অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩০। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

একবিংশ শতকের প্রথম দশকের পরও রাজনৈতিক গ্রাফিতির চরিত্র বদল হয়নি। ক্ষুধাতুর ব্রাজিলে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে, কিংবা ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ আন্দোলনে বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিস্ফোরণে গ্রাফিতি তার প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে।

ওয়াল স্ট্রীট―নিউ ইয়র্কের একটি বিখ্যাত রাস্তা। এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জের অবস্থান। এখানে অর্থনীতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক ‘দৈনিক পত্রিকা দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’-এর প্রধান দপ্তর। এই স্টক এক্সচেঞ্জই মার্কিন অর্থনীতির ভরকেন্দ্র। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্নীতি, কর্পোরেট আইনের অপপ্রয়োগ, ব্যাঙ্কিং নীতির ফলে কর্পোরেট-ধনীদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণের বিভেদের প্রতিবাদে ‘ওয়াল স্ট্রীট দখল করো’ আন্দোলন শুরু হয়। সংক্ষেপে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক একচোখোমি নীতির ফলে সৃষ্টি হওয়া বৈপরীত্যের, আর্থিক-আভিজাত্যের ধারাবাহিক দাপট ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে ক্রোধ ও মোহভঙ্গজনিত ক্ষোভকে ধারণ করেছিল এই আন্দোলন। ওয়াল স্ট্রীটে বিক্ষোভকারীদের মূল ও জনপ্রিয়তম শ্লোগান ছিল ‘উই আর ৯৯%’ বা ‘আমরা ৯৯%।’ এই বিক্ষোভ শুধুমাত্র বিক্ষোভকারীদের শারীরিক উপস্থিতির দ্বারা খ্যাতি পায়নি, এই বিক্ষোভ ছিল শিক্ষামূলক ও অপ্রতিহত পঁুজিবাদের জনবিরোধী, শোষণমুখী চরিত্র সম্পর্কে সচেতনতার বার্তাবাহী। এই আন্দোলনের কর্মীরা পুঁজিবাদের চরিত্র এবং তার পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে, বিশ্বপুঁজিবাদের অমানবিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এমা গারলিন এই আন্দোলনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটিকে উল্লেখ করেছেন : ‘দিজ ডেমোনস্ট্রেশনস অয়্যার নট জাস্ট অ্যাবাউট ফিজিক্যাল প্রেজেন্স ; দে অয়্যার এডুকেশনাল অ্যান্ড রেভোল্যুশনারি ইন নেচার, অ্যাক্টিভিস্টস্্ ওর্গানাইজড ‘িটচ্-ইনস্’, হয়ার পিপ্্ল গ্যাদারড টু ডিসকাস ইস্যুজ অব ইনইক্যুয়েলিটি, ক্যাপিটালিজম, অ্যান্ড দি পসিবিলিটিজ অব সিস্টেমিক চেঞ্জ। দিজ ‘িটচ্-ইনস্’ অয়্যার ডিজাইনড টু এডুকেট পার্টিসিপেন্টস অ্যান্ড ইনস্পায়ার এ ব্রডার রেভোল্যুশন ইন থট অ্যান্ড অ্যাকশন।’ (এমা গারলিন) এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি কাজে এসেছিল চলমান গ্রাফিতিগুলি। ওয়াল স্ট্রীটের বাইরেও ৯৯% মানুষের কাছে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছাবার ক্ষেত্রে এই সব গ্রাফিতির ভূমিকা ছিল বলে মনে হয়। অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রীট কেবলমাত্র নিউ ইয়র্ক নয়, কর্পোরেটের বিষাক্ত ছোবলের ব্যাপারে এই আন্দোলন সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেছিল।

২০১৪ সালে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল ব্রাজিল। ক্ষুধাপীড়িত ব্রাজিলে বিশ্বকাপ আয়োজন বা ফুটবল-ব্যবসা, জনগণের সাধারণ চাহিদা পূরণ না-করে স্টেডিয়াম নির্মাণ, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্রাজিলের মানুষ সর্বত্র বিক্ষোভ দেখায়। স্ট্রাইক, ব্যারিকেড নির্মাণ, রাজপথ দখল, বিক্ষোভ মিছিল, অন-লাইন প্রতিবাদ ইত্যাদি নানা উপায়ে মানুষ প্রতিবাদ জানায়। রাজধানী ও অন্যত্র দেয়াল ভরে যায় বিরুদ্ধ প্রচার ও গ্রািফতিতে। ডাইনিং টেবিলে খাবারের বদলে ফুটবল নিয়ে ক্রন্দনরত নিরন্ন শিশুর গ্রাফিতি এঁকে ব্রাজিলিয়ান রাস্তার শিল্পী পাওলো ইতো বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন।

 

বর্ণবাদের বিরূদ্ধে অনেক স্মরণীয় আন্দোলন বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। চে গুয়েভারার মতো অতটা না-হলেও নেলসন ম্যাণ্ডেলা কিংবা বেঞ্জামিন মোলোয়েজের মুখাবয়বের স্টেনসিল গ্রাফিতি বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে। খোদ আমেরিকা বার বার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ১৯৬৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলসের স্কুলগুলি মেক্সিকান আমেরিকান ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে এসে তাদের শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীদের তুলনায় ন্যূন শিক্ষাকাঠামো বরাদ্দ ও মানহীন (শুধুমাত্র বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক) পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করার প্রতিবাদ জানায়।

১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে কৃষ্ণাঙ্গ গাড়ি চালক রডনি কিংকে নির্মমভাবে মারধর করায় অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মীদের দায়মুক্ত করে দেওয়ার প্রতিবাদে প্রতিবাদ হয় এবং দাঙ্গা বেধে যায়। দাঙ্গায় অর্ধ-শতাধিক নিহত ও দ্বিসহস্রাধিক মানুষ আহত হন। ২০১২ সালে ১৭ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ ট্রেভন মার্টিনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকে খালাস করে দেওয়া হয়।

 

২০১৪ সালে মিজৌরি ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউন নামের এক আঠেরো বছর বয়সী তরুণকে ছ-বার গুলি করে হত্যা করে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নবতম সংযোজন ঘটে ২০২০ সালে শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। লস অ্যাঞ্জেলসসহ বিশ্বের সমস্ত প্রান্তরে এই আন্দোলন দেখা দেয়।

 

মিনিয়াপলিসের এক পুলিশ অফিসার সামান্য অভিযোগে জর্জ ফ্লয়েডের গলায় পা চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে হত্যা করে প্রকাশ্য রাজপথে। এই হত্যা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকে গতিশীল করে। এই আন্দোলন আইনের চোখে সকলে সমান, নাগরিক হিসেবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একই অধিকার এই আন্দোলনের বর্হিবাণী। ব্ল্যাক পাওয়ার, নারীবাদী, লিঙ্গভেদ বিরোধী, প্যান-আফ্রিকানিজম―ইত্যাকার আন্দোলন―সর্বত্রই  গ্রাফিতি একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে এসেছে। ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে গ্রাফিতির ভূমিকা কতটা শক্তিশালী ছিল তার প্রমাণ ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউজের নিকটবর্তী একটি রাস্তা জুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বা ‘কৃষ্ণঙ্গরাও মানুষ’ আন্দোলনের সমর্থনে একটি সুবৃহৎ লোগো-গ্রাফিতি কৈরি করা হয়। কালো রাস্তার গায়ে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের এই গ্রাফিতি মহাকাশ থেকেও দেখা যাচ্ছিল। আসলে বিক্ষোভকারীরা হোয়াইট হাউজের কাছাকাছির রাস্তাগুলিতেও প্রদর্শন করছিলেন। ওয়াশিংটন ডিসি-র ডেমোক্র্যাট মেয়র মুরিয়েল বাউজারের (মিউরিয়েল বোভাসার?)-এর প্রণোদনায় এই বিশাল গ্রাফিতিটি  সিক্সটিনথ্্ স্ট্রিটের দুটি ব্লকে বহু শিল্পীর উদ্যোগে রচিত হয়। বাউজার এই আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তাটির নামকরণ করেন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজ়া’।

 

…………………………..

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply