অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩২। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

দশ : গ্রাফিতি : দেশীয় সংস্করণ

সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের স্ট্রীট আর্ট এবং আধুনিক অর্থে গ্রাফিতিকে সদ্য হাঁটতে শেখা মানবক বলা যায়। মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতের দেয়াল চিত্রকলা তো বটেই, এমন-কী বাংলাদেশের গ্রাফিতি-সমৃদ্ধির নিরিখেও।

সুমনও একটা সময় ভেবেছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে উপস্থিত দেয়াল-অলংকরণকে গ্রাফিতির উদাহরণ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সেই অর্থে মহারাষ্ট্রের উত্তর সহ্যাদ্রি পর্বতমালার উপজাতিদের দ্বারা লালিত ওয়ারলি লোকশিল্পকলা বলে পরিচিত দেয়াল অলংকরণের অসামান্য উদাহরণ বা আমাদের রাজ্যের জনজাতিদের গৃহপ্রাকার অলংকরণকেও গ্রাফিতির পূর্বাধিকার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু পরে দেখলেন আমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনের গ্রাফিক চিত্রণী বিভাগের অধ্যাপক তরুণদীপ গিরধর সাইনবোর্ড শিল্পীদের মধ্যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিদ্যমানতার বিষয়ে যা বলেছিলেন তার মধ্যে সত্য থাকলেও বিশেষ অভিনবত্ব নেই। কেননা সত্যিকার সমস্ত ধরনের শিল্পেই নিজস্ব সাংস্কৃতিক শিকড়টি প্রোথিত না-থাকলে কৌমজীবনের পরিচয়বাহী শিল্পকলা তো বটেই নবসৃষ্ট শিল্প-অভিব্যক্তিও তার জীবনরস থেকে বঞ্চিত থাকে।

তাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী দেয়ালচিত্রকে অলংকরণশৈলী, এবং কৌমজীবনের বেঁচে থাকার যাবতীয় অভিব্যক্তির (আনন্দ, সৌন্দর্যবোধ, জীবনোপকরণের ব্যবহার, দুঃখ-বেদনা, রাগ-ক্ষোভ―ইত্যাদি সবকিছু) হওয়া সত্ত্বেও  প্রকৃতপক্ষে আধুনিক অর্থে গ্রাফিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। সব দেয়ালচিত্র আদৌ গ্রাফিতি নয়। সেই নিরিখে কিন্তু রাস্তার শিল্প হিসেব শান্তিনিকেতনের কলাভবনের, কালোবাড়ির দেয়াল কিংবা ফ্রেসকো চিত্রকলার একটি শ্রেণী হলেও, তা গ্রাফিতি নয়। গ্রাফিতির উদ্দেশ্য-বিধেয় একেবারেই ভিন্নমাত্রিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ডিসকোর্সের টেক্সটসহ চিত্রায়ন। এই গঞ্জে ডেরা বাঁধার পরে দেয়াল ও বাসস্থান অলংকরণ নিয়ে বিস্তর অভিজ্ঞতা সুমনের হয়েছে। তাকে তিনি নিজের ছবিতে তো বটেই সাইনবোর্ড লেখায়ও কাজে লাগিয়েছেন।

কিন্তু ওয়ারলির স্থানীয় জনজাতিদের গৃহ অলংকরণ ও তার মধ্যে বিবিধ মোটিফের অসামান্য ব্যবহারের ছবি  সুমনকে তাক লাগিয়ে দেয়।

 

সুমন লক্ষ্য করেন বিভিন্ন শিক্ষা ও অন্য প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ছবি আঁকা হলেও সেগুলি হয় সরকারি বিজ্ঞাপনের নামান্তর (ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, ডায়রিয়া প্রতিরোধ, কন্যাসন্তানের সপক্ষে সওয়াল, সুনাগরিক হওয়ার জ্ঞানগর্ভ উপায়, কিংবা মনীষীদের পোর্ট্রেটের সঙ্গে বাণী ইত্যাদি) অথবা ছোটোদের মনোরঞ্জনের মতো নানাবিধ অলংকরণ, এর সঙ্গে লোকচিত্রকলার অনুসরণের প্রচেষ্টাও আছে। বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের সময় আমাদের পাড়া-ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রিয় দল ও খেলোয়াড়ের ছবি, বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা ও জার্সির পতাকা দেয়ালজোড়া প্রদর্শনী! বিশ্ব-গ্রাফিতি যদি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে তাহলে এই বঙ্গের (ভোটের ছড়া বা কার্টুনের উপস্থিতি সত্ত্বেও)  আমাদের দেয়াললিপিকে গ্রাফিতি বলা কঠিন।

আমাদের গ্রাফিতির (যদিও তার সবটাকে গ্রাফিতি বলা শক্ত) বেশ কয়েকটি রকমফের আছে। ছোটোবেলায় গঞ্জ ছেড়ে যাবার পর বর্ধমান, কলকাতা বা আধা কলকাতার জনপদে একটু-আধটু জ্ঞানগম্যি হবার পর থেকেই এই রকমফের সুমন লক্ষ্য করে এসেছেন। তার মধ্যে কেজো-অকেজো, গম্ভীর-ফিচেল, রাজনৈতিক-মজাকি, ধর্মমিশেলের চেষ্টা এবং কুৎসার অপচেষ্টা, কৌশলী-গোঁয়ার, বুদ্ধিপ্রবণ-ঘাউড়া, স্বপ্নিল-গাজোয়ারি নানা প্রকারের লিখনের দাপুটে অথবা না-বোঝা তারুণ্যের চিকা মারার উদাহরণ আছে।

উনিশ শো সত্তরের দশকে এই বঙ্গের নগর-শহর-টাউন-সিটিগুলি কী ধরনের দেয়াললিপিতে উত্তপ্ত ছিল তা আজকে বহুতর চর্চার বিষয় হতে পারে। পৌনপুনিকতা এগুলির গ্রাফিতিমূল্যকে বহুলাংশে বিনষ্ট করলেও স্টেনসিল, মোটা ব্রাশ, কাপড়-জড়ানো তুলি, খবরের কাগজের পোস্টার, সস্তা আলতার লেখা, ডাল-ছেঁচা ব্রাশ আর আলকাতরা বা ভুষো-কালোর ব্যবহারে সেসব লেখা কিছুটা বৈচিত্র্যহীন হলেও সংখ্যাপ্রাচুর্যে বেশ প্রচারিত হতে পেরেছিল। সরাসরি রাজনৈতিক শ্লোগানের ব্যবহার, রোমান্টিক স্পর্ধা এবং উচ্চকিত ঘোষণায় এই সমস্ত দেয়াললিপি আকীর্ণ ছিল। মূলত উপস্থাপনার পরিস্থিতিগত প্রবেগের কারণে এইসব লিপি দ্রষ্টার মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল বলে মনে হয়। লেনিন, হো চি মিন, মাও-সে-তুং প্রমুখের প্রোফাইল-পোর্ট্রেটের স্টেনসিল তখন সকলেরই পরিচিত ছিল। সচেতনভাবে সেগুলি দেয়াললিপিই ছিল। দ্রুততার স্বার্থে, গোপনীয়তার কারণে, নিষিদ্ধতার ধারণায় সঙ্গের শ্লোগানগুলিও ছিল স্টেনসিল করা। দেয়াললেখাগুলির শরীরে এক-ধরনের তাড়াহুড়ো এবং গোপনীয়তার ছাপ ছিল।

১৯৭০-৮০-র দশকের বঙ্গ বিবদমান প্রতীপ-বিপ্রতীপ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ঘটনাবলীতে সমাকীর্ণ হলেও েসই অস্থির সময়ে ধর্মকারবারিরাও সক্রিয় ছিল। কিছুটা হ-য-ব-র-ল চরিত্র ছিল দেয়ালের। প্রায়শই স্টেনসিলের সহায়তায় নানা অদ্ভুত লিপিবার্তা ফুটে উঠত দেয়ালের অঙ্গে। এই সব ধর্ম ও রহস্যপৃক্ত লিপির মধ্যে ছিল ‘গুরু কৃপা হি কেবলম্’ কিংবা ‘উড় যা / মাটিতে পা’-এর মতো শ্লোগান! ১৯৯০-এর দশকে দেখা দেয় ‘ভোলে ব্যোম তারক ব্যোম’, ‘ভোলেবাবা পার করেগা’-র আবেদন। কোনো কোনো বিশেষ মত বা গুরু-অবলম্বী সম্প্রদায়ও তাঁদের লব্জমন্ত্র দেয়ালে দেয়ালে স্টেনসিল সহযোগে লিখে দিত। ‘হরেকৃষ্ণ’-র মতো প্রচার এসেছে আরও পরে। এইসব দেয়াললিপির সবটাকে গ্রাফিতি বললে নিশ্চয়ই বেশি বলা হবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply