অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩১। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

নয় : একটি কবিতার জনপ্রিয়তা এবং দেয়ালে চিকা মারা-র ইতিবৃত্ত

একটি কবিতার জনগ্রাহ্য হয়ে ওঠার ইতিবৃত্তকে অনুসরণ করলেই গ্রাফিতি নামক এই রাস্তার শিল্পের অমেয় শক্তি বোঝা যায়। দেয়াল থেকে দেয়ালে একটি কবিতাটির ‘হয়ে ওঠার’ সেই ইতিবৃত্ত রোমহর্ষকও বটে।

কবি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮-২০২৪)-এর সেই কবিতাটির প্রাথমিক চরণদুটি দেয়াললিপির সৌজন্যে অনেকের কাছেই―যিনি কবিতা পড়েন না আদৌ, যিনি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতাকে বাংলা বর্ণে লেখা দুর্বোধ্য কোনো ভিন্ন ভাষার অ-বাক্য বলে মনে করেন, তেমন মানুষের কাছেও পরিচিতি পায়। হাসান হাফিজকে দেওয়া হেলাল হাফিজের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়―ছাত্রাবস্থায় কবি হেলাল হাফিজ এক বিকেলে পুরান ঢাকা থেকে রিক্সা করে ফিরছিলেন তাঁর হস্টেল ইকবাল হলে। সেটা ১৯৬৯ সাল, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার গুলিস্তানের ফুলবেড়িয়ায় পৌঁছে হাফিজ দেখলেন সেখানে সমানে মিছিল ও বিক্ষোভ চলছে, ছাত্রজনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। পুলিশ-মিলিটারির লাঠিচার্জের প্রতিবাদে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ঢিল-পাটকেল ছোড়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বয়স্ক এক রিক্সাচালক বললেন―‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ কথাটা তরুণ হাফিজকে বিমোহিত করেছিল। ঐ কথা থেকেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামে কবিতাটি লেখা হলো―‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।…’ ( যে জলে আগুন জ্বলে) কিন্তু কবিতাটি ছাপা হতে পারল না।

কবিতাটি পড়ে ভালো লাগায় কবি আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) এবং কবি হুমায়ুন কবির (১৯৪৮-১৯৭২) কবিতাটি প্রকাশের জন্য নিয়ে যান ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার তদানীন্তন সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিবের কাছে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সরকারি কাগজ হওয়ায় সেই পরিস্থিতিতে তিনি কবিতাটি ছাপার ব্যাপারে অক্ষমতা জানান। কেননা এই কবিতায় সশস্ত্র সংগ্রামকে সমর্থনের ইঙ্গিত আছে।

কবিতাটি যখন ছাপা গেলই না তখন আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবীর এক রাতে কবিতার প্রথম দুটি চরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে ‘চিকা মেরে’ দিলেন। মাত্র দু-রাতেই গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত দেয়াল এই রহস্যময় অথচ উদ্দীপক কাব্য-চরণে একেবার শ্লোগানের মতো ছেয়ে গেল।

যতীশ-শিবেনদের রাতবিরেতে ‘দিয়াল ফাঁকানো’র থেকেও সাংঘাতিক এই ‘চিকা মারা’ ব্যাপারটা!

চিকা মারা মানে দেওয়াল লিখন হলেও কথ্য ইঙ্গিতে এর এক গোপন অর্থ আছে, আর তা হলো রাতের অন্ধকারে সকলের চোখ এড়িয়ে নিষিদ্ধ দেয়াল লিখন। ‘চিকা’ অর্থে ইঁদুর বা ছুঁচো-জাতীয় প্রাণী। গভীর রাতের ভীতিকর পরিবেশে দেয়াল লিখনরত তরুণরা রাষ্ট্রীয় আইনরক্ষক বা পুলিশের নজরে পড়ে গেলে বলতেন যে, বাড়িতে চিকার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা চিকা মারা জন্য লাঠি নিয়ে বাইরে এসেছেন! ‘চিকা মারা’ বলতে নিষিদ্ধ দেয়াল লিখনকেই বোঝানো হয়। তা চিকা মারা‘র পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লেখা ঐ দুটিমাত্র চরণ অবিলম্বে ছাত্রদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সংগ্রামের দিনগুলিতে মানুষের উজ্জীবনের অন্যতম মন্ত্রসদৃশ হয়ে ওঠে কবিতার এই দুটি চরণ। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে এই কবিতাই ছিল ক্লান্তি অপনোদনোর উপাদান।

শুধুমাত্র গ্রাফিতায়নের জোরে একটি অপ্রকাশিত কবিতার এমন জনপ্রিয়তা!

‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-র আগে ও পরে সাবেক পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গ্রাফিতির এবং গ্রাফিতি পোস্টারের বহুতর বৈচিত্র্যে লক্ষ্য করা যায়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দেয়াললিপি বা চিকা মারার উদাহরণগুলিতে একই সঙ্গে সংখ্যার ব্যাপকতা এবং দাবির সোচ্চারতার স্পষ্টীকরণ লক্ষণীয়। ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ’ এর মতো শ্লোগানের জন্ম ও বৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আমার নাম তোমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম গ্রাফিতিক শ্লোগানে ছাপ ছিল। ‘তোমার ভাষা আমার ভাষা / বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’র ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ১৯৭০-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও চিকা মারার বৈচিত্র্যে কম নয়। যদিও সেই অগ্নিকালে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে’, ‘ট্রাক চাপা দিয়েছ, আন্দোলন থামেনি। / ট্যাঙ্ক চাপা দিলেও থামবে না’, ‘আমি বাঙালি / বাংলা আমার দেশ, / বাংলা আমার ভাষা’, ‘জয় বাংলার জয়’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো / বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘ডাউন আয়ুব’, ‘পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না’ ইত্যাকার শ্লোগানের মধ্যে রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল বেশি―তুলনায় গ্রাফিতির এলিটীয় সৌরভ ছিল কম। দমন-পীড়নের কালে রাষ্ট্রীয় হিংসা এড়াবার জন্যই রাজনৈতিক কর্মী ও শিল্পীদের সাধারণ দেয়াললিখনের ক্ষেত্রেও চিকা মারতে হতো। গ্রাফিতির ক্ষেত্রে শাসক ও ক্ষমতাবানের গাত্রদাহকারী ইঙ্গিতপূর্ণ বহুমুখী ব্যঙ্গ হলে তো কথাই নেই গোপন রাত্রিতে টর্চের আলো, কালো মোটা রঙ আর দেয়ালের গায়ে অতি-দ্রুত চলমান মোটা ব্রাশ এবং টহলদার পুলিশের ব্যাপারে সচকিত সতর্কতাই ছিল চিকা মারার প্রধান উপাদান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর সন্ত্রস্ত বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রাম-নগরের দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারা হয় : ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’ পরবর্তীসময়ের উত্তাল বাংলায়, অশান্ত বাংলায়, বিপন্ন বাংলায় বার বারই চিকা মারা গ্রাফিতির নিগূঢ় ভাষায় মানুষের বৌদ্ধিক-চৈতন্যে প্রকম্পন অনুভূত হয়েছে, শাসককে দিশেহারা ও হিংস্র করেছে, ক্ষমতাকে করেছে প্রশ্ন।

শিল্পী কামরুল হাসানকেই অধিকাংশজন বাংলাদেশের আধুনিককালের প্রথম ও প্রধান গ্রাফিতি শিল্পী বলে মনে করেছেন। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত পরিপূর্ণ শিল্পী কামরুল হাসান নিজেকে পটুয়া বলতে ভালোবাসতেন। সন্দেহ নেই জাগ্রত সংবেদনের প্রহরী কামরুল চলমান আন্দোলনসমূহের সহযোগী হয়ে রাস্তার শিল্পী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। তাঁর পূর্বোল্লেখিত ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ নামক পোস্টারটি আসলে পরিপূর্ণ অর্থে গ্রাফিতিই―সর্বকালের অন্যতম সেরা গ্রাফিতি। এই বাক্যটিই তাঁর জীবনের উচ্চারিত শেষ বাক্য এবং এই স্কেচটিই শেষ ছবি।

রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পর্বতবাহী স্রোতের তীব্রতায় বহু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রাফিতির জন্ম হয়েছে। যেমন : ‘অপেক্ষায়…নাজির’। কে এই নাজির? কার বা কিসের অপেক্ষায় ছিল বা আছে সে? নতুন কোনো ভোরের প্রতীক্ষায়, নাকি শৃঙ্খলমুক্তির প্রতীক্ষায়? নাকি স্যামুয়েল বেকেটের নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’-র (রচনা : ১৯৪৮-৪৯, অভিনয় : জানুয়ারি ১৯৫৩) মতো গোডোর জন্য অবিরত ও অনন্ত প্রতীক্ষা! সম্ভবত ১৯৮০-র দশকের শেষদিকে নাজিরের প্রতীক্ষার শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রতীক্ষারত নাজিরকে খুব বেশি দেখা যায়নি।

‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ ১৯৯০-এর দশকের বাংলাদেশের একটি স্বল্পস্থায়ী গ্রাফিতি, যা বহু জনকে ভাবিয়েছিল। পরে আইজুদ্দিনের কষ্ট নিয়ে গল্প-কবিতাও েকা হয়েছিল। সম্ভবত ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তের দেয়ালে দেয়ালে একদা আইজুদ্দিন তাঁর কষ্টের কথা জানিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নীলক্ষেত, পুরান ঢাকা, দোয়েল চত্বর, তোপখানা রোড, নবাব আবদুল গণি রোড ইত্যাদি অঞ্চলের দেওয়ালে আইজুদ্দিনের কষ্টে থাকার সংবাদ নিবেদন, বারিধারা দূতাবাস সড়কের দেয়ালগুলোতে আবার বিদেশী কর্মী ও কূটনীতিকদের জন্য ইংরেজি অনুবাদে লেখা হয়েছিল ‘আইজুদ্দিন ইজ সাফারিং’ শব্দত্রয়। আইজুদ্দিন কে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি, নাকি অনেকের এক প্রতীকী নিরস্তিত্বময় তীব্র ব্যক্তিত্ব। এমন-কী ঢাকা শহরের বাইরেও আইজুদ্দিন তাঁর কষ্টের কথা জানিয়ে ছিলেন। সুতরাং আইজুদ্দিনের নাম করে অনেকেই চিকা মেরেছিলেন সে-সময়―এমন অনুমান করা যেতেই পারে। যদিও ব্যাপ্তির দিক দিয়ে আইজুদ্দিনের সফলতা ছিল কম। আইজুদ্দিন কষ্টে থাকার সংবাদ জানালেও কোথাও জানাননি―ঠিক কী কষ্টে ছিলেন তিনি। খাওয়া-পরার কষ্ট? প্রেমের কষ্ট? জীবিকায় ব্যর্থতার কষ্ট? নাকি ‘যদি জানতেম আমার কীসের ব্যথা তোমায় জানাতাম’-ধরনের কোনো অতীব উচ্চমার্গের বেদনা? গ্রাফিতির স্বভাবানুযায়ী আইজুদ্দিন সেকথা বলেননি কাউকেই, অথচ সকলেই―কেরানি থেকে অধ্যাপক, ভেণ্ডার থেকে কূটনীতিক, প্রাইমারি মাস্টার থেকে পাড়ার নেতা, গায়ক থেকে হাতুড়ি পেটানো শ্রমিক, ফুটবলার থেকে কবি, মুষ্টিযোদ্ধা থেকে মাঠের বাগাল, শাকউলি বুড়ি থেকে মাহিন্দার, কুচুটে মাসি থেকে গোবর কুড়ুনি ছুকরি―সকলেই আইজুদ্দিনের কষ্ট যে কী তা তার তার মতো করে বুঝেছিলেন, এমন কী মাঝারি গার্মেন্ট মালিকেরাও!

বোধহয় ঢাকায় গ্রাফিতিতে সুবোধ এসে পড়ায় আইজুদ্দিনের কষ্টের ইতিবৃত্তে যুক্ত হলো ভিন্নমাত্রার উদ্দেশ্যমূলকতা।

 

এই গ্রাফিতিতে সুবোধ যেন এক বিশ্বজনীন চরিত্র। সেখানে কখনও বিশ্বপ্রাণের উৎস সূর্য-রক্ষক সুবোধের হাতে খাঁচার ভেতরে সূর্য!  কখনও একা সুবোধ, কখনও তার সঙ্গে একটি শিশুকন্যা। কখনও সুবোধ ছুটন্ত, কখনও গরাদের অন্তরালে বন্দী। কখনও তার ঠোঁটে তর্জনির নিষেধাজ্ঞা। প্রায় সর্বত্র ইংরেজি বানানে ‘হবে কি?’-এর উদ্যত জিজ্ঞাসা। সুবোধের গ্রাফিতিগুলিতে টেক্সট ঈষৎ বৈচিত্র্যময় :

‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।’

‘সুবোধ তুমি চুপ থাক।’

‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, / এখন সময় পক্ষে না। / মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে।’

‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’।

‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের হৃদয়ে।’

‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি। / কাপ ভরা পাপ পাপ ম! / সুবোধ……..তুই পালিয়ে যাহ্।’

‘সুবোধ, কবে হবে ভোর?’

‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা / ভুলেও ফিরে আসিস না।’

‘সুবোধ তুই ঘুরে দাঁড়া’।

‘তবুও সুবোধ রাখিস সূর্য ধরে।’

‘সুবোধ তুই লড়ে যা, আপোষ তোকে মানায় না।’

‘সুবোধ তুই পালাস না কোথাও। তোর ভাগ্যে লড়াই লেখা।’

‘সুবোধ, গণকবরে কারা?’

‘খুবলে মগজ খাচ্ছে কাক / সুবোধ কি আজ নির্বাক?’

অধিকাংশ গ্রাফিতির মতো সুবোধ গ্রাফিতির শিল্পীর নামও জানা যায় না। শুধু ‘হবে কি’ বাক্যটি যেন শিল্পীর স্বাক্ষরের মতো সর্বত্র গ্রাফিতিক বয়ানের ধ্রুবপদ হয়ে থাকে।

ঢাকা ছাড়াও কলকাতার দেয়ালেও সুবোধকে দেখা যায়। সুবোধ চেহারায়, পোশাকে পুরোপুরি প্রান্তিক মানুষ। পারিপাট্যহীন এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, চকিত চাহনি। সুবোধ কোনো অতিমানব নয়, কোনো নায়ক নয়, উৎপীড়িত রোমান্টিক হিরো নয়, বেতাল-অরণ্যদেব, টারজান, গার্থ বা স্পাইডারম্যানদের মতো দুষ্টের যম নয়। সুবোধ হয়তো ছিন্ন-সাধারণজনের এক নির্বল, লক্ষ্যহীন, সমকালের জটিলতাকে চিহ্নিতকরণে চিরব্যর্থ জনপিণ্ডের একটা অংশ। নিজে পালায়, ভাগ্যতাড়িত মানুষের মতো পশ্চাদপসরণ করে, কিন্তু অনাহারক্লিষ্ট বালিকাকে সান্ত্বনা দেয়। তবু এর স্রষ্টা ব্রিটিশ গ্রাফিতিশিল্পী ব্যাঙ্কসির মতো ‘হবে কি’ ক্যামোফ্লেজের অন্তরালে সুবোধের সঙ্গে নবারুণকে জুড়ে দেন―আশা-সূর্যকে―মানুষের আশ্চর্য সম্পদ প্রাণের উৎসটিকে সুবোধ রক্ষা করে। ‘হবে কি’ তো একা নন, বাংলাদেশে ‘ক্রো-কাক’-এর মতো গেরিলা শিল্পীর গ্রাফিতিও আছে।

সুবোধ সম্পর্কে আমেনা শারমিনের মূল্যায়নটিকেও সাধ্যমতো গ্রাহ্য করতে হবে। সুবোধকে কেউ কেউ বাস্তু থেকে উচ্ছিন্ন, প্রতিষ্ঠা থেকে ভ্রষ্ট, সামাজিক গ্রাহ্যতার থেকে বঞ্চিত এক বিপন্ন নাগরিকসত্তা বলে মনে করেছেন। বাংলাদেশের ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন, নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা ও ক্রমবর্ধমান সেন্সরশিপ, মুক্তিবোধের ক্ষয় ইত্যাদির মধ্যে তরুণপ্রজন্মের লক্ষ্যহীনতার ‘চিরস্থায়ী ট্রমা’-র প্রতিনিধি সুবোধের চিকা মারা উপস্থিতি। সুবোধের প্রাথমিক উপস্থিতি ঢাকা শহরের শিল্প উদ্যানকে ঘিরে হওয়ায় অনেকেই মনে করেছেন যে, সুবোধ গ্রাফিতির লক্ষ্য শহরের খেটেখাওয়া ও ‘নিপীড়িত সামাজিক স্তর’-এর মানুষজন। কিন্তু সুবোধের পলায়নপর সন্ত্রস্ত মূর্তি একুশ শতকের শহুরে বিশ্বায়িত বন্দোবস্তে শ্রমজীবীদের  ভীতিপ্রবণ, আপোষকামী শ্রেণীচরিত্র ভ্রষ্ট, সমাজের গরিষ্ঠ মানুষের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দানের ব্যর্থতা, মধ্যবিত্তের দোলাচল এবং হতাশাকে ব্যক্ত করে। শেষ পর্যন্ত সুবোধের গ্রাফিতিতে দেশের পতাকা বুকে জড়ানো ছবি দেখে রাজীব দত্ত তীব্র শ্লেষে লেখেন : ‘তার ওপর সুবোধ মধ্যবিত্তের আরেকটা ব্যারাম ‘দেশপ্রেম’।  এই দেশরে একরকম সে ভালোবাসে, এই প্রেমরে দেখাইতেও সে ভালোবাসে। এইটা একটু দেরিতে বোঝে সুবোধ। যেহেতু সুবোধও মিডলক্লাস, তাই সে দেশে ছেড়ে যাইতে চাইলেও, তার যে দেশের প্রতি প্রেম আছে, অইটা সপ্রমাণ দেশ ছাড়তে পারলে তার মনন  পরিশুদ্ধ হয়। কোন গিল্টি থাকে না মনে, গোপনে। এই না থাকার প্রমাণ স্বরূপ, সুবোধকে পতাকাও হাজির করতে হল। সেই পতাকারে জড়ায়া ধরাও দেখাইতে হইল। উপায় ছিল না আসলে। কারণ সুবোধ ততদিনে পপুলার। নানান জন নানান কথা বলতেছে। মিডিয়া কভারেজ দিচ্ছে। তার মানে, সে যাদের নজরে আসলে বাস্তবিকই জেলে ঢুকে যাইতে পারে, অই আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশদ্রোহী হিসাবে হাতকড়া না পরার আগেই হাতে পতাকা নেয়াটারে সুবোধের একটা টেকনিক্যাল এপ্রোচ হিসাবেও নেয়া যাইতে পারে।’ (রাজীব দত্ত : ২০২১)

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের আমলে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনসহ প্রায় সমস্ত আন্দোলনেই গ্রাফিতি একটা সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। শাহবাগ আন্দোলনে গ্রাফিতিসহ সামগ্রিকভাবে প্রচার আন্দোলনে ঘাটতি ছিল। সেখানে শাহবাগ আন্দোলনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ অনেক বেশি ছিল।

ভ্লগারদের হত্যা [ভ্লগারদের সিরিয়াল হত্যা বলা যায়। বাংলাদেশে কয়েক বছরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের হাতে খুন হন একের পর এক লেখক ও ভ্লগার : রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অভিজিৎ রায় প্রমুখ। ভিন্ন মতের কারণে এইসব কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ড। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নিহত অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী কেউ আহত ও রক্তাক্ত অভিজিৎ এবং তার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে প্রাথমিকভাবে এগিয়ে আসেননি। (তাফসীর বাবু : বিবিসি) ঢাকায় সোমেন চন্দ, দিল্লিতে সফদার হাশমি! হত্যালীলা চলেছেই] সাম্প্রদায়িকতার গোপন কার্যক্রম, শাহবাগ আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার আবিষ্কার―মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ইত্যাকার নানাবিধ বিকারের অনুপ্রবেশ সহজেই ঘটাতে পেরেছিল। এমন-কী সেক্যুলার মানেই ধর্মোন্মাদদের শত্রু এবং ‘কতলযোগ্য’―এমন একটা বার্তাও থেকে যায়। পরিকল্পনামাফিক গ্রাফিতির সংগঠিত মিথ্যা ও অসদ্্-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত বামপন্থার কাছ হতে মেধা আহরণ এবং আত্মস্যাৎ ( শ্লোগান, গান, রচনা, ছবি, বিশ্লেষণ, ভঙ্গি, সাংগঠনিক কৌশল, রঙের ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি) করে তাকে বামপন্থার বিরুদ্ধেই ব্যবহারের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। গ্রাফিতিও সেই রকম। রাত্রে মশককুলের খোরাক হয়ে নিরাপদ শয্যার আশ্রয়কে বরবাদ না-করে চিকা মারার বদলে সরাসরি দল গুছিয়ে রাতারাতি প্রচার আন্দোলনে সমস্ত দেয়াল ভরিয়ে তুলে ভুল বার্তাকে বুদ্ধিপ্রিয় অথচ বুদ্ধিহীন শহুরে ভদ্দরলোকেদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়াও বিশ্বপুঁজিবাদের বিবিধ কার্যক্রমের একটি প্রকল্প হতে পারে।

রাজনৈতিক ঘটনাগত প্রত্যক্ষতা ছাড়াও গ্রাফিতি বহুতর রাজনীতি-সমাজনৈতিক বার্তা দিয়ে এসেছে। যেমন : ‘কায়দা করে বেঁচে থাকো’, ‘হোক প্রতিবাদ’, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, / জাতি আমাকে নেবে না’, ‘আনলক ইয়োর সোল’, ‘স্যাড জেনারেশন উইথ হ্যাপী পিকচারস’। এমন অনেক গ্রাফিতির উল্লেখ পাওয়া যায় রাজীব দত্তের পূর্বোক্ত রচনায়।  গৌতম বুদ্ধ নিজের মাথায় নিজে পিস্তল ধরে আছেন। সঙ্গে লেখা ‘লেট মি ডাই।’ পরম কারুণিক বুদ্ধ, যিনি জরা-ব্যাধি-মৃত্যুতাড়িত সারা জীবন কীভাবে মৃত্যুকে পেরিয়ে যাওয়া যায় সেই জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে চেয়েছেন, তিনিই আত্মহননে উদ্যত! নাকি আজ আর কোনো ধর্মাশোক নেই, কোনো শাসকের হৃদয়-পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাও অপ্রাসঙ্গিক, কেননা, স্বার্থ ও ভোগ্যপণ্যের বাইরে হৃদয় বলে কিছু নেই! রবীন্দ্রনাথ যে আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততার কথা বলেছিলেন, শুধু ক্ষমতার জন্য সেই আত্মঘাত আজ আরও একবার সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে! জীবনানন্দের ছবির সঙ্গে তাঁর হাসপাতালের বেড নম্বর―রাজীবও বুঝে উঠতে পারেন না―কী বোঝাতে চায় এই গ্রাফিতি! (প্রাগুক্ত রচনা)

…………………………..

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply