অকূলের কাল। পর্ব ২৫। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
আশা স্বপ্ন যথা
আচমকাই ক্ষিতির চারদিক থেকে সুবাতাস ছুটে আসছে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই ফোন। এমন অসময়ে কে ফোন করল – অবাক ক্ষিতি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আন্দাজের চেষ্টা করে।
ফোন ধরতেই অমিয়র খুশি খুশি গলা – মা-মাঃ!
এমন করে অমিয় ‘মামা’ ডাকে তখনই, যখন কোনো ভালো খবর দেওয়ার থাকে। তাছাড়া তেমন খবর না থাকলে পকেটের পয়সা খরচ করে সাতসকালে ফোন করার পাত্রই নয় সে। সত্যিই তাই। অমিয় বলল, – কাল টি আই প্যারেড হয়ে গেছে। কোনো বাঞ্চোত ওদেরকে চিনতে পারেনি।
এই ‘বাঞ্চোত’ এখন আদরের বিশেষণ। তারপর বলল, – সব সাক্ষীই ভালোমতোই চেনে ওদের। এক তো পোঁদে ভয় ছিল – নকশালের নাম থাকলেই ভয়ে মুতে ফেলে। তার উপরে কোম্পানির উকিল ওদের টাকাপয়সা দিয়ে তুলতুলে করে রেখেছিল।
ক্ষিতি জিজ্ঞেস করে, – তাহলে অশোক কি এবার জেল থেকে ছাড়া পাবে?
অমিয় বলল, – এখনই কী করে পাবে! আগামী সপ্তাহে ওদের মামলার শুনানি আছে। উকিল বলেছে, মামলায় আর কিছু নাই। কোর্ট মামলা ডিসমিস করতে বাধ্য।
- মানে?
- -মানে আর কী – ওরা সবাই খালাস পেয়ে যাবে। আর জেলারের কাছে রায়ের কপি গেলেই ওদের জেল থেকে ছেড়ে দেবে। আর বড়জোর এক মাস।
ক্ষিতি মুখে বলল বটে – উকিল ঠিক বলেছে তো? কিন্তু মনের ভেতরে খুশির হাওয়া। ফোন রাখার আগে অমিয় বলল, শুনানির খবর হলে জানাবে, মামা পারলে সেদিন যেন আলিপুরের পুলিশ কোর্টে চলে আসে।
এই খবরের রেশ থাকতে থাকতেই দিন তিনেক পরে আবার খবর। পি এস সি-র ক্লার্কশিপ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। খবরের কাগজে সফল পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর ছাপা হয়েছে। কাগজের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ক্ষিতি। তার চোখ দ্রুত চলছে তালিকার উপর থেকে নীচের দিকে। অনেক নম্বর। দুশো আড়াই শো হবে। দুরুদুরু বুক। তালিকার মাঝামাঝি পেরিয়ে নিজের রোল নম্বরে চোখ আটকে গেল তার। ক্ষিতির আগ্রহ দেখে কৌতূহলে তার পাশে এসে কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে দিনু আর অনুপমও। পি এস সি –র বিজ্ঞাপন দেখে তারা আন্দাজও করেছে ক্ষিতির আগ্রহের কারণ। ক্ষিতি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কাগজ ছেড়ে। মুখে কিছু না বলে নিজের খাটের তলা থেকে তার বাক্স টেনে হিঁচড়ে বের করে। বাক্সের ডালা খুলে হাতড়ে বের করে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড। একবার মিলিয়ে দেখে নেওয়া ভালো। এবার খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেই নেচে উঠল মন। ব্যাপারটা বুঝে নিতে দেরি হলো না দিনু অনুপমেরও। — শালা কাকু – বলেই উচ্ছ্বসিত দিনু জড়িয়ে ধরল ক্ষিতিকে। অনুপম বলল, – এবার সানাই বাজল বলে – বলেই সে পকেট থেকে তার মাউথ অরগ্যানটা বের করে সানাইয়ের সুর তোলার চেষ্টা করে।
ততোক্ষণে ক্ষিতির খেয়াল হলো, আরে মনোজিৎদার রোল নম্বর আছে তো তালিকায়! সে খবরের কাগজের পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে ভরেই রওনা দিল মনোজিৎদার ঘরের দিকে। কিন্তু না গেলেই ছিল ভালো। তার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই দেখে গম্ভীর মুখে বসে আছে মনোজিৎদা। বিছানায় অবহেলায় পড়ে আছে সেদিনেরই অন্য একটা খবরের কাগজ, ফ্যানের হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে সেই একই পৃষ্ঠা যেখানে ক্লার্কশিপ পরীক্ষায় কোয়ালিফায়েড পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বরের তালিকা প্রকাশিত। যা বোঝার বুঝে গেল ক্ষিতি। বোকার মতো দরজা থেকেই অপ্রতিভ মুখে ফিরে আসছিল সে, মনোজিৎদা তাকে ডাকল – আরে ক্ষিতি, চলে যাচ্ছো কেন – বসো তো এসে।
ক্ষিতি প্রবল অস্বস্তি নিয়ে মনোজিৎদার খাটের একপাশে এসে বসল। মনোজিৎদা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, – তালিকায় তুমি আছো সে তোমাকে দেখেই বুঝেছি। আমি নেই তাতে কী!
এতক্ষণে কথা খুঁজে পায় ক্ষিতি। বলে, – আমি কি আর জানি না! আপনার লক্ষ্য কেরানিগিরি করা হতেই পারে না। আপনার উপযুক্ত তো নয়ই। আমার বিশ্বাস আপনি আজ নয় তো কাল ডব্লিউ বি সি এস হবেনই। আমি ভালো করে জানি অ্যারিথমেটিক পেপারে হয়তো চল্লিশের থেকে দু-চার নম্বর কম পড়ে গেছে বলে কোয়ালিফাই করতে পারেননি। নইলে খোঁজ করলে জানা যাবে সব পেপার মিলিয়ে আপনার পাওয়া মোট নম্বর আমার থেকে তো বটেই, আরও অনেক জনের থেকে অনেক উপরে আছে।
মনোজিৎদা বলল, – অতি সরলীকরণ করে লাভ নেই। লক্ষ্য সকলেরই উপরের দিকে থাকে। তোমার কি নেই? তুমি তো জানো আমার আর্থিক অবস্থা। এই মুহূর্তে কেরানির চাকরি পাওয়াটাই হতো লটারি জেতার সমান। একটা কথা অবশ্য ভালো বলেছো। কোন পেপারে কত মার্কস পেয়েছি – জানা গেলে নিজেকে অ্যাসেস করা যেত। চলো একদিন টাউন হলে যাই। তোমার পজিসন কী – সেটাও জানা যাবে হয়তো।
ক্ষিতি আপাতত ছটফট করছে কখন সে খবরটা দিতে পারবে দোলনকে। ছটফট করা ছাড়া উপায়ও নেই। নিজে থেকে তাকে ফোন করতে পারবে না। সে কবে ফোন করবে সেই অপেক্ষায় তাকে দম ধরে বসে থাকতে হবে। আজ সন্ধেয় না করলে কাল সন্ধের জন্যে অপেক্ষা, না করলে পরশু…
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সেই সঙ্গে সমানে চলেছে সাধারণ মানুষের উপর পাক মিলিটারি আর রাজাকারদের মিলিত অত্যাচার, অবাধ লুটপাট, খুন, ধর্ষণ। ভারত সরকার সমানে সহযোগিতা করে চলেছে। আওয়ামি লীগের যেসব নেতারা পাক মিলিটারির হাতে ধরা পড়েননি তারা সবাই ভারতে, বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় সরকারের আশ্রয়ে আছেন। এমনকি শোনা যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র, যা সম্প্রতি চালু হয়েছে, সেটাও নাকি চলছে কলকাতারই কোনো জায়গা থেকে। এসব নিয়ে রেডিওই এখন বেশি খবর করছে, দেবদুলালের ‘সবিনয় নিবেদন’ তো খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু কাগজের খবরে বাংলাদেশের সংবাদ পিছনের দিকের পাতায় সরে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, নকশাল দমনের নামে পুলিশের যথেচ্ছ ধরপাকড়, এমনকি এনকাউন্টারের নাম করে তরুণদের গুলি করে মেরে ফেলা – এসব খবরই এখন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বেশি জায়গা দখল করে নিচ্ছে।
সকালে কাগজ পড়ে ক্ষিতির মনটা ভারী হয়ে থাকে বহুক্ষণ। বিশেষ করে অনুপমের জন্যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে সে। দু-দুটো ভালো খবর সত্ত্বেও গত রাতে স্বপ্ন দেখেছে অনুপম নিজের চটি দুটো খুলে হাতে নিয়ে একটা গলি দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে, তার পিছনে বন্দুক উঁচিয়ে একটা ট্র্যাফিক কনস্টেবল। হঠাৎ ক্ষিতির মনে হলো, – আরে, ভয়ংকর সরু গলিটা তো দোলনের মামাবাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে বিধান সরণিতে গিয়েই পড়েছে। সেখানে নিশ্চয় আরও অনেক পুলিশ রাইফেল-টাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছে। অনুপম বেরনো মাত্র গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে। তাকে সাবধান করতে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে ক্ষিতি, কিন্তু কিছুতেই গলা দিয়ে স্বর ফুটছে না। ঠিক তখনই শচি তার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলা দিল। ক্ষিতি চোখ মেলে শচিকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। যাক – এসব সত্যি নয়, সে স্বপ্ন দেখছিল। শচি উঠে পড়েছে মানে ভোর হয়ে গেছে। বলল, – কাকু, ঘুমের মধ্যে গোঁ-গোঁ করছিলি কেন!
ক্ষিতি হাসার চেষ্টা করল। বলল, – একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরে বলব তোকে। এখন তো তোর প্রেম করতে বেরনোর সময় হয়ে এল।
পাশ ফিরে শুয়ে স্বপ্নটার কথা ভেবে প্রথমে হাসি পেল তার। ট্র্যাফিক কনস্টেবলের হাতে বড়জোর একটা লাঠি থাকতে পারে, স্বপ্নে কেমন করে বন্দুক উঠে গেল হাতে! তারপরেই খেয়াল হলো, তাইতো, ভোরবেলাতেই এমন স্বপ্ন – লোকে যে বলে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়! মনটা দমে গেল আবার। তারপর ভাবল, ধুস সব ফালতু কথা এসব নেহাতই কুসংস্কার। মনে জোর আনার চেষ্টা করতে করতে ভাবল – আজ যদি দোলনের ফোন আসে, তাকে চাকরির পরীক্ষার খবরটা দিতে পারবে।
(ক্রমশ)
