সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫৩। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

ধর্মোদয় বিহার: থাকা না থাকা কালিম্পঙ

বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো দু এক ফোঁটা। নিচে যেতে হয়। যাবার সময় দেখলাম, বাড়ির জটলার ফাঁকে এক টুকরো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। হয়তো ওখানেই, ওদিকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা? দরজার সামনে এক পাহাড়ি তরুণের সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি দরজা বন্ধ করে নেমে যাচ্ছিলেন, আমাদের দেখে একটু দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলাম, সামনের বাড়িটা কি খুব পুরোনো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, ওই দেখুন না লেখা রয়েছে ১৯৮৪। তাঁকে বললাম, পুরোনো বিহারটা কি ওইখানেই ছিলো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে এখন বন্ধ। ওই বাড়ি আর কেউ ব্যবহার করে না। সঙ্ঘরক্ষিতার কথা তাঁকে বললাম, বললাম, এই বাড়িতে দেশ বিদেশ থেকে কত লোক এসে থেকেছেন, উপাসনা করেছেন, পড়াশুনো করেছেন। এ সবের কিছুই তিনি জানেন না, বললেন মন্দিরে রোববার রোববার নেওয়ারি মহিলারা আসেন, পুজো হয়।

মসৃণ লন ও ফুলবাগানে ঘেরা, সুরম্য কাঠের কাজে মণ্ডিত, সদা-জীবন্ত, প্রাণচঞ্চল ও কাহিনিমুখর যে বাড়ির কথা লিংউড বিস্তারিত বলেছেন, তার সঙ্গে সামনের পরিত্যক্ত প্রাণহীন বাড়িকে মেলানো গেলো না। মানে, হলুদ রঙ করা পাথর এবং বাদামি কাঠে তৈরি বাড়ি আছে, সামনের লনে লন না থাকলেও ঘাসের মাঠ আছে। আবার নেইও। পাহাড়ের, সমতলের, সবজায়গার বাড়িগুলোয় যে গল্প স্মৃতি ইতিহাস জমা হয়ে থাকে, সেগুলোকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে ফেলে দিলে, বা অবহেলায় ভুলে গেলে, বাড়ি বাড়ি থাকে না, বাড়ির সামনের মাঠ নিছক মাঠ হয়ে থাকে। গল্পহীন পোড়ো বাড়ির, বড় বড় ঘাসে ছেয়ে যাওয়া উঠোন কি মাঠেরও নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে, সে সৌন্দর্য রিক্ততার, শূন্যতার, নিরবচ্ছিন্ন বিষাদের। একদিন, অনিবার্য একদিন, বাড়ি,পাশের বাড়ি, মাঠ কিছুই আর থাকে না, যেমন থাকে না পাহাড়, নদী, বন, নিসর্গও। সেই সবরকম না থাকার কথা আমরা বলছি, কখন থেকে বলেই চলেছি, আরো বলতে হবে।

লিংউড এবং মনিলার স্মৃতিকথনের সূত্র অনুসরণ করে কালিম্পঙ শহরের অনেকগুলো পুরোনো বাড়ি ঘুরে দেখা হলো। এ ছাড়া, কিছু বাড়ির কথা আগে থেকেই জানতাম, কিছু বাড়ির সঙ্গে নিতান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অনুষঙ্গ জড়িয়ে। অনেক বাড়ি দেখা হলো না, বা খুঁজে পাওয়াও গেলো না। খুঁজে না পাওয়া বাড়ির মধ্যে অন্যতম, হারমিটেজ নামের একটা বাড়ি, ধর্মোদয় বিহার ছেড়ে যাবার পর এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে, ওই বাড়িতে লিংউড থিতু হন, দীর্ঘদিন বসবাস করেন। লিংউড বলছেন, হারমিটেজ বাড়িটা কালিম্পঙ থেকে শিলিগুড়ি যাবার বড় রাস্তার ওপরেই। রাস্তার ওপারে গ্লেনগরি বলে আর একটা সুন্দর পুরোনো বাড়ি ছিলো। কোন একটা সময়ে ওই বাড়ি একঝলক দেখেছি, মনে পড়ে। সেই বাড়ির চৌহদ্দি ঘিরে এখন বিরাট উঁচু পাঁচিল, বিরাট, নিরেট, লোহার দরজা, নজরদারি ক্যামেরা ইত্যাদি, ভিতরে আসল বাড়ি আছে কি নেই কে জানে! তাও, গ্লেনগরি বাড়ির জায়গাটা আছে, দেখা না গেলেও খুঁজে পাওয়া যায়। ওই বাড়ির উল্টোদিকে হারমিটেজ বাড়ির থাকবার কথা। কিছুই পাওয়া গেলো না। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ সন্ধান দিতে পারলো না।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply