সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

আবার কালিম্পং: ধর্মোদয় বিহারের খোঁজে

একেবারে স্বপ্নের মতো, আধো আলো আবছায়ায় ডুবে থাকা ঝাপসা জলরঙের ছবির মতো, আমাদের এদিককার পাহাড় পাহাড়তলি সমতলের পুরোনো বাদলদিন মনে পড়ে। বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ গিয়েছে কি যায়নি, আষাঢ়ের শুরুর আগেই এসে পড়তো বর্ষা। সে বর্ষা মানে অবিরত অবিরল অবিশ্রান্ত বারিধারা, কখনো ঝরঝর কখনো টিপটিপ, পাহাড়ে ধসের পর ধস, উপছে পড়া গিরিখাত, সমতলে গ্রাম শহর পথঘাট ডুবোনো বন্যা। আমরা যে জায়গাটায় থাকতাম সেটা খানিক উঁচু, নদী একটা দুটো ছিলো বটে, তবে তাদের জল বাড়ি কিম্বা পাড়া অবধি পৌঁছতো না। পাহাড় বেশি দূরে ছিলো না, ধস টপকে, কুয়াশার পুরু চাদর ঠেলে, কচ্চিত কখনো সেখানে যাওয়া হলে দেখা যেতো(কিম্বা, বেশি বৃষ্টির দিনে, চারপাশ ধুধু সাদা হয়ে থাকতো, দেখা যেতো না), পাহাড়ের মাথায়, গাছের গায়ে, গিরিশিরা ও পর্বতশানুতে জমে আছে তো আছেই, নানান রকমের নানান চেহারার মেঘ আর মেঘ, ছোট বড় রোগা মোটা, সাদা, ধুসরে মেশানো সাদা-কালো, খুব কালো। সেই সব মেঘ, কিম্বা মেঘের টুকরোরা নেমে আসতো একেবারে নদীখাত অবধি, নদী থেকে চোখ তুললেই দেখা যেতো, পাহাড়ের গাছে ঢাকা গা, রাস্তার ধারের, রাস্তা থেকে ওপরের বা নিচের, ছোটো ছোটো রঙিন বাড়িগুলো থেকে ঝুলছে মেঘের চাদর, মেঘের ফালি।

অনেকদিন পর, কালিম্পঙ যাবার মূল পথ, অর্থাৎ সায়েবসময়ের তিস্তা ভ্যালি রোড, এখনকার দশ নম্বর রাজপথ দিয়ে যেতে যেতে, সে-ইই বর্ষার কথা মনে হলো। নদীর পাশের এই পথটা কখন খোলা কখন বন্ধ, কেউ জানে না, হয় ছাল চামড়া ছাড়ানো পাথর মাটি বার করা বৃক্ষশূন্য পাহাড় ধসে নেমে আসছে রাস্তাসুদ্ধু, নয় আস্ত রাস্তাটাই ধসে কিম্বা ভেঙে নিচের নদীতে চলে যাচ্ছে। তেইশ সালের অক্টোবরের বন্যা, যখন হিমবাহ ভাঙা বাঁধ ভাঙা রাগী জল গ্রাম শহর ডুবিয়ে পাহাড় গুঁড়িয়ে ছুটে এসেছিলো, জায়গায় জায়গায় পথের চিহ্নমাত্র ছিলো না। অথচ, কালিম্পঙ সিকিম হয়ে চিন সীমান্ত অবধি রাস্তা চওড়া করা, নতুন রেলপথ বানানো, বাঁধ দিয়ে জল আটকে রেখে বিদ্যুৎ তৈরি, ইত্যাকার বিবিধ দেশপ্রেমিক প্রয়োজনে সরকারি-ঠিকাদারি-কোম্পানি উদ্যোগে পাহাড় খোঁড়া, ভাঙা, খুবলোনো বন্ধ হয়নি, কাছের পূব থেকে দূরের পশ্চিম, গোটা হিমালয়ের গায়ে উন্নয়নের দগদগে ঘা। বর্ষা হোক না হোক, মেঘ ডাকুক না ডাকুক, ধস নামছে যখন তখন, রাস্তাও থাকছে বা থাকছে না। থাকা না থাকা রাজপথ দিয়ে তিস্তা পেরিয়ে চিত্রে, কালিমপঙের চড়াই ভাঙতে ভাঙতে ভাবছি, ধর্মোদয় বিহার ব্যাপারটা আদৌ আছে তো? রাজপথের মতো, শহরের পাহাড়েও উন্নয়ন চলতেই থাকে, সায়েবসময়ের বাড়িঘর ভেঙে চৌকো লম্বা বাক্সবাড়ি, বাক্সবাজার হয়। সঙ্ঘরক্ষিতার বা মহাপ্রজ্ঞার শহরত্যাগের সময় থেকে নেই নেই করে ষাট ষাট বছর চলে গেছে, সে চক্করে বিহারের বাড়িটাও উবে যায়নি তো বেমালুম? এতদিন ধরে আসাযাওয়া চলছে, কই কখনো তো কারুর কাছে শুনিনি ধর্মোদয় বিহার নামের কোন বৌদ্ধ গুম্ফার কথা?

ভাবতে ভাবতে কালিম্পঙ এসে গেলো, খুব একটা খোঁজাখুঁজি না করেই বিহারের নিচের রাস্তায় পৌঁছে গেলাম। বিহার কোথায়? কালিম্পঙ থানার সামনে থেকে শিলিগুড়ি যাবার বড় রাস্তা বেয়ে খানিকদূর গেলাম, রাজ্যের ভিড়ভাট্টা হইচই ক্যাঁচোর ম্যাচোর। একদিকে চারতলা একটা নতুন খাম্বা গোছের হোটেল, গায়ে ক্যাটকেটে খয়েরি-হলদে রঙ, অন্যদিকে মোটর বাইক ইত্যাদি সারাই করার একটা দোকানের সামনে স্তুপীকৃত বাইক-টাইক, চাকা-টাকা, নাটবল্টু। এ সবের মধ্যিখান দিয়ে ভাঙাচোরা একটা রাস্তা ওপরের দিকে গেছে। উঠতে উঠতে দেখছি, রাস্তার বাঁকে লম্বা লম্বা ঘাসের বনের মধ্যে খাকিরঙের কাগজের বাক্স, সবুজ লাল চিপসের প্যাকেট, ছেঁড়া-ফাটা কালো পলিথিনের চাদর, অকেজো গ্যাসের উনুন, বোধহয় একটা গ্যাস সিলিন্ডারও। বাঁক ঘুরতেই রাস্তার পাশের ঘাসের বন নিবিড় হয়ে এলো, সেই সঙ্গে প্রমাণ সাইজের কচুগাছ। সারাপথ বৃষ্টির চিহ্ন ছিলো না, এখন আকাশ মেঘে ভারি হয়ে আছে, বৃষ্টি নামলো বলে, এদিকে ডানদিক বাঁদিক সামনে পিছনে কোথাও কোন বৌদ্ধ বিহারের ছিঁটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না, ওপরের দিকে, রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে, আর একটা চৌকো চারতলা বাড়ি। ফিরে যাবো? হয়তো বিহার উঠে গেছে, হয়তো এখানে ছিলোই না কোনোকালে।কিন্তু গুগল ম্যাপে যে স্পষ্ট দেখাচ্ছে, নিচের দোকানের লোকগুলোও যে এই রাস্তার কথাই বললো? মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফিরে যাওয়াই একরকম স্থির, হঠাৎ দেখি, বাঁদিক ঘেঁষে, পাহাড়ের গা জুড়ে একটা লম্বা উঁচু দেওয়াল। পাশের ঘাস বড় হয়েছে, গায়ে বহু যুগের জমাট শ্যাওলার আস্তরণ, বাদামি-লালচে, সবুজ, কালো, যে কারণে বোঝাই যাচ্ছিলো না দেওয়ালটা আদৌ আছে। ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখলাম, দেওয়ালে বড় বড় হরফে লেখা, ধর্মোদয় বিহার। অস্পষ্ট, ক্ষয়ে যাওয়া, শ্যাওলায় ঢেকে যাওয়া লেখা, তবু বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply