অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৮। অনন্ত জানা
একটি সুবৃহৎ মুদ্রণযন্ত্রে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ (মুদ্রণ কর্মী / সাংবাদিক), সঙ্গে লেখা ‘প্রেসের স্বাধীনতা’। একটি হ্রস্ব আকারের গ্রাফিতিতে একটি যুদ্ধ ট্যাঙ্কের সঙ্গে নিঃশব্দ শ্লেষ ‘সালেয়ার্স লেজার্স চারস লর্ডস’ (লাইট ওয়েজেস, হেভি ট্যাঙ্কস / হালকা মজুরি, ভারি ট্যাঙ্ক)। একটি শকুনের (!) ছবি, তার সঙ্গে লেখা ‘নাগরিক নির্দেশক সতর্কতা’। শ্রমিক-ছাত্রের স্কেচ, সঙ্গে বয়ান ‘জনগণের শক্তি’। জনগণের মুষ্টিবদ্ধ ও বিপরীতমুখী ভোটদাতার হাতের ছবি সঙ্গে লেখা ‘ভোট কিছুই বদলায় না, সংগ্রাম অব্যাহত থাকে (থাক?)’। মাইক্রোফোনের সামনে চোখ-বাঁধা সংবাদ পাঠকের ছবি, সঙ্গে লেখা ‘ইনফর্মেশন লিব্রে’ বা ‘বিনামূল্যে তথ্য’…ইত্যাদি।

রাজনৈতিক তত্ত্বের দিক দিয়ে যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন মে ’৬৮-র বিদ্রোহের শিল্প ও বয়ানের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি শহরের দেয়ালগুলি জয় করার, দৃষ্টিসীমাকে আলোড়িত করার মধ্য দিয়ে যে অদম্য প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তার কোনো তুলনা হয় না। শহরের গ্রাফিতিতেই দি সিচ্যুয়েশনিস্ট ও সুররিয়ালিস্টদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে শহরের জনগণের পরিচয় ঘটে। শ্রমিকেরা ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেবার পর এই সময়ের ( মে ’৬৮-র) একটি গ্রাফিতি : ১৯৩৬ সাল থেকে আমি মজুরি বৃদ্ধির জন্য লড়াই করেছি / আমার আগে আমার বাবা মজুরি বৃদ্ধির জন্য লড়াই করেছিলেন / এখন আমার একটি টিভি, একটি ফ্রিজ, একটি ভক্স ওয়াগন আছে। / তবুও আমার জীবনটাই একটা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে গেছে। / কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করো না, বাতিল করো।’
গ্রাফিতিক পোস্টারের অন্যান্য শ্লোগান : সংঘর্ষ থেকে সব কিছুর সৃষ্টি ॥ বস্তু তুমি লুকিয়ে পড়ো ॥ কবিতা এখন রাস্তায় ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহায়াগণ, জাগো ॥ বিচ্ছিন্নতা দূর করো। / আনুগত্য চেতনা দিয়ে শুরু হয়; / প্রথমে অবাধ্যতা করো ; তারপর দেয়ালে লিখো।” (১০ মে ১৯৬৮ সালের আইন) ॥ বিমূর্ততা নিপাত যাক ॥ জয় হোক ক্ষণিকের ॥ বাঁচার অধিকার চাইতে যেয়ো না হে, ছিনিয়ে নাও ॥ সমস্ত রোমাঞ্চ যে সমাজ শেষ করেছে শেষ করো তাকে—সেই তোমার শেষ রোমাঞ্চ ॥ শ্রেণীসমাজের বিলোপ ঘটাও। / প্রকৃতি না কাউকে দাস করেছে, না প্রভু। / শাসিত কিংবা শাসক, চাই না হতে কিছুই ॥ আমরা সেই ব্যবস্থা চাই, যা জনগণের সেবা করবে। / এমন ব্যবস্থা চাই না, যার সেবা জনগণকে করতে হয় ॥ মালিকের সঙ্গে কোন দরাদরি নয়, উচ্ছেদ করো তাকে। / মালিকেরই তোমায় দরকার, মালিককে তোমার দরকার নেই কোনো ॥ সব শিক্ষকই তোতাপাখি, তোতা-ই আবার শেখায় ॥ ধ্বংসের আবেগ একটি সৃজনশীল আনন্দ ॥ ওহে অধ্যাপকেরা, বিকল তোমাদের রুচি, তোমার আধুনিকতার নাম স্রেফ পাহারাদারি। / চাই না তালিম–কুত্তাগিরির ॥ প্রতারিত সময়ে সত্য বলাটাই একটা বিপ্লবী কাজ ॥ লেখক কিংবা শিল্পী হওয়া মানে শুধু সত্যের বয়ান দেওয়া নয়, সত্যকে আবিষ্কার করা ॥ অবক্ষয়ের সময়ে আপনি নীরব থাকা মানে নিজের ইতিহাস থেকে নিজেকে মুছে ফেলা ॥ আমায় মুক্ত করতে যেও না, সে আমি নিজেই বুঝে নেব ॥ আমি একজন মার্কসবাদী–প্ররোচনায় কাজ হবে না ॥ আমরা ভিক্ষা করি না, দখল করি ॥ জাতীয় পরিষদ যখন বুর্জোয়া থিয়েটারে পরিণত হয়, তখন সমস্ত বুর্জোয়া থিয়েটারকে জাতীয় পরিষদে পরিণত করা উচিত ॥ নির্বাচন বোকাদের জন্য একটি ফাঁদ ॥ বিপ্লব অবিশ্বাস্য, কারণ তা বাস্তব ॥ ১৯৬৮-তে স্বাধীন হতে চাও, মানে অংশ নাও। আমি অংশ নিচ্ছি তুমি অংশ নিচ্ছ আমরা সবাই অংশ নিচ্ছি, আর মাল কামাচ্ছে ওরা ॥ পাথরের প্রযত্নে সমুদ্র সৈকত ॥ কলকারখানা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ইউনিয়ন ॥ ব্যারিকেডে অবরোধ হয় রাস্তা, খুলে যায় পথ ॥ ওঠো, জাগো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হা-ঘরেরা ॥ ইত্যাদি।

লুইস বুনুয়েল [(১৯০০-১৯৮৩) স্প্যানিশ-মেক্সিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা। একই সঙ্গে স্পেন, মেক্সিকো ও ফ্রান্সে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যমিশ্রিত পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁকে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।] ছাত্র-শ্রমিক বিদ্রোহের সময় তাঁর ‘দি মিল্কি ওয়ে’ ছবির চিত্রগ্রহণের স্থান নির্বাচনের জন্য প্যারিস শহরে অবস্থান করছিলেন। তাঁর আত্মজৈবনিক ভাষ্যে (‘মাই লাস্ট ব্রিদ’) ছাত্রবিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী বুনুয়েল জানিয়েছেন যে, তরুণ ছাত্রদের গ্রাফিতিতে ‘অল পাওয়ার টু দি ইমাজিনেশন’ (‘কল্পনার সমস্ত শক্তি’), কিংবা ‘ইট ইজ ফরবিডন টু ফরবিড’ (‘নিষিদ্ধ করা নিষিদ্ধ’)-র মতো শ্লোগান দেখে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মুগ্ধও হয়েছিলেন। যদিও আন্দোলনের সারবস্তুর প্রতি প্রাথমিকভাবে বুনুয়েল হয়তো কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ১৯২০-র দশকের পরাবাস্তববাদী ভাষ্যের এমন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বুনুয়েল বিস্ময়ের সঙ্গে আন্দোলনক্ষুব্ধ প্যারিসের দেয়ালে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের অঘোষিত গুরু আন্দ্রে ব্রেতোঁ (১৮৯৬-১৯৬৬)-র উক্তির উদ্ধৃতি (‘প্রকল্পনা কোনো উপহার নয়, একে জয় করতে হবে’)-র গ্রাফিতায়ন লক্ষ্য করেছিলেন।
পরস্পরবিরোধী-অন্তর্বিরোধী-আত্মখণ্ডনের দুর্বলতায় আক্রান্ত, তাত্ত্বিকভাবে বে-শিকড় এবং নৈরাজ্যবাদিতার প্রশ্রয়ে দীর্ণ এই ছাত্রবিদ্রোহে ব্যবহৃত শিল্প-অভিব্যক্তিগুলিকে আজকের অতিভোগবাদী যুগের তুলনায় অনেক বেশি মৌলিক. অনেক বেশি সৃজনশীল, অনেক বেশি রোমান্টিক, অনেক বেশি সাহসী, অনেক বেশি শুদ্ধতাবাদী, অনেক বেশি স্বপ্নদর্শী বলে চিহ্নিত করা যেতেই পারে। মে ’৬৮-র গ্রাফিতিগুলিকে সম্মিলিত অভিব্যক্তি ‘বিদ্রোহের প্রবেশপথ এবং লেখক-শিল্পীর অভ্যন্তরীণ চেতনার বাতায়ন’ আখ্যা দেওয়া যায়। এমন ধারণা করা হয় যে, এই আন্দোলনই গ্রাফিতির শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করে দেয়।
১৯৭০-এর দশকের প্রথম থেকেই নগরজীবনে প্রায় সর্বত্র গ্রাফিতির শক্তি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। বাণিজ্যিক গ্রাফিতিতে অনেক আগে থেকেই প্রতীক বা ট্যাগে শিল্পীর প্রচ্ছন্ন নাম বা পরিচয় উল্লিখিত হয়ে এসেছে। নিউ ইয়র্কে গ্রাফিতিগুলিতে ‘ট্রেসি ১৬৮’-র মতো লেখকের নাম ট্যাগে বাড়ির নম্বরসহ উল্লিখিত হয়েছে। ব্রঙ্কসের লোক হলেও ঐ সময়ে সমগ্র নিউ ইয়র্কে গ্রাফিতি শিল্পী হিসেবে ‘ট্রেসি ১৬৮’-র নামটি সবচেয়ে পরিচিত ছিল।

ট্রেসির পুরো নাম মাইকেল ক্রিস্টোফার ট্রেসি (১৯৫৮-২০২৩)। তিনিই ওয়াইল্ড স্টাইল (এক জটিল লিখন পদ্ধতি। লিখনের এই জটিল রূপটি আয়ত্ত করা এবং একইভাবে উপযুক্ত দীক্ষা ছাড়া তা পাঠ করাও কঠিন। এখানে অক্ষরগুলি একটির সঙ্গে অপর একটি বিচিত্রভাবে সংযুক্ত। অক্ষরগুলিতে প্রাণবন্তরূপে গাঢ়, পরিমাণে প্রচুর রঙ ব্যবহার করা হয়) গ্রাফিতির উদ্ভাবক ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ট্রেসি ‘ব্ল্যাক স্পেডস’-এর সম্মানীয় সদস্য ছিলেন। ব্ল্যাক স্পেডস ছিল আমেরিকান-আফ্রিকান স্ট্রীট গ্যাং। ১৯৬০-এর দশকে নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস অঞ্চলে ১৯৬০-এর দশকে দেখা দিয়েছিল এবং ১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৮০-র দশকের শেষে এই সংগঠন ব্রঙ্কস থেকে ম্যানহাটন, কুইন্স, ব্রুকলিন, স্টেটেন আইল্যান্ড, নিউ জার্সি, কানেকটিকাট ইত্যাদি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। কমিউনিটি সার্ভিস গ্রুপের মতো হিংসাবিরোধী উদ্যোগ এবং আহার-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য ‘ব্ল্যাক স্পেডস’-এর কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ট্রেসি সর্বাথেই রাস্তার শিল্পীই শুধু নয় রাস্তার মানুষও ছিলেন―গঠন করেছিলেন নিজের সংগঠন ‘ওয়ান্টেড ক্রু’। এই সংগঠন ওয়াইল্ড স্টাইলের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ট্রেসি ১৬৮ নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে, যানবাহন, ট্রেনের দেয়ালকে ক্যানভাসে পরিণত করেছিল।
(ক্রমশ)
