অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৭। অনন্ত জানা
নয় : পোস্টার ও গ্রাফিতির সীমারেখা, গ্রাফিতিক পোস্টারের নতুন ভাষা
ফ্রান্সের কলেজ পড়ুয়া স্তরের তরুণতর প্রজন্মের এই সময়কালীন যাপিত মানসিকতাকে দারুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন আলসি (অ্যালসি?) রেঙ্গিফো। এই কলেজ পড়ুয়াদের বয়সী ছাত্ররা তখনও শতাব্দীর দুই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রুশ বিপ্লব ও ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ছায়ায়’ বাস করত। ১৯৪৮-এর চিনের বিপ্লব, ১৮৫৯ সালের কিউবান বিপ্লব, ১৯৬৬ সালে সংঘটিত মহান প্রলেতারীয় ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’, ১৯৬৮ সালের চেকোস্লাভাকিয়ার ‘প্রাগ বসন্ত’ এবং অবশ্যই ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধ এ-সবই ঐ তরুণতর প্রজন্মের মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিল।
ফরাসি ছাত্ররা ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধ এবং এর সামাজিক-রাজনৈিতক নীরবতামূলক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। নতুন ও পুরোনো প্রজন্মের ভাবধারার সংঘাত ও সংকটাপন্ন দূরত্ব এই সময় খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফরাসি শিক্ষা কার্যক্রমের স্থবিরতা, সংস্কারহীনতার প্রতিবাদ করছিল ছাত্ররা। শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন ও সংস্কারের দাবি করে আসছিল ছাত্রসমাজ। যেমন ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কের স্বাধীনতা এবং এবং পুরোনো নীতিকাতরতাকে ছাত্ররা অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল।
প্যারিসের নঁতের (?নান্তেরে) বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কারকামী ছাত্ররা ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান, কঠোর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, শ্রমিক নিপীড়ন বন্ধ, শ্রমিকদের জন্য সামাজিক অধিকার ইত্যাদির জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। নঁতেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন দ্রুত প্যারিসের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত হলো। নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ছাত্ররা সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘাঁটি গাড়েন। সেখানে সংহতি বিক্ষোভ শুরু হয় এবং অচিরেই ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
ছাত্রবিক্ষোভকে সরকার সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ না-করায় সংঘর্ষ ঘনিয়ে আসে। সংহতি বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, গ্রেপ্তারি, ব্যাপক ধরপাকড় এবং বিপরীতপক্ষে ছাত্রদের দ্বারা ব্যারিকেড ভাঙা এবং পুলিশের দিকে প্রস্তর নিক্ষেপ ইত্যাদি ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করতে থাকে। অবিলম্বে এই আন্দোলন শ্রমিকদের মধ্যেও আলোড়ন জাগায়। আন্দোলনে শ্রমিকেরা যোগ দেয়। শ্রমিক ধর্মঘট দেখা দেয়। ক্রমশই তা জাতীয় সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হয়। ছাত্রদের সমর্থনে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ রাস্তায় নামে।
আটষট্টির মে মাসে এই ছাত্র আন্দোলন তীব্রতম ছাত্রবিপ্লবে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজের দাবি নিয়ে শুরু হলেও এই আন্দোলন আসলে ছিল চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্নয়ন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বাভাবিকতা (আন্দোলন চলাকালীন যুক্ত হয় সকল ধৃত আন্দোলনকারী রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি) ইত্যাকার দাবিকেন্দ্রিক বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক আন্দোলন।
বিক্ষোভে, ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে, শ্রমিক ধর্মঘটে গোটা দেশ প্রায় অচল হয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলনের সামনে চার্লস দ্য গলের নেতৃত্বাধীন ফরাসি সরকার প্রায় বিকলাঙ্গতায় আক্রান্ত হয়। কৌশলী ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জেস পম্পিদু বন্দীদের মুক্তি এবং সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা ঘোষণা করলেও ধর্মঘট চলতে থাকে এবং আন্দোলন তীব্রতর হয়। ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সরবোনের ক্যাম্পাসের দখল নেয় ছাত্ররা এবং এটিকে একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে ঘোষণা করে।’
এমনিতে ফরাসি সরকার (এবং প্রধানমন্ত্রী পম্পিদুও ) বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ‘নৈরাজ্যবাদী এবং যৌন বিকৃতির পতাকাবাহী’ বলে দেগে দেন।
এই আন্দোলন অর্থনৈতিক আন্দোলন ছিল না। মুখ্যত ছিল পুঁজিবাদী সমাজের স্থবিরতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জীবন, বুদ্ধি-রুচি, পশ্চিমী বিশ্বের গণতান্ত্রিক ধারণার সংঘাত। এই আন্দোলন এতটাই বিস্তার লাভ করে এবং তীব্র হয়ে ওঠে যে, একসময় তো একদল মানুষ, বামপন্থার সমর্থকেরা ভাবতে থাকেন এবং শাসকেরা আতঙ্কে এমনও মনে করতে থাকে যে, ফ্রান্সের মতো ‘একটি শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশেও হঠাৎ করেই প্রকৃত বিপ্লব সংগঠিত হওয়া সম্ভব!’ আলসি রেঙ্গিফোর বিচারে ১৯৬৮-র ফরাসি ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে সেরা গ্রন্থ ‘প্রিল্যুড টু রেভোল্যুশন : ফ্রান্স ইন মে ১৯৬৮’-এ ড্যানিয়েল সিঙ্গার (১৯২৬-২০০০) লেখেন যে, প্যারিসের ঘটনাবলী মার্কসবাদী গুরুত্বের দিক থেকে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত ছিল। কেননা মার্কস বলতে চেয়েছিলেন স্বল্পোন্নত দেশে ছড়িয়ে পড়ার আগে উন্নত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হবে। [‘সাচ মার্কসিজম মাস্ট স্টিল এক্সপ্লেন ইন ইটস্্ ওন টার্মস হোয়াই ইট হ্যাজ হ্যাড মেয়ার সাকসেস ইন প্রিমিটিভ কান্ট্রিজ দ্যাট দ্যান ইন দি ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড্ ওয়েস্ট ফর হুইচ ইট ওয়াজ ওরিজিন্যালি কনসিভড্…।’ (প্রাগুক্ত গ্রন্থ : ১৯৭০)] এই পরিস্থিতির বিস্ময় রেঙ্গিফোর কলমে এইভাবে প্রকাশ পেয়েছিল : ‘ইমাজিন আমেরিকান স্টুডেন্টস স্পন্টেনিয়াসলি রিভোল্টিং ওভার ট্যুইশন ফিজ, উই ক্যান ওনলি ড্রিম।’ (প্রাগুক্ত রচনা : ২০১৯)
শুধুমাত্র ছাত্রদের আন্দোলন এতটা বিস্তৃত ও ঘাতসহন ক্ষমতাসম্পন্ন হতে পারতো বলে মনে হয় না। স্বনামধন্য শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও প্রতিবাদ, বামপন্থী তাত্ত্বিক ও খ্যাতনামা অধ্যাপকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেবার ব্যাপারে তাঁদের ভূমিকা এই আন্দোলনের শক্তি, সৌন্দর্য, সৌরভ, শৈল্পিকতায় অনন্য মাত্রা যোজনা করে। এই আন্দোলনের ব্যাপারে দুটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় :

১. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সরকারপন্থী, কায়েমি স্বার্থরক্ষাকারী অধ্যাপক ও সরকারি স্তরের স্তাবক ব্যুরোক্র্যাট ও টেকনোক্র্যাটদের ভূমিকা।
২. আন্দোলনের সত্য খবর প্রচারে বেতার-টিভি এবং মূলধারার বা পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের অবিমৃশ্যকারী ভূমিকা।
১৯৬৮-র আন্দোলনে সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা, দ্য গলের শ্রেণীশাসিত এবং রক্ষণশীল সরকার, পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ, বেকারত্ব, নারী ও দুর্বল সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন, শ্রমিকদের অবহেলিত জীবন (?কাজের পরিবেশ) ―ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছাত্ররা রাজপথে যেসব সোচ্চার শ্লোগান দিয়েছিল তার মধ্যে ‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি করো’ ছিল সর্বজনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত! ছাত্র এবং তাদের সঙ্গে রাজপথের বিক্ষোভে যোগ দেওয়া শ্রমিকদের এই অসম্ভবের দাবি পুঁজিপাণ্ডাদের পক্ষে কতটাই অসহনীয় ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
টেলিভিশন ও বেতারে পক্ষপাতমূলক ছবি ও ভাষ্যের প্রচার চলছিল এবং মূলধারার সংবাদপত্রগুলি মধ্যপন্থা ও সত্যপ্রচারের ভান করলেও তারাও এই আন্দোলনকারীদের জঙ্গী ও সহিংস কার্যকলাপ, সীমালঙ্ঘনকারী অবমাননাকর বক্তব্য, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য অভিযুক্ত করেছিল। সংবাদপত্রগুলি ছাত্র ও শ্রমিকদের এই বিদ্রোহকে রাজনৈতিক বর্ণালীর ছদ্মবেশে অযৌক্তিক, অকারণ, অত্যধিক হিংস্র ও উৎশৃঙ্খলা বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছিল। শ্রমিকদের সঙ্গে ছাত্রদের জোটকেও এই মিডিয়া ছোটো ও গুরুত্বহীন করে দেখাতে চেয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনকারীরা সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতপূর্ণ আচরণের ও মিথ্যাপ্রচারের বিরুদ্ধে প্যারিস ছেয়ে গিয়েছিল গ্রাফিতিক-পোস্টারে। পঁুজির কাছে নতজানু বেতার ও দূরদর্শন রোবট হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল ‘অন ভোয়াস ইনটক্সিক’ (‘ইউ আর বিইং পয়জ়নড’ / ‘আপনাকে বিষ দেওয়া হচ্ছে’)।
এই ধরনের শ্লেষাত্মক ও রহস্যময় পোস্টারকে গ্রাফিতি বলে মনে করায় কট্টর তাত্ত্বিকেরা আপত্তি জানাতেই পারেন, টেক্সট ও ছবির যুগলবন্দীতে সেগুলিকে গ্রাফিতিক-পোস্টার বা পোস্টারীয় গ্রাফিতি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
পক্ষপাতপূর্ণ প্রচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বামপন্থী ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিকল্প পত্রিকা অ্যাকশন (১৯৬৮-৬৯) প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত এই সংবাদপত্র, যা মুখ্যত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ফরাসি স্টুডেন্টস (ইউ এন এফ এফ) এবং হাই স্কুল স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি ইত্যাদি সংগঠনের কর্মীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর সম্পাদকদের মধ্যে কমিউনিস্ট স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (ইউ ই সি)-র অনেক প্রাক্তন কর্মী ছিলেন। সমকালীন প্রতিভাবান গ্রাফিক ডিজাইনারদের অনেকে এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রথমে এটি সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও দ্রুত দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা এক লক্ষে গিয়ে পৌঁছেছিল। (তথ্য : ফ্র্যাগমেন্টস্্ অব দি হিস্ট্রি অব দি ব়্যাডিক্যাল লেফ্ট)
মেন স্ট্রিম মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানপন্থী অধ্যাপক-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একাংশের ভীতিপূর্ণ উন্নাসিকতা, সীমিত সমর্থন, কৌশলী নীরবতা, সুবিধাবাদী তাত্ত্বিকতা, বামপন্থী হিসেবে পরিচিতদের একাংশের নিষ্ক্রিয় হিসেবী পদক্ষেপ (এই আন্দোলনে ফরাসি বুদ্ধিজীবীসমাজের ভূমিকার প্রায় পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় গাব্রিয়েল রকহিলের গবেষণায় : ২০২৩) সত্ত্বেও ছাত্র ও শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে সক্রিয়-নৈতিকতায় সমর্থনকারীদের মধ্যে ছিলেন অনেকেই! জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্মগ্রহণকারী বেলজিয়ান অধ্যাপক ও মার্কসীয় তাত্ত্বিক আর্নেস্ট ম্যান্ডেল (১৯২৩-১৯৯৫), ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক শতায়ু এডগার মরিন (জন্ম :১৯২১), জাঁ পল-সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০) এবং সিমোন দ্য বোভেয়ার (১৯০৮-১৯৮৬), জাঁ লুক গদার, বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪)-র আন্দোলনের সঙ্গে প্রাথমিক ও সীমিত-সম্পৃক্ততা, সমকালীন ফরাসি শিল্পীরা (যেমন : এডুয়ার্ডো অ্যারোয়ো, মার্শাল রেসে এবং বার্নার্ড র্যানসিলাকের মতো শিল্পীরা) প্রমুখ অনেকেই। সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বোভেয়ার প্যারিসের রাস্তায় নিষিদ্ধ পত্রিকা বিলি করেছিলেন ; আর্নেস্ট ম্যান্ডেল প্যারিসের রাস্তায় ব্যারিকেডকে অগ্রাহ্য করে জমায়েত হওয়া ছাত্রজনতার প্রতি বক্তৃতা দিয়েছিলেন ; ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ২১ তম কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করার দাবি জানিয়ে গদার ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখালেন। গদার স্পষ্ট করে বললেন― ‘আমরা ছাত্র এবং শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতির কথা বলছি, আর তোমরা ডলি শট এবং ক্লোজ-আপের কথা বলছো। তোমরা বোকা।’

এই আন্দোলনের প্রতি ফরাসি ইন্টেলিজেন্সিয়ার সমর্থন কিংবা দূরত্বের বিষয়টি আদৌ লঘু ব্যাপার ছিল না। এ-সংক্রান্ত মিথগুলিকে বর্জন করেও বলা যায় যে, শুধু ফ্রান্সের নয়, সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ, শিল্প-সাহিত্যের কারিগর কিংবা গদার, ত্রুফো ছাড়াও অনেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন, নিজেরাও উদ্ধুদ্ধ হন।
বহু অভ্যন্তরীণ ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা, মধ্যবিত্তসুলভ ভাবালুতা, নানাবিধ ইউটোপিয়া, মার্কসবাদের অপব্যাখ্যা ও প্রয়োগ, গোষ্ঠীগত সুবিধাবাদ, দিশাহীনতা সত্ত্বেও এই আন্দোলন ফ্রান্সের দ্য গল ও পম্পিদুর যুগলবন্দীর ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। মার্কিন তথা পশ্চিমীবিশ্বের পুঁজিবাদের ভাবগত শিকড়-সন্ধানী শাসককুলকে কম্পিত করেছিল। এই কম্পনের বিস্ফোরিত চাঞ্চল্যে সবচেয়ে দ্রুতি দিয়েছিল, অনুপ্রেরিত করেছিল নতুন যুগের সাংস্কৃতিক যোগসূত্রগুলি। সাংস্কৃতিক সূত্রগুলির মধ্যে প্রধান ছিল প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে খচিত পোস্টারীয় গ্রাফিতির উদ্দীপনাময় শরীর, পোস্টারোপম প্রতিবাদের ব্যাখ্যাযোগ্য রহস্যময় ব্যাপক উপস্থিতি।

প্যারিসের রাস্তাগুলিতে যখন ছাত্রবিক্ষোভ বন্ধ করার জন্য পুলিশ দমন-পীড়ন-সংঘর্ষের পথ নেয়, ‘কাঁদানে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে’ তখনই প্যারিসের ইকোল দেস বোকস্ আর্টস বা স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর ছাত্ররা এর স্টুডিওগুলি দখল করে নেয়। এই স্টুডিওগুলিতে মে, ৬৮ আন্দোলনের ‘স্থায়ী’ আগ্নেয় উপাদানরূপে গ্রাফিতিসদৃশ পোস্টারগুলি আন্দোলনকালীন বাস্তবতাকে একটি দূরপ্রসারী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখনই গ্রাফিতির শক্তি নতুন করে বোঝা যায়। সব গ্রাফিতি (সরাসরি দেয়ালে হোক বা কাগজে, পিচবোর্ডে, কাষ্ঠখণ্ডে, বা কার্টিজ পেপারে) দেয়ালের লেখা হলেও সব দেয়াললিপি গ্রাফিতি নয়। তেমনি পোস্টারও গ্রাফিতি হতে পারে, কিন্তু সব পোস্টার গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে না। গ্রাফিতির গোপন-ব্যঞ্জনা, গোপনে প্রকাশ্য উপস্থিতি আর রহস্যময় নিষিদ্ধতা স্বল্প বয়ানকে এক অসম্ভব পূর্ণাঙ্গ ইশ্্তেহারে পরিণত করে। সেই অর্থে ১৯৬৮-র দ্রোহ প্যারিসসহ বড়ো বড়ো শহরের দেয়ালগুলোই আন্দোলনের ঘোষণাপত্রে পরিণত হয়। ‘এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।’ (বীরেন দাশশর্মা : ২০০৫) এই ধরনের সংস্কৃতি ও শিল্পকে সংগ্রামের হাতিয়ার এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে মনে করা হচ্ছিল।
একক বা কদাচিৎ দুই বা ততোধিক রঙের গ্রাফিতিক-পোস্টারগুলির মধ্যে ছিল রাজপথে এক বিক্ষোভকারিণী পাথর ছঁুড়ে মারছেন। এটি বস্তুত বিক্ষোভের যথাযথ ফটোগ্রাফিক গ্রাফিতায়ন, সঙ্গে ‘লেখা লা বিউটি এস্ট ডান্স লা রু’ (বিউটি ইজ ড্যান্সিং ইন দি স্ট্রীট / সৌন্দর্য রাস্তায় নাচছে)। একটি ইস্টকনির্মিত কারখানার চিমনির মতো একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত, লেখা ‘লা লুটে কন্টিনিউস’ (দি ফাইট কন্টিনিউস / লড়াই চলতেই থাকে)। অপর একটি গ্রাফিতিকে আন্দোলনকালীন অশান্তিতে বিরক্ত মধ্যবিত্ত-সুবিধাবাদকে ব্যঙ্গ করে একদল ভেড়ার রেখাঙ্কনের সঙ্গে লেখা ‘রেট্যুর আ লা নরম্যালে’ (গো ব্যাক টু নরমাল / স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যান)। একটি মাক্রোফোনিক লাউড স্পিকারের ছবির সঙ্গে লেখা ‘এটেনশন লা রেডিও মেন্ট’ (বি কেয়ারফুল, দি রেডিও ইজ লাইং / সাবধান রেডিওটা মিথ্যা বলছে)। অপর একটি গ্রাফিতিকে একটি মুণ্ডিতমস্তক ব্যক্তির নাক ন্যাকড়া দিয়ে পিছন থেকে চেপে ধরেছে দুটি হাত, লেখা ‘রিফর্মস্্ ক্লোরোফর্মস’ ( ক্লোরোফর্ম সংস্কার)। মে ’৬৮-র গ্রাফিতিগুলির মধ্যে বিখ্যাত একটিতে হেলমেট পরিহিত দাঙ্গা পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে ধরেছে সামনের কাউকে (সংখ্যাতীত বিক্ষোভকারীদের) মারবার জন্য। একটি শব্দও এখানে লেখা হয়নি, তবু এটিকে ব্যাখ্যারও কোনো প্রয়োজন হয় না।
(ক্রমশ)
…………………………..
(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)
