অকূলের কাল। পর্ব ৩০। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

জয়পরাজয়

যুদ্ধ আচমকাই যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনই থেমেও গেল হঠাৎ-ই। তের দিনের যুদ্ধের শেষে ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব রণাঙ্গনের পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা মাত্র ইন্দিরা একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দিলেন। তাঁর লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশ। গত নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করে ধীরে ধীরে দেশে ফিরতে লাগল ভারতীয় সামরিক বাহিনী। মুজিবর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হলো বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই অসামান্য সফলতার ফলে দেশেবিদেশে ইন্দিরা গান্ধির জনপ্রিয়তা হুহু করে বাড়তে লাগল, তিনি এবার পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মহলে চেষ্টা চালাতে লাগলেন।

১৯৭২ সাল ক্ষিতির জীবনকে ওলটপালট করে দেওয়ার বছর। আর কয়েক মাসের মধ্যেই যেসব অকল্পনীয় ঘটনা ঘটতে থাকবে, তাকে সে এবং তার বন্ধুরা অবেগমথিত রোমাঞ্চকর যাত্রা হিসাবে মেনে নিলেও, তার পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার ভবিষ্যতের জন্য চিন্তায় অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তখন থেকে দেশকালের খবর ক্ষিতির কাছে গৌণ হয়ে দাঁড়াবে। তার কলকাতাবাসের চার বছরের মধ্যে ৭২-৭৩ সালটা ক্ষিতির একান্তই ব্যক্তিজীবনের সালতামামি। এই সময়ের দেশবিদেশের চাঞ্চল্যকর যেসব ঘটনা তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল – নকশাল আন্দোলন, দেশের রাজনীতিতে পটবদল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন – এতদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে মিলেমিশে চলছিল – তা এবার বিদায় নেবে। কেবল বাহাত্তর সাল থেকে রাজ্য রাজনীতিতে যে-পরিবর্তন ঘটল সেটা পরোক্ষভাবে হলেও তার ব্যক্তিজীবনে প্রাসঙ্গিক। সেই শেষ কথাটা বলা হলেই ক্ষিতির আত্মকথার পরবর্তী অংশ হয়তো ভিন্ন চরিত্র ধারণ করবে।

গত বছর অজয় মুখার্জি পদত্যাগ করার পর বিধানসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বিধানসভার নির্বাচন হলো। সবাই ধরে নিয়েছিল এবার কংগ্রেসের পাল্লা ভারী। ইন্দিরা গান্ধির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সি পি আই আছে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে। কংগ্রেস এবার লড়বে জ্যোতি বাবুর ব্যারিস্টার বন্ধু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে। তিনি দেশবন্ধুর দৌহিত্র এবং কড়া প্রশাসক। ইন্দিরার কাছের লোক। তবুও জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট যে সমানে সমানে লড়বে সেই বিশ্বাসও কম লোকের ছিল না। নির্বাচনের ফল বেরোতে শুরু করলে লোকে অবাক হতে শুরু করল। কংগ্রেস ও সিপিআই জোটের জয়জয়কার। এত ভালো ফল অন্ধ কংগ্রেসিরাও আশা করেনি। কংগ্রেস একাই পেল ২১৬ টা সিট। জোটসঙ্গি সিপিআই ৩৫ আর বামফ্রন্ট মাত্র ১৪। জ্যোতি বসু বরানগরে পরাজিত হলেন। দিনের শেষে স্পষ্ট হলো কিছু একটা ছক কষেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে। ‘রিগিং’ কথাটা সেই প্রথম শোনা গেল পশ্চিমবঙ্গে। উত্তর ভারতে এভাবে নির্বাচন হয় জানা ছিল। সামন্ত, ভূস্বামীদের ইচ্ছেমত নির্বাচন হয়। সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার রাজনৈতিক বোধ গড়ে ওঠেনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো সিপিএম সারা রাজ্য জুড়ে ভালো সংগঠন গড়ে তুলেছে। সম্ভবত নির্বাচনের আগে তারা সিদ্ধার্থশঙ্করের কৌশল বুঝে উঠতে পারেনি।

নির্বাচনে যাই হোক, সিদ্ধার্থ-সরকার চলেছিল প্রশাসনের উপর নির্ভর করে। কংগ্রেসকে দল হিসাবে দুর্বল করে তুলেছিলেন তিনি। বেশ কিছু তরুণ কংগ্রেসি নেতার ডানা ছাঁটার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নকশাল আন্দোলন দমন করছিলেন, ক্ষেত্রবিশেষে সিপিএমও রেহাই পাচ্ছিল না। তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড খানিক পর্দার আড়ালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

একটা ভালো কাজ করেছিলেন তিনি। প্রচুর বেকার ছেলেকে সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়েছিলেন। কেবল যোগ্যতার নিরিখটা গোলমেলে ছিল। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের কংগ্রেস নেতাদের সুপারিশ মতো নামের তালিকা পৌঁছে গিয়েছিল বিদ্যুৎ, সেচ এবং গ্রামোন্নয়ন দপ্তরে। তবে সজাগ দৃষ্টি ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। স্বজনপোষণ চলতে পারে, আর্থিক দুর্নীতির ক্ষমা নেই। গোয়েন্দাদপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে বিরোধী নেতাদের মতো টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া কংগ্রেস নেতাদেরও মিসায় গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন তিনি।

 

মার্চে শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার কথা। ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরীক্ষা-ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারণে শিক্ষাবর্ষ পিছোতে শুরু করেছিল গত বছর থেকেই। এবার জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হবে পার্ট টু ফাইনাল পরীক্ষা। যথারীতি ক্ষিতির প্রস্তুতি প্রায় শূন্য। রোজ ভাবে কাল থেকে সব ভুলে পড়াশুনায় মন দেবে। সকাল হলেই প্রতিজ্ঞা ভুলে যায়। বাড়ির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। টাকাপয়সা নিয়মিত তো আসছেই না। দু-তিন মাস পরে সামান্য যা-কিছু পাঠাচ্ছেন বড়দা, তাতে অভীকের কাছে লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে ক্ষিতি। বাবা চোখে প্রায় কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। দুটো চোখেই ছানি পড়ে প্রায় দৃষ্টিহীন। প্রয়াত মেজদার ছোট শালা হরুদা ডাক্তার। জামসেদপুরে থাকেন। তিনি আসছেন, বাবাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়ে আনবেন। ওদিকে ছায়ের পেটে টিউমার হয়েছিল। বাঁকুড়া হাসপাতালে একবার অপারেশন হয়েছিল; আবার সেটা বেড়ে গেছে। এবার আরজিকরে এনে ভর্তি করা হয়েছে। আর একবার বোধ হয় অপারেশন করতে হবে।

এইসব নানা কারণে ক্ষিতি উদ্বেগে আছে। সেই সঙ্গে তার ঠান্ডাও লেগেছে খুব। ঠান্ডা লাগা মানেই কাশি, শেষ পর্যন্ত তা ব্রঙ্কাইটিসে গিয়ে দাঁড়াবে। এই তার ধাত। মন খারাপ থাকলে এটা বেশি করে হয়। আসন্ন পরীক্ষার জন্য ভয়ও একটা বড় কারণ।

অবস্থার উন্নতি হলো না। পরীক্ষা এসে গেল। ক্ষিতি সকাল থেকে পড়াশুনা না করে মনকে বোঝাল, পরীক্ষার হলে যাই চলুক, সে মন শক্ত করে নিজের মতো করে লিখবে। তার নোট মুখস্থ আসে না। নাই আসুক, নিজে সে ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়েছে, ড্রামাগুলো পড়েছে ভালো করেই, প্রোজ মোটামুটি, পোয়েট্রি তেমন পড়া হয়নি। রেটোরিক-প্রসোডি তার প্রিয় বিষয়। নিজের মতো করে লিখলে অনার্স মার্কস হয়তো এসেই যাবে। ভয় পেলে চলবে না।

হলে বসে কোশ্চেন পেপারে চোখ বুলোচ্ছে ক্ষিতি, ধপ করে একটা মোটা নোট বই তার মাথায় ধাক্কা খেয়ে পায়ের কাছে ল্যান্ড করল। চোখ তুলে তাকাতেই তার চক্ষুস্থির! হলময় উড়ে বেড়াচ্ছে বই আর নোটস-এর খোলা পাতা। যে-যার মতো সেগুলো লুফছে, পছন্দ হলে নিজের খাতায় টুকছে, না হলে উড়িয়ে দিচ্ছে অন্যদের দিকে। পরিদর্শক গা ঢাকা দিয়েছেন। ব্যোমভোলা হয়ে বসে বসে সেই অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখল ক্ষিতি, তারপর ব্ল্যাঙ্ক খাতা জনশূন্য টেবিলে চাপা দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে চলে এল।

বাইরে আসতেই কেমন বোধশূন্য লাগল নিজেকে। একটা বছর গেল। এবার কোথায় থাকবে সে? হস্টেলের খরচ বাড়ি থেকে যে আর আসবে না, সেটা নিশ্চিত। তবে কি বাড়ি চলে যাবে সে? গ্র্যাজুয়েট হতে না পারলে একটা স্কুল মাস্টারিও তো জুটবে না! বাড়িতে গিয়ে চাষবাস করবে? সেটা কিছু খারাপ নয়। তবে দোলনকে কি ভুলে যেতে হবে! সেটা তো সম্ভব নয়।

কতক্ষণ জানে না ক্ষিতি, গোল পার্কের ঘাসে শুয়ে থাকল সে। তারপর উঠে হস্টেলে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এবার কোথায় যাবে সে? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়ল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply