সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫০। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

মহাপ্রজ্ঞাকথা: কালিম্পং ও অতঃপর

এরপরের কাহিনি লিংউড মারফত আমাদের কাছে পৌঁছেছে। ধর্মের বিশদ অন্ধিসন্ধি জানি না, মহাপ্রজ্ঞা কেন যে তিব্বতি বৌদ্ধবাদ এবং থেরাবাদের মধ্যে অস্থির যাতায়াতে লিপ্ত ছিলেন, বোঝা মুশকিল। লেভিন ও গেলনারের মতে, ধর্মীয় আদর্শ নয়, নেপালি থেরাবাদীদের তিব্বতি বৌদ্ধবাদ ছেড়ে থেরাবাদে যাবার প্রধান কারণ ছিলো ভাষা। তিব্বতি বৌদ্ধবাদ জানতেবুঝতে হলে তিব্বতি ভাষা শিখতে হবে ভালো করে। তুলনায়, আদি থেরাবাদী পুঁথিপত্র সব পালিভাষায় লেখা, যে ভাষা শেখা অনেক সহজ। যে কারণেই হোক, মহাপ্রজ্ঞা থেরাবাদে থিতু হলেন। কালিম্পং পর্বে যখন তাঁর গৃহীজীবন শুরু হচ্ছে নতুন করে, ধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ বা টান বিন্দুমাত্র কমেনি, বার বার ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন, বার বার তাঁর স্ত্রী তাঁকে ধরেবেঁধে ফেরত আনছেন। সংসার চালানোর জন্য পেশাদার ছবি-তুলিয়ে হিসেবে কাজ করছেন, নতুন সংসারে দুই সন্তানও আসছে, সেসঙ্গে মহাপ্রজ্ঞা কালিম্পংয়ের নেওয়ারিদের ধর্মশিক্ষা দেবার কাজ করছেন, ধর্মোদয় বিহারের মুখপত্রে ছদ্মনামে প্রবন্ধাদি লিখছেন। ১৯৬২, চীন ভারত যুদ্ধের আঁচে কালিম্পং ফুটছে। মহাপ্রজ্ঞা শেষবারের মতো ঘর ছেড়ে পালালেন। ললিতপুর ও কাঠমান্ডুর একাধিক বিহার ঘুরে, কাঠমান্ডু শহরের কেন্দ্রে এক কুটিয়াতে তিনি থিতু হলেন, অর্থাৎ স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে ফেরা আর সম্ভব ছিলো না, কাঠমান্ডুতে তাঁর মধ্য ও শেষজীবন কেটেছে ব্যক্তি ধর্মসাধক ও লেখক হিসেবে। ধর্মে থেরাবাদী ভিক্ষু, অথচ তাঁর পরণে থাকতো লালচে-খয়েরি নিংমাপা জোব্বা। লম্বা দাড়ি রাখতেন, শোনা যায় ঝাড়ফুঁক ইত্যাদিও করতেন। নিজেকে বলতেন ‘বৌদ্ধ ঋষি’। ধর্মপ্রচার ও লেখালিখি বন্ধ করেন নি কখনোই, সঙ্ঘত্যাগের কলঙ্ক সত্ত্বেও নেপালের বৌদ্ধ সমাজে তাঁর প্রসিদ্ধি ছিলো অবিচল।

মহাপ্রজ্ঞার দীর্ঘজীবনের কাহিনি সংক্ষেপে বলা হলো। বলতে বলতে শুনতে শুনতে আমরা দেখলাম, বর্ণময়, বিচিত্রকর্মা ও প্রতিভাধর এই মানুষটিকে নিয়ে লিংউড সাহেব যে বয়ান রচনা করেছেন, তা কেচ্ছাকীর্ণ শুধু নয়, বহুলাংশে ভুল ও অসমাপ্ত। ধর্ম ও নির্বাণ, মোক্ষ ও মুক্তির সন্ধানে কী বাসনায়, কিম্বা নিছকই ভ্রমণমোহে তাড়িত হয়ে,  রৌদ্রতপ্ত উত্তর ভারতের সমতল থেকে হিমালয়ের হিমনীল তুষারশৃঙ্গ, বর্মার নদীবিধৌত উপত্যকা থেকে কলকাতা ও কাঠমান্ডু শহরের রাজপথ, তিব্বতের সুউচ্চ জনহীন দূর্গম মালভূমি থেকে বর্মা ও নেপালি তরাইয়ের অরণ্যনির্জন, এ সবের মধ্যে মহাপ্রজ্ঞার যে নিরন্তর দীর্ঘ চলাচল, এর ভিতর শুধু গল্প নয়, মহাকাব্যের উপাদান আছে। যে সময়ের কথা, তখন নেপাল থেকে ভারত, ভারত থেকে বর্মা বা তিব্বত, কোথাও যাওয়াটাই সহজ ছিলো না। অথচ, পাহাড় বন নদী মরুভূমি, ধর্মের অনুশাসন কিম্বা শাসকের লালচোখ, কিছুই মহাপ্রজ্ঞার পথ আটকাতে পারে নি, বিভিন্ন বিচিত্র স্থানকাল এবং ধর্ম ও ‘বিধর্ম’(হয়তো বা ‘অধর্মও) জুড়ে তাঁর অনায়াস সাবলীল যাতায়াত। কালিম্পং থাকাকালীন তিনি পদস্খলিত, ধর্মচ্যুত, আক্ষরিক অর্থেই নির্বাসিত। তবু, জানতে ইচ্ছে হয়, তাঁর ছেড়ে যাওয়া পরিবারের কি গতি হলো, তাঁর তোলা ছবিগুলোই বা কোথায়? ধর্মের জটিল কূটকচালের বাইরের, লালচে-খয়েরি জোব্বা, লম্বা দাড়ি এবং ‘বৌদ্ধ ঋষি’র খোসার ভিতরকার আসল লোকটি কেমন ছিলেন, কিসের কষ্ট ও সন্ধান তাঁকে সারাজীবন ছুটিয়ে বেড়িয়েছে? এত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব নয়, এবং, আমাদের অনেক পথ হাঁটা বাকি। লিংউড এবং কালিম্পং-এর গল্পে ফেরা যাক।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply