অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৯। অনন্ত জানা
১৯৭০-এর দশক ও তার পরবর্তীসময়ে প্রতিবাদী রাজনৈতিক সক্রিয়তার সঙ্গী হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় গ্রাফিতি-শিল্পের কণ্ঠস্বর তীব্র হতে থাকে। ‘১৯৭০-এর দশককে হিপ হপ গ্রাফিতি হিপ-হপ সংস্কৃতি (উল্লেখিত সময়ে নিউ ইয়র্ক সিটির সাউথ ব্রঙ্কস এলাকা দারিদ্র্য, ক্ষয় ও অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত ছিল। ব্রঙ্কসের তরুণেরা, বিশেষত ঐ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকান-আমেরিকান-ল্যাটিনো সম্প্রদায়ের যুবকেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের দিশাহীনতার মধ্যে অনুপ্রেরিত নতুন সংস্কৃতির সন্ধান করছিল। এর ফলেই হিপ-হপ নামক উপসংস্কৃতির জন্ম হয়। এর প্রধান উপাদান ছিল এক বিশেষ ধরনের গান, ব়্যাপিং, ডিজেইং, ব্রেক ড্যান্সিং এবং গ্রাফিতি)-র দৃশ্যমান উপাদান হিসেবে বিকশিত হয়। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল হতে ইউরোপে ছড়িয়ে যায়।’ (দ্রষ্টব্য : এলা গারলিন)

নিউ ইয়র্ক গ্রাফিতির এই বিপুলতা কিছুটা আশ্রয় পায় ১৯৮০-র দশকে শিল্পী ব্লেক লে ব়্যাট [জন্মগত নাম : জ়েভিয়ার প্রো (জন্ম : ১৯৫২)। গ্রাফিতির দ্রুত প্রচারণায় স্টেনসিল ও স্প্রে-কালারের সহায়তায় তিনি বিশুদ্ধ ফরাসি গ্রাফিতির আবিষ্কর্তা ও রাস্তার শিল্পী হিসেবে বন্দিত]-এর হাতে তৈরি ফরাসি গ্রাফিতিক আর্টে। ব্লেক লে ব়্যাটের গ্রাফিতি সমগ্র ইউরোপে স্টেনসিল গ্রাফিতিকে জনপ্রিয় রাস্তার আর্টে পরিণত করে। স্টুডিও-গ্যালারি-জাদুঘরের বাইরেও স্ট্রীট আর্ট শিল্প-স্বাধীন পরিচিতির দাবিদার হয়ে ওঠে। ব্লেকের গ্রাফিতি প্যারিস ছাড়াও লন্ডন, নিউ ইয়র্ক বা বার্লিনের দেয়ালেও চিত্রিত হয়েছে।

গারলিন তাঁর রচনায় ইউরোপ-আমেরিকা-লাতিন আমেরিকার গ্রাফিতি-সংগ্রামের একটি সংক্ষিপ্ত ছবি দেবার চেষ্টা করেছেন। চিলি এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দমনমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে গ্রাফিতি অন্যতম মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর্জন্টিনার মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশে চলা ‘ডেসপারেসিডো’ কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘প্লাজা দে মায়োর মাদার্স’-এর ধারাবাহিক আন্দোলন। ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জর্জ রাফায়েল ভিদেলার নেতৃত্বে সামরিক একটি জুন্টা খমতা দখল করেছিল। সামরিক জুন্টা দেশের গণতন্ত্রপ্রিয়, মানবাধিকারবাদী ও বিরুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি ‘জাতীয় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া’-র নামে দমন-পীড়ন শুরু করে। অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল টুকুমান জঙ্গলে বেড়ে ওঠা গেরিলাদের নির্মূল করা, বামপন্থাকে নিশ্চিহ্ন করা এবং চিলি ও ব্রাজিলের সামরিক একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শেষ পর্যন্ত এবং বিশ্ব পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা করে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। সামরিক জুন্টা ক্ষমতাসীন হয়ে বিরোধী গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে স্তব্ধ করবার জন্য গুম-খুনের পথ নেয়। প্রতিবাদীদের কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সংগঠন অপহরণ করে, তার পরে সেই ব্যক্তির ভাগ্য এবং অবস্থান স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রতিবাদীরা নিখোঁজ তালিকাভুক্ত হতে থাকে। এদের অধিকাংশের বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ বছরের কম। নিখোঁজদের মধ্যে উচ্চ সংখ্যায় ছিলেন ইহুদি. সামরিক জুন্টা ইহুদিদের পছন্দ করত না। অপহৃত ইহুদি সংবাদকর্মী জ্যাকব টাইমম্যান তাঁর ‘প্রিজনার উইদাউট এ নেম, সেল উইদাউট এ নাম্বার’ বন্দীজীবনের যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন।

প্লাজা দে মায়োর মাদার্স ছিল এইসব অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবাধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা এক সংগঠন। নিখোঁজ যুবকদের মাযেরা এই সংগঠনের পক্ষে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের সামনে পাবলিক স্কোয়ার প্লাজা দে মায়োতে ১৯৭৭ সালে বিক্ষোভ শুরু করেন। মায়েরা এই স্কোয়ারে সমবেত হয়ে প্রত্যেকদিন বিক্ষোভের সময় নিজেদের দাবি-সম্বলিত পোস্টার বহন করতেন, নিজের সন্তানের নামাঙ্কিত স্কার্ফ পরতেন, সন্তানের ছবি প্রদর্শন করতেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সামরিক জুন্টা তাঁদের স্কোয়ার থেকে অপসারণ করে। মায়েরা ১৯৭৭-এর সেপ্টেম্বরে বুয়েনস আয়ার্স থেকে ত্রিশ মাইল দূরে আওয়ার লেডি অব লুকাসের তীর্থযাত্রায় সন্তানদের নামাঙ্কিত স্কার্ফ পরিধান করে অংশগ্রহণ করেন বিক্ষোভ দেখান। সামরিক জুন্টার দ্বারা আন্দোলনকারী মায়েরাও আক্রান্ত হন। অনেকেই নিখোঁজ ও গুম-খুন হন। ১৯৮৩ নাগাদ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরও অত্যাচারী সামরিক জুন্টার শাস্তির দাবিতে মায়েদের আন্দোলন চলতে থাকে।


রাজধানী থেকে সামরিক শাসনবিরোধী এই আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্লাজা ডি মেয়োর বিক্ষোভ যেসব কারণে প্রচার পায়, শক্তিশালী হয়ে ওঠে তার মধ্যে একটি হলো বুয়েন আয়ার্সসহ আর্জন্টিনার দেয়ালে দেয়ালে খচিত হয়ে থাকা গ্রাফিতি চিত্র। নিখোঁজ যুবকদের মায়েদের মাথার স্কার্ফে লেখা সন্তানের নাম, পোশাকে খচিত সন্তানের পরিচয়, হাতে-থাকা সন্তানের ছবি কিংবা রাস্তায় আঁকা-লেখা ছবি ও শ্লোগান এই আন্দোলনকে সামরিক জুন্টার রক্তচক্ষুকে অতিক্রম করতে সহায়তা করে। ইয়োভান্না পিনেদা তাঁর নিবন্ধে এইসব গ্রাফিতির প্রভাব বর্ণনা করেছেন।

১৯৮০-র দশকে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যে ভাগ হওয়া, বার্লিনকে দ্বিখণ্ডিত করা জার্মান প্রাচীর [(১৯৬১-১৯৮৯) জার্মান প্রাচীর নিজেই ছিল ইতিহাসের একটি পর্বের সাক্ষী। বস্তত জার্মান বা বার্লিন প্রাচীর ছিল আদর্শগত বিভেদ, মতাদর্শগত অবস্থানের প্রভেদ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রতীক] গ্রাফিতির একটি বিস্তৃত আশ্রয় হয়ে ওঠে। প্রকাশ, বিদ্রোহ, সামাজিক বৈপরীত্য, পরম্পরাগত আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে জার্মান প্রাচীর গুরুত্ব পেয়েছিল। এই প্রাচীরের পূর্ব অংশটি ঈষৎ ধূসর ছিল আর পশ্চিম অংশটি গ্রাফিতির জন্য বেশি ব্যবহৃত, অনেকটা প্রাণবন্ত। প্রাচীরের গ্রাফিতিগুলিকে এলা গারলিন গভীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৮৮০-র দশকে আমেরিকার অকালপ্রয়াত চিত্রশিল্পী ও নিও এক্সপ্রেশনিজম আন্দোলনের সহযোগী জিন মিশেল-বাসকিয়াত (১৯৬০-১৯৮৮) ঐতিহ্যবাহী শিল্প জগতে গ্রাফিতিকে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। বাসকিয়াতের কাজ উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। তাঁর রচনায় বর্ণবাদ এবং শ্রেণীবিভেদের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টিজনিত প্রতিবাদে গ্রাফিতি নির্মাণে বাসকিয়েত নিজের স্বল্প-পরিসর জীবনে অকপট ছিলেন, কখনও কখনও আক্রমণাত্মক। সাধারণ ছবি আঁকার পাশাপাশি বাসকিয়েত ম্যানহাটনের অট্টালিকাগুলির দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করেন। তাঁর গ্রাফিতিতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট। বাসকিয়াতের কাজকে সাধারণভাবে গ্রাফিতির অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যা তাঁর অসামান্য বিমূর্ত চিত্র এবং প্রতীকগুলিকে আশ্রয় দিয়েছে। বাসকিয়াতের সর্বাধিক কৃতিত্ব এই যে, তাঁর চিত্রবৈশিষ্ট্যের উপাদানগুলি ( যেমন : শিল্প-আইকনের মাথার মুকুট) সারা বিশ্বেই বহু শিল্পীর কাজে দেখা যায়। (গারলিন) নিজের কাজ সম্পর্কে বাসকিয়াতের সুপরিচিত উক্তি : ‘আই জাস্ট স্টার্ট এ পিকচার অ্যান্ড আই ফিনিশ ইট। আই ডু নট থিংক অ্যাবাউট আর্ট হোয়াইল আই ওয়ার্ক। আই ট্রাই টু থিংক অ্যাবাউট লাইফ।’ এই স্বতোৎসার তাঁর গ্রাফিতিগুলিকে প্রাণ দিয়েছে।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে লন্ডন ও ব্রিস্টলের রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে স্টেনসিলজাত গ্রাফিতিরে ব্যাঙ্কসি নামটি স্বাক্ষরিত দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ব্রিস্টলের মানুষ বলে অনুমান করা হয়। ব্যাঙ্কসির দেয়াল-গ্রাফিতি বহুলাংশে রাজনৈতিক। পঁুজিবাদ, ভোগবাদ, যুদ্ধবাদিতা ইত্যাদির অঙ্কুশবিদ্ধ সমালোচনা পাওয়া যায় ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতে। তাঁর গ্রাফিতির আরেক-বৈশিষ্ট্য মননশীল ব্যঙ্গ, যা কার্টুন না-হয়েও কার্টুনের শ্লেষকে হার মানায়। সেই অর্থেই ব্যাঙ্কসির কাজকে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক আখ্যা দেওয়া যায়। বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি, বস্তুগত পণ্যসভ্যতার স্টান্টবাজি, মুদ্রানির্ভর কলুষতার ব্যাপক সমালোচনা দেখা যায় ব্যাঙ্কসির কাজে। ২০০৫ সালে প্যালেস্টাইন ভ্রমণ করেন । সেখানে, ওয়েস্টার্ন ব্যাঙ্কে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে ইজরায়েলের প্যালেস্টাইন নীতির সমালোচনা করে সাতটি বিশাল মাপের গ্রাফিতি রচনা করেন। এই সময় ব্যাঙ্কসি মানবতাবাদী রাজনীতির সমর্থক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উদারপন্থী, প্যালেস্টাইনে আগ্রাসনকারী ইজরায়েলের সমালোচক এব শিল্পরসিকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।

ব্যাঙ্কসির রাস্তার শিল্প ক্রমেই বিশ্বব্যাপী সম্ভ্রম অর্জন করেছে। ব্রিটিশ মানবিক ভূগোলবিদ লুক ডিকেন্স ব্যাঙ্কসিকে তাঁর নিজের ভাষাতেই ‘শিল্প সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেছেন। (গারলিন) রাস্তার এই নগরশিল্পকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা এই ধরনের নগরশিল্প দারিদ্র্য, অপরাধ, অপরিচ্ছন্নতা ও কিছুটা বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত হলেও ব্যাঙ্কসিকে রুচিবান শিল্পী হিসেবেই দেখেন। দারিদ্র্যলাঞ্ছিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গ্রাফিতিতে নিষ্পাপ শিশুদের ব্যবহার এক ধরনের কোমল অনুভূতির সৃষ্টি করে। যেন নিজেদের অমলতা দিয়েই এই শিশুরা জীবনের কার্কশ্যকে জয় করবে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা, কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত গ্রাফিতিগুলি রক্ষণশীলদের গাত্রদাহের কারণ হলেও ব্যাঙ্কসির খ্যাতি, শিল্পের ডিসকোর্সীয় ভাষা বদলে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন শিল্পবস্তুর নির্মাণে তাঁর সফলতা বিতর্কিত হয়েও মহীয়ান হয়ে থাকে। অন্তত ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতির শাণিত-সংবেদনকে চ্যালেঞ্জ বা অস্বীকার করার ক্ষমতা মিডিয়ার নেই।
(ক্রমশ)
