাথে তাঁবুর সংসার নেপালের জুমার। গ্রেট স্প্যানিশ সার্কাস ফ্রান্সে এসে হয়ে যায় গ্রেট ফ্রান্স সার্কাস। সার্কাস এক ভিসুয়াল পারফরমেন্স অ্যাক্ট। যুগে যুগে, গ্রামে নগরে, অভিজাত সমাজের তেলচুকচুকে মেদ থেকে মাঠেঘাটে কলেকারখানায় খেটে খাওয়া মানুষের ঘর্মাক্ত অবয়ব, বিনোদনের সার্কাসী ধারায় আমোদিত হয়েছে- মেরা নাম জোকারে, সামারসল্ট ভল্টে, ট্রাপিজের খেলায়, জিমম্যাস্টিকক্সের জাদুতে। বন্যপ্রাণী নিষিদ্ধপূর্ব যুগ পর্যন্ত, বাঘের গর্জনে, হাতির অভিবাদনে রোমাঞ্চিত হয়েছে সার্কাসের তাঁবু ফেলা জনপদ। সে তাঁবু জাত ও বেজাত, ধর্ম ও জিরাফ, রাষ্ট্রের সীমারেখা ও কাঁটাতার মুছে দিয়ে এক সর্বজনীন বিনোদনের আসর বসায় যখন, তখন তা নিছক বিনোদন হয়ে থাকে না, এক বৈশ্বিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সার্কাস এক শিল্প। রাষ্ট্রের গর্বিত জয়স্তম্ভ। জাতির অহংকার।
মহাবিস্ফোরণের পর ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে হতে, শীতল হতে হতে, সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটের কণাদের সংঘর্ষ, বলিদান ও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে, মহাবিশ্বের কোটি কোটি বছরের সাধনায় পার্থিব তুষার যুগ। প্রাণের সঞ্চার। বিবর্তনের ধারাপাত। এককোশি থেকে বহুকোশি থেকে হোমোসেপিয়ান। পশু আর মানুষের জমি দখলের লড়াই । আগুনের আবিষ্কার আর নিয়ন্ত্রণ। পাথরের হাতিয়ার আর ধাতব ঝনাৎকার। সময়ের জোয়ার ভাটায় ঢেউ আর ঢেউ ঠেলতে ঠেলতে মানব সভ্যতা ঘাটে ঘাটে নোঙর করে। সভ্যতার বৈশ্বিক বিবর্তনের ধারাপাতে দুর্গমকে সুগম করা, অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষার মাঝে মানুষের আপন শরীরকে নিয়ে নানান কসরত। সেখানেই ব্যক্তির আনন্দ, গোষ্ঠীর মনোরঞ্জন। সেখানেই অবকাশ যাপন। গোলাকার, দণ্ডাকার নানান জ্যামিতিক প্যাটার্নের বস্তু নিয়ে শারীরিক কসরত দেখাতে দেখাতে বেড়িয়ে পড়েছে মানুষ দেশে দেশে, মহাদেশে মহাদেশে। মিশে গিয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে। মেলাবে মিলিবে-র হাত ধরাধরির আকুতি থেকে হৃদয়ের বন্ধনে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক নানা উপাদান, সংস্কৃতি, আচার- বিচার। অঙ্গীভূত হয়েছে। ক্রীড়া তার বাহক। মানুষের যাপনের রোজনামচায়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনে, উৎসবের উদযাপনে, বিনোদনের এক ধারাপ্রবাহের নাম ক্রীড়া। এ বিশ্বের বিবর্তনের গতিধারায়, বিনোদনের সালতামামিতে, আদি ও অকৃত্রিম ক্রীড়াশৈলী, আবহমানের সতত সঞ্চরণশীল প্রবাহ।
সেই ক্রীড়াসংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন উপাদন এক তাঁবুর নিচে একত্রীভূত হয়ে, যুগের ধারাপাতে, বিবর্তনের রথে, জন্ম দিয়েছে আধুনিক সার্কাস-সংস্কৃতি। সেখানে কোনো দেশ বিদেশের দৃশ্য ও অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা নেই, জাত-বেজাতের চাবুক নেই। ধর্ম ভাষা বর্ণের বিভেদকামী দড়িকে নিজের কব্জায় নিয়ে, দড়ির ওপর হেঁটেছে শিল্পী, কসরত দেখিয়েছে, পশুপাখিকে নিয়ে খেলা দেখিয়েছে। করতালিতে ফেটে পড়েছে সার্কাসের তাঁবু। বিস্ময়ে, সৃষ্টি সুখের আনন্দে করতালি দিয়েছে সময়। উল্লসিত হয়েছে সভ্যতা। হর্ষিত হয়েছে বিশ্বসৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটের কণাদের স্রোত – নিউট্রিনো, ফোটোন, পজিট্রন, ইলেকট্রন।
সূচনা লগ্ন থেকে সার্কাসের খেলাধুলায় এসেছে হাতি, ঘোড়া, পাখি, হরিণ, কুকুর, নানা গৃহপালিত পশু ও পাখি। এসেছে বাঘ, সিংহর মতো হিংস্র পশুও। প্রথম দিকে প্রদর্শনী, পরের দিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নিয়ে খেলা দেখানো। উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় আইজাক এ ভন আম্বুর্গ ( van amburgh) কতগুলি বন্যবিড়ালকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সার্কাসে পশুর খেলা দেখানো শুরু করেন। আমেরিকার মাবেল স্টার্ক বাঘের মহিলা প্রশিক্ষকরূপে খ্যাতি পান। মানুষ আর পশুর টিকে থাকা ও আধিপত্যের লড়াই ধীরে ধীরে পারস্পরিক সহাবস্থানের মনোরঞ্জনে গিয়েছে বদলে।
যে বন্যপশুর সঙ্গে লড়াই করে মানব সভ্যতার টিকে থাকা, এগিয়ে যাওয়া, আগামীর পথ খোঁজা, সেই পশুকে বন্দী করে, তাকে পোষ মানিয়ে, স্নেহ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, প্রহারে শাসনে প্রশিক্ষণে ,তাকে নিয়ে প্রদর্শণী, কসরত – সে যেমন বিনোদনের এক অঙ্গ, তেমনি শাসকের প্রণীত আইনের ধারায়, ক্ষমতার বিরুদ্ধাচারণে বা সামাজিক ও নৈতিক পদস্খলনে ফাঁসি বা গিলোটিন বা পাথর ছুঁড়ে মারা অথবা মানুষ ও পশুর, শক্তিধর ও সাধারণের অসম যুদ্ধের শাস্তিদানের প্রকাশ্য মেলা – এই হিংস্রতার মাঝেও প্রাচীন সভ্যতা খুঁজে পেয়েছে তার জান্তব উল্লাসী বিনোদন। স্পোর্টস, পানিশমেন্ট , এন্টারটেনমেন্ট – এই তিনের মিশেলে রোমানযুগের যে ক্রীড়াসংস্কৃতি, তা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে বদলে । দূর-সুদূরের সে সভ্যতায়, ভূখণ্ডে ভুখণ্ডে, প্রকাশ্য মৃতুদণ্ডের উৎসবে টিকিট কেটে সাধারণ মানুষের আসনের পাশাপাশি রাজকীয় বা অভিজাতদের সংরক্ষিত আসন। জান্তব উৎসবের উল্লাসী উপভোগ একদিন সভ্যতার শুভ শক্তির উন্মেষে, চেতনা ও বোধের জাগরণে, যায় মুছে। সেইসব রক্তের হোলি খেলা বিনোদনের ওপর নিষিদ্ধকরণের আইন প্রণয়ন করে গোষ্ঠী ও সমাজ, শাসক ও রাষ্ট্র। তারপর একদিন বন্য পশুকেও সার্কাসের খাঁচা থেকে মুক্ত করে ফিরিয়ে দেয় তার নন্দনকাননে। মানবসভ্যতার জয়গানে মহাকাল বাজায় মাদল।
সার্কাসের এরিনা ম্যাজিক শো ও অপেরা হাউসের মঞ্চকে আলিঙ্গন করে নিয়ে আসে নাট্যমঞ্চ ও ম্যাজিক শোয়ের নানান উপাদান। সেই সুর তাল ছন্দ নিয়ে আম্ফিথিয়েটারে, ক্যানভাসের তাঁবুর নিচে, ভ্রাম্যমাণ শিল্পী দেখিয়ে চলে নানান শারীরিক কসরত, চর্চা চলে দেশে দেশে, নানান নাম তার –অ্যাক্রোব্যাটিক্স, ট্রিক রাইডিং, রোপ ড্যান্সিং, জাগলিং। মুখে রংচং মেখে নানান অঙ্গভঙ্গিমায় হাসির ফোয়ারা ছোটায় সার্কাসের জোকার।
নানা প্রচলিত খেলা – জাগলিং, অ্যাক্রোব্যাটিক্স, ক্লাউন অ্যাক্টকে সার্কাসের এরিনায় নিয়ে আসেন আধুনিক সার্কাসের জনক ফিলিপ অ্যাস্টলে। সেগুলি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় ও আবশ্যিক সার্কাসী আইটেম হয়ে ওঠে । সময় যত গড়িয়েছে, নানা অভিনব খেলা ঢুকে পড়েছে এরিনায়। ডেয়ারডেভিল স্টান্টের খেলা। আগুন খাওয়া। ছোরার খেলা। ম্যাজিক শো। কাঠ পাথরের হিপোড্রোমের সার্কাসগৃহের অবসানে ভ্রাম্যমান ক্যানভাসের তাঁবু চালু হয়েছে যুগের চলনে। ব্যান্ডের সংগীত এসেছে। নাটক, অর্কেষ্ট্রা, মাইম – ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চের অদৃশ্য বিভেদরেখাটা সার্কাসের এরিনায় গিয়েছে মুছে। চলেছে পরীক্ষা নীরিক্ষা । সৃজনশীল হয়েছে । আঙ্গিক বদলেছে বারেবারে। যাপন আর লড়াইয়ের শৈলী হয়ে উঠেছে মনোরঞ্জনের উপাদান। নেদারল্যাণ্ডে লম্বা লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে খাল বা ছোট নদী পার হওয়া বা যুদ্ধের দুর্গে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া –এই কসরত থেকে জন্ম নিয়েছে পোল ভল্ট। বাঁশের লাঠির জায়গায় এসেছে নমনীয় ধাতব বা কার্বন ফাইবারের লাঠি। তারই আর এক সংস্করণ রণপা। সার্কাসের এরিনায় পেয়েছে স্থান।
রাজন্যবর্গের অভিজাত অঙ্গন পেরিয়ে নাগরিকের প্রান্তরে এসে, সর্বজনীন হয়ে, দখলদারী নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে, সর্বসাধারণের মনোরঞ্জন হয়ে উঠেছে সার্কাসী ক্রীড়াসংস্কৃতি। বৈশ্বিক ক্যানভাসে, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তরে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-সংস্কৃতির রামধনুতে, সার্কাস বিনোদিনী সৃজনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে একদিকে, আর একদিকে দেশে দেশে কূটনৈতিক বার্তা বিনিময়, সংস্কৃতির মিলনের এক সক্রিয় বাহক হয়ে উঠেছে। সে বিনোদনের দিকপ্রকৃতি ও গতিপথের নিয়ামক সাধারণ দর্শক। আমজনতা। দেশে দেশে যুদ্ধ ও বিপ্লব এনেছে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, তা ছুঁয়ে গিয়েছে সার্কাসের এরিনাও। ঔপনিবেশিক ভারতে প্রফেসর বোসের কলকাত্তাই সার্কাসে গীত হয়েছে- বন্দেমাতরম।
সভ্যতার বিবর্তন ও বিবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনও বদলে ফেলে তার চলার পথ। রাষ্ট্র যতদিন সে বিনোদনের পিঠে হাত রেখেছে, তার রথ ছুটেছে দূরন্ত গতিতে। প্রাচীন রোমের সার্কাস ম্যাক্সিমাস থেকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সার্কাস – সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে দেশে-দেশে, কালে-কালে।
একদিন সার্কাস সংস্কৃতির আবেদন আবিশ্ব মানুষের কাছে তার বিনোদিনী ভাষা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে, পৌঁছে গিয়েছে শ্রেণীদ্বন্দ্বে জাতিদ্বন্দ্বে বর্ণদ্বন্দ্বে জর্জরিত সকল দ্বান্দ্বিক সমষ্টির কাছে। আত্মিক মেলবন্ধন ঘটেছে দেশে-দেশে, নগরে-প্রান্তরে। সার্কাসের কর্মকাণ্ডের জাদুতে উদ্বেল হয়েছে আবিশ্ব মানুষ। সার্কাসীয় মেজাজে রিংমাস্টাররা বলে উঠেছে- দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, দ্য শো মাস্ট গো অন। বিনোদন জন্ম দিয়েছে পেশার। পাকস্থলীর প্রয়োজন মেটাতে শ্রমজীবি মানুষ ভিড় করেছে তাঁবুতে। দেখিয়েছে স্থির মনন আর শারীরিক ক্ষমতার শৈলী। সৃষ্টি করেছে ইতিহাস।
হারিয়েও গিয়েছে কালের স্রোতে। প্রযুক্তি, কৃষ্টি, সমাজ ও সংস্কৃতির বোধ ও চেতনার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সার্কাসের বিশ্বজয়ের রথ চলেছে যেমন, তেমনি একদিন কালের নিয়মে টিকে থাকার হাপরে ধরেছে টান। সভ্যতার অগ্রগতির ধারারেখ ও অশান্ত প্রবাহে কণায় তরঙ্গে দূরদর্শনের যুগ এসেছে। সার্কাসের তাঁবু ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করেছে তার জৌলুস । সাদা-কালো টিভি রঙিন হয়েছে, মুঠোফোন অ্যান্ড্রোয়েড হয়েছে, আর এক সময়ের আবিশ্ব মনোরঞ্জনের সার্কাসের তাঁবু শরীরে তাপ্পি লাগাতে লাগাতে, বিবর্ণ হতে হতে, বয়ে বেড়াচ্ছে তার স্মৃতিরেণু। রাত্রির শেষ শো শেষ হলে, গভীর রাতে বাতাস এসে তাঁবুর গায়ে ঠেস দিয়ে বাজিয়ে যায় বেহালার করুণ সুর। একটানা। সার্কাস, তোমার দিন গিয়াছে।
(ক্রমশ)
