অকূলের কাল। পর্ব ২৭। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

1

(গত পর্বের পর)

বিনষ্ট অঙ্কুর

মলয়কে দেখলে আজকাল যে-কেউ চমকে যাবে। সেই অতি সুদর্শন, চমৎকার চেহারার তরুণ যেন ঝামরে গেছে। ধানগাছে একরকম পোকা লাগলে ধানের শীষ যেমন ঝামরে ঝুলে পড়ে, অবিকল সেরকম। মুখে কালি, ঠোঁটের কোণে ঘা, প্যান্ট কোমর থেকে নেমে যাচ্ছে। কী-জানি সিদ্ধি ছাড়াও আরও কী কী-সব নেশা করছে! বাবার পাঠানো টাকায় আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। প্রথমে বই বিক্রি করছিল। কত ভালো ভালো বই ছিল মলয়ের – ইতিহাস, দর্শন  সব শেষ হয়ে পদার্থবিদ্যাও বিক্রি করতে ধরেছিল। অভীক জানতে পেরে সেই বইগুলো নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। বলেছে, তোমার বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি এলেই বই তাঁর হাতে  তুলে দেব। নিরুপায় মলয় এখন নিজের পুরনো সার্ট-প্যান্ট বিক্রি করছে। কাকু দোলনের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গিয়েছিল তার কচি কলা পাতা রঙের যে-হাওয়াই সার্টটা পরে সেটা একদিন হাতে নিয়ে বেরচ্ছিল, জিজ্ঞেস করে কাকু জানতে পারে সেটা নিয়ে যাচ্ছে শিয়ালদার রেললাইনের ধারে বসা পুরনো জামাকাপড়ের হাটে বেচবে বলে। সঙ্গে সঙ্গে কাকু দশ টাকা দিয়ে নিজেই সেটা কিনে নিয়েছে, নইলে হাটে নিয়ে গিয়ে দু টাকা পাঁচ টাকা যা পেত তাই নিয়ে অত সুন্দর, কাকুর প্রিয় স্মৃতিগন্ধ মাখা জামাটা দিয়ে আসত।

এক সন্ধেবেলায় নিজের একলা ঘরে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিল মলয়। আওয়াজ শুনে দিনু, কাকু আর অভীক গিয়ে দাঁড়াল তার বিছানার পাশে। মলয় নিজের বুকে হাত বোলাতে বোলাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কী-সব বিড়বিড় করে যাচ্ছে। অভীক তার অভ্যেসমতো গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল। দিনু, কাকু দুজনেই তার হাত চেপে ধরল। কাকু মলয়ের মুখের কাছে কান নিয়ে যেতে কথাগুলো স্পষ্ট হলো। বলছে, – সন্ধ্যা সন্ধ্যা – তুমি নইলে বাঁচব না!

চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে তার। কী আপদ! নেশার সঙ্গে আবার সন্ধ্যা এসে জুটল কোথা থেকে! কাকু সেই মুহূর্তে এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না। অভীককে বলল, তুই ওর বাবাকে টেলিগ্রাম করে খবর দে, উনি যেন দেরি না করে চলে আসেন এখানে। এইভাবে চলতে থাকলে কবে না কবে মরে যাবে।

মাথায় জল ঢেলে গামছা দিয়ে মাথাটা মুছে দিল দিনু। কাকু বুকে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ডলে দিল বেশ কিছুক্ষণ। খানিক পরে মলয়ের ছটফটানি অনেকটা কমতে দিনু চলে গেল ঘর থেকে। অভীক আগেই চলে গিয়েছিল। মলয়কে সে আর সহ্যই করতে পারছে না। ঘর ফাঁকা হতে দরজাটা ভেজিয়ে  দিয়ে এসে কাকু খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, – সন্ধ্যা কে?

উত্তর দিতে ইতস্তত করল না মলয়। বলল – তোমার কাছে আমার লুকনোর কিছু নেই ক্ষিতি। তোমাকে তো সবই বলেছি। মার্কুইস স্ট্রিটে যে লোকটা আমাকে পাতা বেচত, সে আমাকে একদিন বলল, মেয়েদের ন্যাংটো শরীর দেখেছেন কখনো? শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম। তুমি তো জানো, মেয়েদের নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তোমরা অনেকেই প্রেম করছো। আমি সেসবের ধারে কাছে নেই। লোকটাকে বললাম, না দেখিনি, দেখার কোনো ইচ্ছে নেই।

একটু থামল মলয়। গভীর করে শ্বাস নিল বার কয়েক। কাকু বলল, – কষ্ট হচ্ছে? তাহলে থাক, পরে শুনব’খন।

মলয় বলল, – এখন একটু ভালো মনে হচ্ছে। তোমাকে বলেই ফেলি। তুমি বুঝবে। সেদিন না করে দিলেও তার প্রস্তাবটা আমার মাথায় ঘুরছিল। ধীরে ধীরে আমার মন ঝুঁকে পড়তে লাগল সেদিকে। কিছুদিন পরে লোকটা যখন একই কথা বলল, আমি চোখকান বুজে বলে ফেললাম, কত দিতে হবে? তিরিশ টাকায় রফা হলো। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা খুব পুরনো বাড়িতে নিয়ে গেল আমাকে।

শুনতে শুনতে ক্ষিতির খুব খারাপ লাগছিল। তার ধারণা ছিল পাঁড় মাতাল আধবুড়ো লোকগুলোই খালি বেশ্যাবাড়ি যায়। মলয় নানারকম নেশা করে বটে, কিন্তু মদ এখন খায় না বললেই চলে। তাছাড়া, অল্পবয়সি মেধাবী একটা ছেলে, বেশ একটা নায়িকার মতো দেখতে মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে – সে তো নিজেও নায়কের মতোই সুদর্শন, তা না চলে গেল একটা খারাপ মেয়ের কাছে! স্কুলে পড়ার সময়ই ‘রূপোপজীবিনী’ নামে একটা গল্প লিখেছিল ক্ষিতি। সেখানে সে একজন গৃহবধূকেই বারঙ্গনার সঙ্গে তুলনা করেছিল। নানা ধরনের গল্পপাঠ বদহজম হওয়ার ফল!

ক্ষিতির ভাবনার মাঝেই মলয় বলে উঠল, – মেয়েটা খুব ভালো, বুঝলে ক্ষিতি – দেখতেও মন্দ নয়। মুখের গড়ন একটু অন্য ধরনের। ওর বাবা অ্যাংলো, মা বাঙালি। আমি তো ভয়ে ভয়ে ছিলাম – দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই জামাকাপড় খুলে ফেলে যদি! মেয়েটা অবশ্য সার্ট আর স্কার্ট পরেছিল। আমাকে বিছানায় বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করল। নিজের কথা বলল, আমার কথাও জানতে চাইল। তারপর আমাকে কী আদর কী আদর – পাগলের মতো আমার বুকে মুখ ঘসে চলেছে! তার আগে আমি কোনো মেয়ের অঙ্গ স্পর্শও করিনি। সন্ধ্যা আমাকে যেন স্বর্গে পৌঁছে দিল।

খুব খটকা লাগছে ক্ষিতির। পয়সার বদলে শরীর বেচছে, সে কেন আদর করতে যাবে! মলয় নেশার ঘোরে হয়তো ভেবেছে মেয়েটা তাকে আদর করছে। মলয় বলছে, মাত্রই তিন দিন যেতে পেরেছি সন্ধ্যার কাছে। আর টাকা জোগাড় করতে পারছি না। আমি ঠিক জানি, টাকা দিতে না পারলেও আমাকে ফেরাবে না। কিন্তু সেটা উচিত হবে না বলো। ওটাই ওর পেশা। ওই টাকার থেকেই দালালকে কমিশন দিতে হয়। ঘরভাড়া আছে। থাকা খাওয়ার খরচ। মা-বাবা অবশ্য নেই। বাবাটা ওর জন্মের দু-তিন বছর পরেই জাহাজের কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। মা-টা তারও কয়েক বছর পরে একটা আধবুড়ো লোকের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। কারোরই কোনও খোঁজ নেই তারপর থেকে। মায়েরই এক দিদি তাকে বড় করে তুলেছে। একটা বারে কাজ করত। বয়স হয়ে যাওয়ার পর কাজ গেছে। এখন সন্ধ্যার সঙ্গেই থাকে। শেষ যেদিন গেছি, আমার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদছিল – জানো। বারবার বলছিল, তুমি নিয়মিত আসবে তো! আসা বন্ধ করে দেবে না তো?

মলয়ের গলা রুদ্ধ হয়ে আসছিল। ক্ষিতি সংশয়ে পড়ল। সে হয়তো ভুল ভাবছে – ওই পেশায় বাধ্য হয়ে নামতে হয়েছে বলে কি তার স্বাভাবিক মেয়েলি আবেগ শুকিয়ে গেছে! বয়সও তো বেশি নয় – মলয় বলছিল, ওকে দেখলে কিশোরী বলেই মনে হয়। তা যদি নাও হয়, মলয়ের সমবয়সি হবে বড়জোর। খুব নরম স্বভাব মলয়ের, চেহারাও আকর্ষণীয় –তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়া, এমনকি প্রেমে পড়ে যাওয়াও মেয়েটির পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।

ক্ষিতি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হওয়া তার গল্পটির কথা ভাবছিল। আত্মহত্যা করার বেশ কিছু সময় পর এক মধ্যবয়সি মানুষের আত্মা একে একে তার প্রিয় মানুষগুলির কাছে গিয়ে তাদের বর্তমান অবস্থা, তার আচমকা মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া তাদের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করেছে – এসবই পর্যবেক্ষণ করছিল। এই চরিত্রগুলি বাস্তব, সত্যি সত্যিই ক্ষিতির প্রিয় মানুষ তারা। তাদের একজন ক্ষিতির কৈশোরের প্রথম সম্মোহন – এক আদিবাসী কিশোরী, যে সত্যিই যৌবনে পদার্পণ করার পর যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের শয্যাসঙ্গিনী হতো টাকার বিনিময়ে। প্রথম জানতে পারার পর খুবই কষ্ট হয়েছিল ক্ষিতির। মলয়ের কাহিনি শুনে তার মুখটিই কল্পনায় মিশে গেল সন্ধ্যার মুখের সঙ্গে।

মন খারাপই সার! অভীকের টেলিগ্রাম পেয়ে মলয়ের বাবা পাঁচদিনের মাথায় কলকাতা পৌঁছলেন। সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর একটা হোটেলে উঠেছিলেন। দুপুরে হস্টেলে এসে সব পাট চুকিয়ে মলয়কে সঙ্গে নিয়ে আসামে চলে গেলেন। বলে গেলেন, এই হস্টেলে আর ফিরবে না মলয়। পার্ট টু ফাইনাল পরীক্ষার সময় সঙ্গে নিয়ে এসে হোটেলে থেকেই পরীক্ষা দেবে সে। কলেজে গিয়েও সব কথাবার্তা বলে এসেছেন তিনি।

সেই পরীক্ষার সময়ই শেষ দেখা হয়েছিল মলয়ের সঙ্গে। তখন শরীর অনেকটা সেরে উঠেছে। পুরনো লাবণ্য ফিরছে। চলে যাওয়ার সময় ক্ষিতিকে চুপিচুপি বলে গিয়েছিল, – মরতে বসেছিলাম। বাবা নিয়ে গিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। একটা বাজে যৌনরোগ সংক্রামিত হয়েছিল শরীরে, নেশায় আসক্তি তো ছিলই। রোগের চিকিৎসা, সেই সঙ্গে কাউন্সেলিং চলছিল সমানে। প্রথমটা সেরেছে, দ্বিতীয়টা এখনও চলবে কিছুদিন।

সন্ধ্যার নাম একবারও উচ্চারণ করল না মলয়। ফাইনাল পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল, এতকিছু সত্ত্বেও সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, বেশ উপরের দিকেই তার অবস্থান।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অকূলের কাল। পর্ব ২৭। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

  1. পর্ব ২৭ – খুব ভালো লাগলো – আগামীর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম

Leave a Reply