অকূলের কাল। পর্ব ৩২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

৩২

টানাপড়েন

প্রথমে এল অনুপম, আর তার এক বন্ধু। এই বন্ধুকে আগে কখনও দেখেনি ক্ষিতি। অনুপম বলল, – কী করা যায় বল তো।

ক্ষিতি বলল, – কোনো ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গেলে হয় না?

অনুপম বলল, – কীভাবে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয় সেটাও তো জানি না ছাই। ওখানে গেলে একদিনেই কি সব হয়ে যাবে?

অনুপমের বন্ধুটা এইসময় অযাচিতভাবে বলে উঠল, – আর একটা ছেলে আসেনি যখন, ওই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করে নিতে পারি।

ক্ষিতির শরীর রিরি করে উঠল। এমন নির্লজ্জ, বেহায়া ধান্দাবাজ ছেলে অনুপমের বন্ধু হয় কেমন করে! সে ছেলেটার দিকে আগুনচোখে তাকাতেই সে নিভে গেল একেবারে। অনুপমও বেচারা খুব লজ্জায় পড়ে গেল।

খানিক পরেই অমিয় নরজিতকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলো। দেখা গেল এদের বাস্তববুদ্ধি এবং সেইসঙ্গে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা  অনেক বেশি। কথায় আত্মবিশ্বাস। ভরসা পেল ক্ষিতি। বোঝা গেল তারা টাকাপয়সা নিয়ে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। অনুপমকে হস্টেলে ফিরে যেতে বলে ওরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে পাঁচজনে উঠে পড়ল। নরজিতের চেনাশোনা একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আছেন। ওয়েলিংটনে তাঁর অফিস। প্রথমে সেখানেই যাওয়া হবে। কী হয় না হয় দেখে তারপর বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

ড. পি কে বসু, ম্যারেজ অফিসার। পাকা মাথা, ছোটখাটো চেহারা। সঙ্গে আছেন বেশ স্বাস্থ্যবতী একজন লেডি অ্যাসিস্ট্যান্ট। বললেন, – আইনি বিয়ে মানে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। একদিনে হয় না বাবা। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে নিশ্চয়। তাহলে এক কাজ কর। আজ একটা বিয়ের নোটিশে দুজনে সই করে জমা দিয়ে যাও। সব ঠিক থাকলে এক মাস পরে, তিন মাসের মধ্যে বয়সের সার্টিফিকেট আর দুজনের দুটো ছবি নিয়ে আসবে। দুটো মালা ইচ্ছে হলে আনতে পারো। বিয়ে হয়ে যাবে।

নরজিত বলল, – কোনোভাবে হয় না স্যার?

বসু বললেন, কোর্ট, পুলিশের চক্করে পড়তে চাইলে হবে। সেটা আমার ইচ্ছে নেই। এই নাও ফর্ম। দুজনের সই করে জমা দিয়ে যাও। ফিজ দশ টাকা। সময় ভালো থাকলে তিরিশ দিন পরে, নব্বই দিনের মধ্যে বর কনে নিয়ে চলে এস।

তাই করা হলো। তাহলে এখন যাওয়া হবে কোথায়! নরজিত পরিকল্পনা করেই এসেছে। যাদবপুরের একটা বস্তিতে তার এক পিসি থাকেন। সেখানে মেয়ে দুটোকে আজ রাতের জন্য রেখে কাল চেষ্টা করা যাবে কালীঘাটের মন্দিরে বিয়েটা আপাতত সেরে ফেলা যায় কি-না। ওরা সানন্দে রাজি। নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোনো জায়গাতেই থাকতে তাদের আপত্তি নেই।

শান্তর বাবাকে ক্ষিতি যতোটা চালাক ভেবেছিল, তিনি তার থেকেও আসলে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরেন। শান্ত ওদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়েই বাড়ি ফিরে যেতেই তিনি তাকে চেপে ধরেন। আর শান্ত সঙ্গে সঙ্গেই গলগল করে সত্যি কথা সব উগরে দেয় তাঁর কাছে। তিনি ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দুপুরের খাওয়া সেরেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার বেলগাছিয়ায় তাঁর শালি অর্থাৎ শান্তর মাসির বাড়িতে এসে ওঠেন। তারপর শান্তর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে নেটকির বাড়িতে ফোন করে সব জানান। সবাই দম ধরে বসেছিলেন। কিন্তু মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পুলিশে খবর দেননি; মাথা-গরম দোলনের দাদাকেও বহু কষ্টে সামলে রেখেছিলেন। শান্তর বাবার ফোন পেয়ে দোলনের মামারা সক্রিয় হয়ে উঠলেন এবং কোনোভাবেই যেন পরবর্তী ঘটনা তাঁদের আয়ত্তের বাইরে না যায় সে-ব্যাপারে সতর্ক হলেন। প্রথমেই তাঁরা হস্টেলে এসে ক্ষিতির খোঁজ করলেন। সুপারের সঙ্গে দেখা করার পর অনুপম নিজেই এসে সর্বশেষ খবর তাঁদের জানিয়ে দিতে বাধ্য হলো। তাঁরা অবিলম্বে অমরশঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন অগিলভি হস্টেলে। সেখান থেকে খবর গেল কোম্পানির কাছে।

অমিয়, নরজিত বা ক্ষিতি এসব কিছুই জানত না। নরজিত তার পিসির ছিটেবেড়ার দেওয়াল, টিনের চাল, সিমেন্টের মেঝের ঘরে পরিষ্কার বিছানায় দোলন আর নেটকির থাকার ব্যবস্থা করে নিশ্চিন্ত মনে খিদিরপুরে ফেরার সময় ভাবছিল পিসি রাত্রে ওদের ডিমের ঝোল আর ভাত খাওয়াবার ব্যবস্থা যে করবে, তাতে ওদের অসুবিধে হবে কি-না। ফেরা মাত্রই কোম্পানির ঘরে ডাক পড়ল তিনজনের।

তাঁর ঘরে ঢুকতেই আক্রমণের প্রথম ঝাঁঝটা পড়ল ক্ষিতির উপরে – তুমি! তুমি এখানে কেন? ব্যাপারটা কী? পরীক্ষা তো দাওনি শুনলাম। এখন আবার বড়লোকের মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ! ছি ছি! বাবার নাম এমনি করে ডুবাবার জন্যে পয়সা খরচ করে তোমাকে কলকাতায় পাঠিয়েছেন!

–আর এই যে দুই মর্কট – মামার বিয়ে দেবার জন্যে একেবারে উঠে পড়ে লেগেছ। লজ্জাও করে না – মামা নিজে কোথায় থাকবে, কী খাবে তার নেই ঠিক। তার আবার বিয়ে দেবে! সব কটাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেব। মেয়ের বাড়ি থেকে কাল পুলিশের কাছে যাবে। ক্ষিতির সঙ্গে তার হনুমান ভাগ্নে আর এই সবজান্তা মোড়লটাকে থানায় নিয়ে গিয়ে যখন পেটাবে তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল! চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রেখে দিলে চাকরিটাও যে যাবে, সে-খেয়াল আছে তো? মেয়ে দুটোকে কোথায় রেখে এসেছ?

কোম্পানির হুমকিতে নরজিত খুব একটা ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হলো না। সে শান্ত মাথাতেই সব কিছু খুলে বলল কোম্পানিকে। ততোক্ষণে কোম্পানি ক্রোধবাষ্প বের করে দিয়ে কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বমেজাজ ফিরে পেয়েছেন। বললেন, – যা বলছি মন দিয়ে শুনে নাও। কাল সকালে তোমাদের প্রথম কাজ মেয়ে দুটিকে নিয়ে বেলগাছিয়ার একটা ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। কাল সেখানে মেয়ের অভিভাবকরা সবাই উপস্থিত থাকবেন। আর অন্য যে ছেলেটা জড়িত ছিল ব্যাপারটায়, তাকে নিয়ে তার বাবাও উপস্থিত থাকবেন। সেটা তাদেরই আত্মীয়বাড়ি। আমি যেতে পারছি না কিন্তু আমাদের অমরবাবুও থাকবে। তোমার আর অমিয়র সেই বাড়িতে ঢোকার দরকার নেই। তোমার গুণধর মামা আর আর সেই মেয়ে দুটিকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে সটান বাড়ি চলে আসবে।

কোম্পানির কর্তব্য শেষ হলো না। ক্ষিতিকে নিয়ে পড়লেন তিনি। বললেন, – তিন বছর তো বাড়ির টাকা নষ্ট করলে, শেষে পরীক্ষা না দিয়ে নিজের বাড়ির সুনামটাও নষ্ট করতে বসেছ। মাথা থেকে বিয়ের চিন্তাটা বাদ দিয়ে এখন থেকে ভাবতে থাক কীভাবে নিজের পড়াশুনাটা শেষ করবে। আপাতত রঞ্জিতের কোয়ার্টারে থাকবে। আমি কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দেব। এখন থেকে রোজ এসে হেলু আর বুড়িকে ইংরাজি পড়াবে বিকেলের দিকে। তারপরে আমি দেখছি প্রাইভেট কোম্পানিতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কি-না। দিনে চাকরি করবে, রাত্রে নিজের পড়াশোনা। এখন তো আর কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। ভালভাবে পরীক্ষার জন্য তৈরি কর নিজেকে।

হেলু অশোকের ভাই আর বুড়ি বোন। কোম্পানির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দুজনকে ইংরাজি শেখানোর ভার আপাতত ক্ষিতির ঘাড়ে চাপল।

ঘাড় নাড়া ছাড়া কারোরই কিছু বলার রইল না। পরদিন সকাল আটটায় চা-রুটি খেয়ে যাদবপুর যাবে বলে বেরিয়েছে তিনজনে, দেখা হয়ে গেল অনুপমের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েই।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply